চব্বিশ বছর বয়সী সাব্বির হোসেন মুন্না। গত বছরের ৫ই আগস্ট জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বাসা থেকে বেরিয়ে আর ঘরে ফেরেননি। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে আন্দোলনে যেতেন সাব্বির। দীর্ঘ সময় ধরে খোঁজাখুঁজির পরও সন্ধান মেলেনি তার। দীর্ঘ ১৬ মাস পর নিখোঁজ সাব্বিরের খোঁজ পায় পরিবার। তবে জীবিত নয়, সাব্বিরকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয় জুরাইন কবরস্থানে। সোমবার ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত হয় সাব্বিরের পরিচয়। সাব্বির বাবা-মায়ের সঙ্গে ভাড়া বাসায় নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে থাকতেন। তাদের গ্রামের বাড়ি নীলফামারী। তার বাবা-মায়ের সঙ্গে তিনিও একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। সাব্বিরের নিখোঁজ হওয়ার পর তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েন, বন্ধ হয়ে যায় ছোট বোন সুমাইয়ার পড়াশোনা। সাব্বিরের মা তার একমাত্র ছেলে সন্তানের কবরটি তার গ্রামের বাড়িতে স্থানান্তর করতে চান।
নিহত সাব্বিরের মা মুক্তা বেগম মানবজমিনকে বলেন, এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে খুঁজিনি। এমন কোনো মানুষ নেই হাত-পা ধরিনি। সব জায়গাগুলোতে আমাকে ঘুরিয়েছে। সন্তান হারিয়েছে আমার এই কষ্ট কী আর কেউ বুঝবে। এতগুলো মাস আমি আমার সন্তানকে খুঁজেছি পাগলের মতো। ১৫ বছর যাবত নারায়ণগঞ্জে থাকি আমরা। আমাদের গ্রামের বাড়ি নীলফামারীতে। আমার স্বামী পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। আমিও পোশাক কারখানায় চাকরি করেছি। যখন নারায়ণগঞ্জ আসি তখন ছোট অবস্থায় ছেলেমেয়ে দু’জনকে নিয়ে আসি। সাব্বির আমার একমাত্র ছেলে সন্তান ছিল। মাদ্রাসায় পড়তো যখন দেখেছে সংসারে অভাব তখন পড়ালেখা ছেড়ে দেয়। এরপর সে হোটেলের কাজসহ অন্যান্য কাজ শিখেছে এবং তখন থেকে কাজ করতো।
মুক্তা বেগম বলেন, আমার এই কান্না কোনোদিনও থামবে না। অনেক কষ্টের সন্তান আমার, দুই সন্তানকে নিয়ে অনেক কষ্ট করেছি। অনেক কষ্টে তাদের বড় করেছি। কখনো ভাবিনি আমার সন্তানের মুখটিও শেষবারের মতো দেখতে পাবো না।। জুরাইন কবরস্থানে শুক্রবার যাবো। সন্তানের কবরটি জিয়ারত করে আসবো।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আমার সন্তান প্রায়ই মিছিলে যেতো। আমরা দু’জনে চাকরি করার কারণে কিছুই জানতে পারতাম না। আন্দোলন বড় আকার ধারণ করলে ফ্যাক্টরি বন্ধ দিলে আমরা বাসায় চলে আসি। বাসায় এসে দেখি সাব্বির নেই। ৪ঠা আগস্ট ছিল। চিটাগাং রোডের অবস্থা ভয়াবহ। বৃষ্টির মতো চারিদিকে গুলি চলছে। আমি এগুলো দেখে কর্মস্থল থেকে কাঁদতে কাঁদতে আসি আর বলি আজ যে কতো মায়ের বুক খালি হবে। সেদিন ওর বাবা বাসায় আসলে সন্ধ্যা হয়ে গেলেও ছেলে আর বাসায় আসে না। তখন আমি ওর বাবাকে নিয়ে খুঁজতে বের হই। রাস্তায় দেখি গুলিবিদ্ধ মানুষ কাতরাচ্ছে, আবার কেউ কেউ মারা গেছে। একটু দূরে দেখি আমার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে আর আমাকে ইশারা দিয়ে বলছে বাসায় যাও। তখনো আমি জানতাম সে এগুলোতে নিয়মিত যেতো। ৪ঠা আগস্ট রাতে সাব্বির কিছু কাঁচাবাজার নিয়ে বাসায় আসে। সেদিন রাতভর আমার সন্তানকে পাহারা দেই। কিন্তু সকাল হতে না হতে সে আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে নাস্তা না খেয়ে অনেক ভোরে বেরিয়ে যায়। সকালে শুধু সাব্বিরকে ওঠতে দেখলাম, তারপর থেকে আর তার খবর নেই।
৫ই আগস্টে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে সাব্বিরের বাসায় ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন মা মুক্তা বেগম। তিনি বলেন, যখন শেখ হাসিনা দেশ থেকে চলে গেছে তখন মনে হয়েছে আমার সন্তান যেখানে আছে না কেন আসবে। এখন তো হাসিনা চলে গেছে কোনো সমস্যা হবে না। চারিদিকে আনন্দ মিছিল শুরু হলো। মনের মধ্যে সাহস পেতে শুরু করলাম। পরে দেখি ওর কোনো খবর নেই, বাসায় ফিরছে না। এরপর থেকে শুরু হলো খোঁজাখুঁজি। সকালে অফিসে চলে যাই আমরা সেখানে মন না বসাতে ছুটি নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ি খুঁজতে। চিটাগাং রোড-হাউস ব্লিডিং অসংখ্যবার সাব্বিরের ছবি নিয়ে খুঁজেছি। কেউই চিনতে পারে না। আবার ভয়ে কেউ কথাও বলছে না। ৬ই আগস্ট ঢাকা মেডিকেলের মর্গে এসে খুঁজি। সেখানে ঢুকে দেখি শিশু থেকে শুরু করে অসংখ্য লাশের সারি। গত বছরের ১৮ই আগস্ট সোনারগাঁও থানায় জিডি করি।
তিনি বলেন, সন্তানকে খোঁজার জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি কিন্তু খুঁজে পাইনি। দু-একদিন পর ফেসবুকে দেখি ঢামেকের মর্গে এখনো ৬ জনের লাশ আছে। সেখানে আমি এতবার গিয়েছি একবারের জন্যও আমাকে দেখতে দেয়নি। এরপর আবার যাই দেখতে মর্গে। সেখান থেকে থানায় পাঠায় আবার থানা থেকে হাসপাতালে আসি। এভাবে কয়েকবার তাদের হাত-পা ধরি আর বলি আমাকে একটু ছবিগুলো দেখান। এরপর কিছুদিন পর আবার গিয়ে দেখি সাদা কাপড়ে মুড়ানো লাশের ছবিগুলো। সেখান থেকে একবারেই মুখ দেখে আমার সন্তানকে চিনে ফেলি। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এটা আমার সন্তান। তখন খুব আফসোস হয় কেন একবারের জন্য মেডিকেলে আমার সন্তানের মুখটা দেখালো না।
তিনি আরও বলেন, পরবর্তীতে জুলাই ফাউন্ডেশনে যোগাযোগ করি। সেখান থেকে তাদের সহযোগিতা নিয়ে শাহবাগ থানায় যাই। সেখান থেকে ডিএনএ টেস্টের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এভাবে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাই ছেলের খোঁজে। পরবর্তীতে আমাকে ফোন দিয়ে জানানো হলো ডিএনএ টেস্টে শনাক্ত হয়েছে। তখন আমি মনে করেছি আমাকে আমার সন্তানের লাশ দিয়ে দিবে। কিন্তু সেটি হয়নি, শনাক্তকরণের একটা কাগজ দিয়েছে। আমার ছেলেকে আমি নীলফামারী দাফন করতে চাই। এখানে বেওয়ারিশ পরিচয়ে দাফন করেছে, সেটি আমি চাই না। এখন আমি কোথায় যাবো, কার কাছে গিয়ে বলবো সন্তানের কবর হস্তান্তরের কথা।
শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রাশেদুল আলম মানবজমিনকে বলেন, গত সোমবার জুরাইন কবরস্থানে দাফনকৃত ছয়টি লাশের মধ্যে একটির ডিএনএ নমুনা বাবা-মায়ের ডিএনএর নমুনার সঙ্গে মিলেছে। অন্য লাশগুলোর এখন পর্যন্ত কোনো স্বজনের খোঁজ মেলেনি বা কেউ দাবি নিয়ে আসেনি।