৫ই আগস্ট, ২০২৪। বেলা তখন দেড়টা। ভারত থেকে এক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তার ফোন আসে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। সেই কর্মকর্তা ছিলেন হাসিনার পূর্বপরিচিত। খুবই সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা হয়েছিল দু’জনের। এক পর্যায়ে ভারতীয় কর্মকর্তা বলেন, ইতিমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আপনি যদি এখনই গণভবন না ছাড়েন তাহলে আপনাকে খুন হতে হবে। আরও বলেন, আপনার আগামী দিন লড়াই করার জন্য বেঁচে থাকা উচিত। ফোনের এই কথোপকথনের পরই নাকি হাসিনা দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। অবশ্য বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার স্রোত ধেয়ে আসছে গণভবনের দিকে সেই উদ্বেগজনক খবরও প্রতি মুহূর্তে দিচ্ছিলেন সেনাপ্রধান।
সম্প্রতি ভারতে প্রকাশিত সাংবাদিক, লেখক দীপ হালদার, জয়দীপ মজুমদার ও শহিদুল হাসান খোকনের লেখা ‘ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশ: দ্য স্টোরি অব অ্যান আনফিনিশড রেভ্যুলেশন’ শিরোনামে একটি বইয়ে ২০২৪ সালের ৪ ও ৫ই আগস্ট গণভবনের অভ্যন্তরে কী হয়েছিল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।
লেখকরা জানিয়েছেন, গণভবনের অভ্যন্তরের ঘটনাবলির পুনর্নির্মাণ তারা করেছেন হাসিনার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, সেনাবাহিনীর একজন স্টাফ অফিসার, নিরাপত্তা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির কয়েকজন সদস্য, দুইজন সাবেক আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এনএসআই ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের কয়েকজন কর্মকর্তা, পুলিশের দুইজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে।
বইটিতে বলা হয়েছে ৪ঠা আগস্ট বিকালেই গণভবনের এক বৈঠক থেকে হাসিনাকে দেশ ছাড়ার পরামর্শ দেয়া হয়। সেই অঘোষিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান, বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান, নৌবাহিনীর প্রধান এডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান, পুলিশ প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, কেবিনেট সচিব মোহাম্মদ মাহবুব হোসেনসহ কয়েকজন প্রশাসনিক উচ্চ কর্মকর্তা এবং শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীসহ দলের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা। তারা সকলে উদ্বেগজনক খবর পেয়েই প্রধানমন্ত্রীকে বোঝাতে এসেছিলেন যে, সময় দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই আপনার দেশ ছাড়া উচিত। কিন্তু হাসিনা সেই পরামর্শ মুখের ওপর প্রত্যাখ্যান করেন। পাল্টা শিক্ষামন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন, ভাবলেন কী করে এই সংকট মুহূর্তে আমি দেশ ছেড়ে চলে যাবো। সেনাপ্রধানের কাছে হাসিনা জানতে চান, আপনি আমার পাশে শক্তভাবে দাঁড়াবেন কিনা। এর উত্তরে সেনাপ্রধান হ্যাঁ বলেছিলেন। এর পরেও নৌপ্রধান ও বিমানবাহিনী প্রধান হাসিনাকে জানান, তারা শক্তভাবে তার পেছনে থাকলেও তার উচিত দেশ ছাড়ার প্রস্তাবটি বিবেচনা করা। তা যদি নাও হয় অন্তত পক্ষে তখনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে স্থানান্তরিত হতে বলেছিলেন তারা। কিন্তু হাসিনা গোঁ ধরেন, বাংলাদেশকে পরিত্যাগ করে কোথাও যাবেন না।
সেদিনই হাসিনা নিরাপত্তা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠক ডেকেছিলেন। তিন বাহিনীর প্রধান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন- জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র সচিব, পুলিশপ্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মিজানুর রহমান শামীম, ডিজিএফআইয়ের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদুল হক, এনএসআইয়ের প্রধান মেজর মোহাম্মদ হোসেইন আল মোরশেদ, বিজিবি’র প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, উপকূলরক্ষী বাহিনীর প্রধান রিয়ার এডমিরাল মীর এরশাদ আলী, স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান মনিরুল ইসলাম ও কয়েকজন মন্ত্রী। সকলের চোখমুখ ছিল বিষাদে ভরা। ছাত্র-জনতার মৃত্যু ও ভয়ঙ্কর হিংসার খবর আসছিল ক্রমাগত। সেদিনই ৯১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়, বেশির ভাগ পুলিশের গুলিতে। ১৬ জন পুলিশ কর্মকর্তারও মৃত্যু হয় বলে খবর এসেছিল। এর মধ্যে ১৫ জনেরই মৃত্যু হয় সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুরে। একজন পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যু হয় কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জে। উন্মত্ত বিক্ষোভকারীরা সারা দেশে থানা আক্রমণ করছিল, চলছিল লুটপাট। আক্রান্ত হচ্ছিল দোকানপাটও। শীর্ষ সেনাকর্তাদের কাছে সবচেয়ে উদ্বেগজনক খবর এসেছিল যে, ছাত্র-জনতা রাস্তায় রাস্তায় টহলরত সেনাবাহিনীর জওয়ান ও জুনিয়র অফিসারদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছে। তাদের হাতে ফুলের স্তবক দিচ্ছে। সেনারাও তাদের সম্বোধন করেছে সুন্দরভাবে।
সেনাকর্তারা তখনই বুঝে গিয়েছিলেন, রাস্তায় টহলরত সেনাদের বেরিয়ে আসা জনতার ওপর শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দেয়া যাবে না। এমন অবস্থায় এনএসআই প্রধান আল মোরশেদ প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে চলেছে। ডিজিএফআই প্রধান মেজর জেনারেল হামিদ বলেন, জনতার ক্রোধের মোকাবিলা করতে প্রধানমন্ত্রীর উচিত সমঝোতার বড় ধরনের কোনো উদ্যোগ নেয়া। প্রধানমন্ত্রী তখন জানতে চান, কী ধরনের সমঝোতা? কয়েকজন বললেন, রাজনৈতিকভাবে তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আবার অনেকে জানান, সাময়িকভাবে ক্ষমতা প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিনের হাতে তুলে দেয়া যেতে পারে। কিংবা কয়েকজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি, সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এবং সিভিল সোসাইটির কয়েকজনকে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তৈরি করে ক্ষমতা দেয়া যেতে পারে।
কিন্তু এবারো শেখ হাসিনা সব প্রস্তাব খারিজ করে দিয়ে বললেন, ‘নির্বাচিত হয়ে আমি ক্ষমতায় এসেছি। তাই অগণতান্ত্রিক শক্তির পরিকল্পিত প্রতিবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবো না।’ হাসিনাকে সমর্থন করে নিরাপত্তা উপদেষ্টাও বলেছিলেন, প্রতিবাদকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মোকাবিলা করা যাবে। তিনি কারফিউ ভঙ্গ করলে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার পক্ষে জোর সওয়াল করেন।
শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার আগে গণভবনে কী ঘটেছিল: পুলিশ কমিশনার ৪ঠা আগস্ট সন্ধ্যায় আবারো শেখ হাসিনাকে বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। এই অবস্থায় পুলিশ দিয়ে শক্তি প্রয়োগ করতে গেলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। কিন্তু হাসিনা তার সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। তার মতে, এই বিক্ষোভ ভিত্তিহীন। বাইরের শক্তি এদের মদত যোগাচ্ছে। তিনি শক্তি প্রয়োগ করে বিক্ষোভকে দমানোর পথে জোর দেন।
হাসিনার কাছে যুক্তি তৈরি ছিল। তিনি বলেন, ক্ষুব্ধ ছাত্রদের সঙ্গে এই আন্দোলনের সম্পর্ক নেই। এটা রাজনৈতিক আন্দোলন এবং বাইরের শক্তি একে ইন্ধন দিচ্ছে ও নিয়ন্ত্রণ করছে। ছাত্র আন্দোলন গতি পাওয়ার পর থেকে তিনি এই একই কথা বলে আসছিলেন। তবে পুলিশ কমিশনার বলেন, তার বাহিনী শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং তাদেরকে যে নির্দেশ দেয়া হবে তা তারা পালন করবে।
সেদিনই ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সব ধরনের প্ল্যাটফরমকে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু বৈঠক চলাকালীন খবর আসে যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ ঢাকার উদ্দেশ্যে লং মার্চকে ছয় তারিখের বদলে পাঁচ তারিখ করার ঘোষণা দিয়েছেন। বিপদ সংকেতের আঁচ পাওয়া সত্ত্বেও শেখ হাসিনা পুলিশ ও বিভিন্ন নিরাপত্তা এজেন্সিকে ছক তৈরির নির্দেশ দেন যাতে আন্দোলনকারীরা ঢাকায় প্রবেশ করতে না পারে। এই অবস্থাতেও বৈঠকে উপস্থিত সেনা জেনারেল ও সরকারি কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, শক্তি প্রয়োগ করে মার্চ আটকাতে গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। এবং দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে চলে যাবে। তারা প্রস্তাব দিলেন, তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের এখুনি গণভবনে ডেকে আলোচনায় বসুন।
কিন্তু প্রস্তাবটি নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, আমি অনেকবার বলেছি, কোটাবিরোধী আন্দোলন আসলে তৈরি করা, ছাত্রদের বিভ্রান্ত করা হয়েছে। বাইরের শক্তি মাঠে রয়েছে। এবং দেশ হুমকির মুখে। এই সময় সব শক্তিকে একজোট হয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে হবে।
এদিকে বৈঠক শেষ হওয়ার আগেই উপকূলরক্ষী বাহিনীর প্রধান, এনএসআই ও ডিজিএফআইয়ের প্রধান এবং পররাষ্ট্র সচিব বেরিয়ে যান। এরপর সন্ধ্যায় পুলিশপ্রধান শেখ হাসিনাকে বলেন, আমার বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য সেনাবাহিনীকে চাই। তাদের কাছে খবর এসেছে লাখ লাখ মানুষ ঢাকা অভিমুখে রওনা হয়েছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে এও জানান, দীর্ঘ চার মাসের বেশি সময় ধরে রাস্তায় ডিউটি করতে করতে তারা ক্লান্ত। তাদের মনোবলও ভেঙে গেছে। অস্ত্রের অভাবের কথাও বলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে সেনাপ্রধানকে ঢাকায় প্রবেশের সব পয়েন্ট এবং অন্যত্র সেনা নিয়োগের নির্দেশ দেন। তখন ওয়াকার-উজ-জামান জানান, সেনা নিয়োগ করা হলেও তারা বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাবেন না এবং কোনো কঠোর অবস্থান নেবেন না। হাসিনা তখন জানতে চান, কারফিউ ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে সেনারা কেন কঠোর ব্যবস্থা নেবে না।
সেনাপ্রধান বলেন, অনেক অবসরে যাওয়া সেনা কর্মকর্তা ও সেনাদের পরিবারের সদস্যরা এবং কর্তব্যরত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরা এই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। তাই সেনারা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালাবে না। ক্ষতি হয় এমন ব্যবস্থাও নেবে না। এই ধরনের নির্দেশ দিতে গেলে সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ দেখা দেবে।
সেনাপ্রধান হাসিনাকে আরও জানান, তার আগের পূর্বসূরি জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভূঁইয়া এবং কয়েকজন অবসরে যাওয়া সেনা কর্মকর্তা এক সংবাদ সম্মেলন করে সেনাদের রাস্তা থেকে ব্যারাকে ফিরে যেতে বলেছেন। অনেক জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের থেকে ফোন ও বার্তা পাচ্ছেন যে, সেনাদের দেশের মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা বন্ধ হোক। অগত্যা সেনাপ্রধানের বক্তব্য মেনে নেয়া ছাড়া হাসিনার সামনে কোনো পথ খোলা ছিল না। হাসিনা তখন পুলিশপ্রধানকে ফোন করেন।
পুলিশপ্রধান জানান, আন্দোলনকারীদের ঢাকায় প্রবেশ আটকাতে সব পরিকল্পনা তৈরি। তখন হাসিনা সেনাপ্রধানকে বলেন, সেনাবাহিনী যেন সাঁজোয়া গাড়িতে টহল দেয়। সেনাপ্রধান রাজি হয়ে যান। এরপরেই সকলে চলে যান গণভবন ছেড়ে। হাসিনা ও তার বোন রেহানা রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ রাতের খাবার খেয়ে যে যার শোবার ঘরে চলে যান। কিন্তু মাঝরাত পর্যন্ত সেনা, পুলিশ, গোয়েন্দাবাহিনী এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ফোন আসতেই থাকে হাসিনার কাছে। তিনি সব ফোন নিজেই ধরেন। এরপর মাঝরাত পেরিয়ে শুতে যান। তবে জানতেন না যে- গণভবনে সেটিই শেষ রাত। (চলবে)