জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ৬ জনকে হত্যাসহ সংঘটিত মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষী হিসেবে তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যর জবানবন্দি চলমান। আইন অনুযায়ী তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যদান শেষে মামলাটির যুক্তিতর্ক শুরু হবে। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জানান, এই মামলায় তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যদান শেষে আসামির পক্ষে কয়েকজন সাফাই সাক্ষী দিবেন।
গত বছরের ৫ই আগস্ট চানখাঁরপুলে আন্দোলনরত নেতৃবৃন্দসহ মামলায় গ্রেপ্তার আসামিরা এই মামলায় সাফাই সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিতে পারেন বলে আসামিপক্ষের একাধিক আইনজীবী মানবজমিনকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এদিকে, মামলাটির তদন্তের সঙ্গে যুক্ত প্রসিকিউটর মো. সহিদুল ইসলাম সরদার বলেন, সাফাই সাক্ষী উপস্থাপন সম্পর্কে আসামিপক্ষ প্রসিকিউশন কিংবা ট্রাইব্যুনালকে কিছুই জানায়নি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন অনুযায়ী মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পরে আসামিপক্ষকে মামলার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য ৩ সপ্তাহ সময় দিতে হয়। এ সময় আসামিপক্ষে যদি কোনো সাক্ষীদের তালিকা (যদি থাকে), এবং যেসব নথি বা তার কপি ডিফেন্সে আনতে চায়, সেগুলো বিচার শুরু হওয়ার সময় ট্রাইব্যুনাল ও প্রসিকিউশন উভয়ের কাছে দাখিল করতে হবে। অতপর ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে বিচারকার্যের যেকোনো পর্যায়ে অতিরিক্ত সাক্ষী ডাকতে পারে বা অতিরিক্ত প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারে। কিন্তু যেহেতু তারা সে সময় কিছুই দাখিল করেনি কিংবা প্রসিকিউশন অথবা ট্রাইব্যুনালকে জানায়নি তাই এই মুহূর্তে মামলার আসামি ছাড়া অন্য কেউ সাফাই সাক্ষী দেয়ার সুযোগ নাই। এক্ষেত্রে আসামির বক্তব্য নিতে পারে আবার নাও নিতে পারে।
শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক ও মামলার আসামি আরশাদ হোসেন আইনজীবী সাদ্দাম হোসেন অভি মানবজমিনকে বলেন, প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আমার আসামি গুলির নির্দেশ দিয়েছে এমন কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত দেখাতে পারেনি। এ ছাড়া সেদিন আরশাদ ঊর্ধ্বতন অফিসারদের কমান্ডে ঘটনাস্থলে থাকলেও সে কোনো গুলির নির্দেশ দেয়নি। তিনি বলেন, ৫ই আগস্ট চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলন করেছেন এমন কয়েকজন আমার আসামির পক্ষে সাফাই সাক্ষী দিতে পারেন। তারা সেদিন আরশাদকে গুলি করতে দেখেছিল কিনা সেটি বর্ণনা করবেন। এ ছাড়া মামলায় আটক আসামি কিংবা পুলিশ সদস্যদের মধ্যে থেকেও সাফাই সাক্ষী দিতে পারেন। তারা আরশাদ গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিল কিনা তার ব্যাপারে সাক্ষী দিবেন। তিনি আরও বলেন, আরশাদ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও তিনি কোনো গুলি ছুড়েন নাই। এর পরবর্তী নির্ধারিত তারিখে আমরা সাফাই সাক্ষীর লিস্ট প্রসিকিউশনকে দিবো। অতঃপর তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যদান শেষে সাফাই সাক্ষী উপস্থাপন করবো।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, ট্রাইব্যুনালের আইন অনুযায়ী মামলার অভিযোগ দাখিলের পরে বিচার শুরু হওয়ার কমপক্ষে ৩ সপ্তাহ আগে প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষীদের একটি তালিকা দাখিল করবেন। যেসব সাক্ষীকে হাজির করা হবে উক্ত সাক্ষীদের রেকর্ডকৃত বয়ানের কপি বা অনুলিপি এবং যেসব নথির ওপর প্রসিকিউশন অভিযোগসমূহ সমর্থনের জন্য নির্ভর করতে চায়, সেগুলোর কপিও দাখিল করবেন। এটি আসামিপক্ষের আইনজীবীদেরকেও দেয়া হয়। একইভাবে ডিফেন্স থেকে যদি কোনো সাক্ষীকে হাজির করতে হয় তাহলে তার তালিকাও প্রসিকিউশনকে দিতে হবে। কিন্তু মামলার পর্যায়ে এসে আসামিপক্ষ সাক্ষী উপস্থাপন করতে চাইলে এটি ট্রাইব্যুনাল সিদ্ধান্ত নিবেন।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যবিধি, ২০১০ এর ৪৬ (এ) অনুযায়ী ন্যায়বিচারের স্বার্থে ট্রাইব্যুনাল যেকোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারেন। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা বা বিচারিক প্রক্রিয়ার অপব্যবহার প্রতিরোধের জন্য ট্রাইব্যুনাল প্রয়োজনীয় যেকোনো আদেশ প্রদান করতে পারেন। আসামিপক্ষ এখন পর্যন্ত প্রসিকিউশনকে কিছুই বলেনি। তারা সাফাই সাক্ষী দেয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করলে প্রসিকিউশন এই আবেদন পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিবেন বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, গত ২০শে এপ্রিল এই মামলায় ৮ জনকে অভিযুক্ত করে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। সেই প্রতিবেদন গত ২৫শে মে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিকভাবে দাখিল করা হয়। এরপর আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আমলে নিয়ে ও প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের মধ্যদিয়ে দিয়ে এ মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট চানখাঁরপুল এলাকায় শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমনে আগ্নেয়াস্ত্র, এপিসি কার, হেলিকপ্টার, ড্রোন ও বিপুল পরিমাণ বুলেট ব্যবহার করা হয়। পুলিশের এই অভিযানে নিহত হন শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদী হাসান জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া শাহরিক। এতে আরও বলা হয়, আসামি হাবিবুর রহমানসহ অন্য অভিযুক্তরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং অধীনস্থদের গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। তাদের সহযোগিতা ও নির্দেশেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে পলাতক রয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহ আলম ও মো. আখতারুল ইসলাম, রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল। এ ছাড়া মামলায় গ্রেপ্তার রয়েছেন- শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো. নাসিরুল ইসলাম।