ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক দখল, লুটপাট, খেলাপি ঋণ, দুর্বল তদারকি, সুশাসনের অভাব ও অর্থ পাচারের ঘটনায় গভীর সংকটে পড়ে দেশের ব্যাংকিং খাত। ঝুঁঁকিতে পড়ে গ্রাহকের আমানত। তৎকালীন সরকারের এই সংকট ২০২৫ সালে বছর জুড়েই ছিল আলোচনার বিষয়। এমন প্রেক্ষাপটে নানামুখী সংস্কার উদ্যোগ, কঠোর নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত এবং কিছু সাহসী পদক্ষেপ নেয়া হলেও এ খাতে এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীলতা আনতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, ২০২৫ সাল বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য ছিল একদিকে গভীর সংকটের বছর, অন্যদিকে সংস্কার ও পুনর্গঠনের প্রচেষ্টার সূচনা।
খেলাপি ঋণ: বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি- উভয় ধরনের ব্যাংকেই খেলাপি ঋণের চাপ বেড়েছে। বড় ঋণগ্রহীতাদের ক্ষেত্রে পুনঃতফসিল, বিশেষ ছাড় এবং সময় বাড়ানোর সংস্কৃতি খেলাপি ঋণ কমানোর বদলে সমস্যা আরও জটিল করেছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততা কমেছে এবং নতুন ঋণ বিতরণের সক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, দেশের ব্যাংকগুলো যত টাকা ঋণ দিয়েছে, তার এক-তৃতীয়াংশের বেশি এখন খেলাপি।
ব্যাংক একীভূতকরণ: ২০২৫ সালে দুর্বল ব্যাংকগুলো টিকিয়ে রাখতে সরকারের সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূতকরণ নীতিতে জোর দেয়। উদ্দেশ্য অকার্যকর ও দুর্বল ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষা দেয়া এবং খাত জুড়ে আস্থার সংকট কমানো। যদিও এই উদ্যোগ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। অনেকের মতে, দুর্বল ব্যাংকের দায় শক্তিশালী ব্যাংকের ওপর চাপিয়ে দিলে পুরো খাত ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দাবি, বিকল্প পথ না থাকায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কয়েকটি প্রভাবশালী গ্রুপ জালিয়াতির মাধ্যমে ডজনখানেক ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেয়। এসব অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারির চাপে ব্যাংকগুলো ধীরে ধীরে গভীর সংকটে পড়ে। এর মধ্যে সংকটে থাকা পাঁচটি ব্যাংক একত্রিত করে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক গঠনের অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যার পরিশোধিত মূলধন নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার ইতিমধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা বাজেট থেকে দিয়েছে।
রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন: ২০২৫ সাল জুড়ে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স প্রবাহে উল্লম্ফন দেখা গেছে। জানুয়ারি থেকে চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসেই প্রবাসী আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ব্যাংকিং খাত ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় বড় স্বস্তি এনে দিয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ১৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৫০৫ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে এসেছিল এক হাজার ২৯০ কোটি ডলার। ফলে এই সময়ে প্রবাসী আয় বেড়েছে ১৬.৭ শতাংশ।
রিজার্ভে স্বস্তি: অনিয়ন্ত্রিত অর্থপাচারের ফলে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ তিন বছরে দেশের অর্থনীতিতে তীব্র ডলার-সংকট দেখা দেয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ড. আহসান এইচ মনসুর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ডলার সংকট কাটাতে এবং অর্থপাচার রোধে নানা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নজরদারির ফলে বৈধ পথে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় বেড়েছে।
চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত প্রবাসী আয় বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ এবং রপ্তানি আয়েও প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। পুরোনো আমদানি দায় পরিশোধ হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৮ ডিসেম্বর দিন শেষে গ্রস রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩২.৩৭ বিলিয়ন ডলার। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ হয়েছে ২৭.৮৮ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার ক্রয়: বৈদেশিক মুদ্রার যোগান-চাহিদার ভারসাম্য ঠিক রাখতে এবং মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ডলার কিনেছে। সবমিলিয়ে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট দুই হাজার ৮০৪ মিলিয়ন বা ২.৮০ বিলিয়ন ডলার ক্রয় করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
উচ্চ সুদহার ও বিনিয়োগে মন্থরগতি: গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেসরকারি খাতে স্থবিরতা নেমে এসেছে। নতুন প্রকল্প কমে যাওয়া এবং অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার ফলে খেলাপি ঋণ ও কর্মসংস্থান সমস্যার মুখে পড়েছে। ঋণের সুদহার বর্তমানে ১৫ শতাংশে উঠেছে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। এমন পরিস্থিতিতেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মুদ্রানীতিতে সুদহারে কোনো পরিবর্তন আনেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সংস্থাটি ঘোষণা দিয়েছে, মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের নিচে না নামা পর্যন্ত নীতি সুদহার কমানো হবে না। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর জানান, মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমছে এবং ভবিষ্যতে আরও কমবে। তবে এটি এখনও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আসেনি। যতদিন তা ৭ শতাংশের নিচে না আসবে, ততদিন নীতি সুদহার পরিবর্তন করা হবে না। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি ৩ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা।
কঠোর মুদ্রানীতি: বছর জুড়ে মূল্যস্ফীতি ওঠানামার মধ্যে ছিল। তবে বছরের শেষ সময় মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের ঘরেই ঘোরাফেরা করছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয় ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয় ৯ দশমিক ০৮ শতাংশ। গত তিন বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ০৩ শতাংশ।
সংস্কারের উদ্যোগ (ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশ): অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ব্যাংকগুলোতে তদারকি জোরদার করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একইসঙ্গে এতদিন বিভিন্ন নীতিমালায় যেসব ছাড় দেয়া হয়েছিল, তা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হয়। ২০২৫ সালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার উদ্যোগগুলোর একটি হলো ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ’ অনুমোদন। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক ব্যবস্থাপনা, একীভূতকরণ বা প্রয়োজনে অবসায়নের আইনি কাঠামো তৈরি হয়েছে। দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকার জারি করে ‘আমানত সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫’। এর ফলে কোনো ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানি অবসায়ন বা বন্ধ হয়ে গেলে সাধারণ আমানতকারীরা তাৎক্ষণিকভাবে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা ফেরত পাবেন।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক সংস্কারে ছিল না দৃশ্যমান উদ্যোগ: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সংস্কারে বেশকিছু দৃশ্যমান উদ্যোগ নেন। তবে এ সময়ে বেসরকারি খাতের তুলনায় সরকারি ব্যাংক সংস্কারে তেমন কোনো বড় পদক্ষেপ দেখা যায়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এসব ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করে। গত বছরের ৫ই আগস্ট-পরবর্তী সময়ে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও এমডি পদে পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন হয়নি।
৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের উদ্যোগ: ২০২৫ সালে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) সংস্কারের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই অংশ হিসেবে আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে না পারা, উচ্চখেলাপি ঋণ এবং মূলধন ঘাটতি- এই তিন সূচককে ভিত্তি ধরে ৯টি প্রতিষ্ঠানকে অব্যবহারযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর আওতায় প্রতিষ্ঠানগুলো অবসায়নের (লিকুইডেট) উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাত একটি কঠিন সময় পার করে ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং আস্থা ধরে রাখতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক দৃঢ়ভাবে কাজ করছে।