ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩৭টিতে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। বাকি ৬৩টি ফাঁকা আসন ঘিরে বিএনপির দলীয় প্রার্থীসহ আন্দোলনের শরিক দলের প্রার্থীরা সমানতালে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। একদিকে মিত্রদলগুলোর সঙ্গে আসন ভাগাভাগির প্রতিশ্রুতি, অন্যদিকে দলীয় প্রার্থীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের আশঙ্কায় এখন পর্যন্ত সেগুলো ফাঁকাই রয়েছে। অন্তত ২৩ থেকে ২৫টি আসন মিত্রদের জন্য এবং বাকিগুলোতে দলীয় প্রার্থী দেবে দেশের বৃহত্তম এই রাজনৈতিক দলটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিত্রদলগুলোর আসন নিয়ে বিএনপিতে আলোচনা হয়েছে। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী নিবন্ধিত দল জোটবদ্ধ নির্বাচন করলে নিজস্ব প্রতীকে ভোট করতে হবে। এই জটিলতার কারণে মিত্রদের আসনগুলোও ঘোষণা করা হচ্ছে না। তবে তারা আশা করছেন চলতি মাসেই এই সমস্যার সমাধান হবে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, সমমনাদের সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়টি খুব তাড়াতাড়ি শেষ হবে। ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের আহ্বায়ক ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, নতুন আইন অনুযায়ী নিবন্ধিত দলকে নিজস্ব প্রতীকে ভোট করতে হবে। বিএনপি শরিকদের আসন ছাড় দিলেও গ্রামের মানুষ তা বুঝতে পারবে না। তারা চেনে ধানের শীষ, নৌকা ও দাঁড়িপাল্লা প্রতীক। শরিকদের অপরিচিত প্রতীক তারা চিনবে না। এই সমস্যা সমাধানে বিএনপির পক্ষ থেকে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আশা করা হচ্ছে চলতি মাসেই এর সুরাহা হবে। শরিকরাও ধানের শীষ প্রতীক নিয়েই ভোট করতে পারবেন।
জানা যায়, নির্বাচনে সম্ভাব্য আসন সমঝোতার প্রশ্নে আপাতত বিএনপির দিকেই তাকিয়ে আছেন সমমনা দল ও জোটের নেতারা। তারা বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। তবে একই আসনে বিএনপি ও সমমনাদের প্রচারণার কারণে কেউ কেউ হতাশ আবার অনেকে বিক্ষুব্ধ।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘এখনো চূড়ান্ত কিছু হয়নি। আগামী দুই থেকে চার দিনের মধ্যে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। এ বিষয়টি মীমাংসা হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।’
বিএনপির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ফাঁকাসহ ঘোষিত আসনগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে ঘোষিত কয়েকটি আসনেও পরিবর্তন আসতে পারে। এর ভিতরে বিএনপির দলীয় অনেকে মনোনয়ন পাবেন। বাকি আসনগুলো সমমনা দল ও জোটের নেতাদের দেওয়া হবে।
সমমনা দলের নেতাদের ভাষ্য, বিএনপির দলীয় মনোনয়ণ ঘোষণার পর গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বসেছিলেন। ওই সময় নির্বাচনে কীভাবে অংশগ্রহণ করবে এবং আসনের বিষয়ে বিএনপি নেতাদের কাছে তারা জানতে চান। এ বিষয়ে কোনো কিছু স্পষ্ট করা হয়নি। যদিও গণতন্ত্র মঞ্চ তাদের ৪৮ জনের সম্ভাব্য তালিকা দিয়েছিল। সর্বশেষ তারা মঞ্চের ৬ দলের ছয় শীর্ষ নেতার আসনের বিষয়ে জানতে চাইলে তা-ও পরিষ্কার করা হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা-১০ সংসদীয় আসনের ভোটার হওয়ার আবেদন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি এ আসনে নির্বাচন করতে চান। এখানে বিএনপি কাউকে মনোনয়ন দেয়নি। আসিফ এখানে বিএনপির সমর্থন পেতে পারেন বলে আলোচনা হচ্ছে।
ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, ‘সমমনা দলগুলোর জন্য আসন চূড়ান্ত না করায় সমস্যা হচ্ছে। নির্বাচনি এলাকায় বিএনপির প্রার্থীরা প্রচারণা চালাচ্ছেন। সমন্বয় করা যাচ্ছে না। আমরা আশা করব শিগগিরই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এই সমস্যার সমাধান এবং আন্দোলনের শরিকদের মূল্যায়ন করবেন।’
এর মধ্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ), গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ (বাঞ্ছারামপুর), রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম (কিশোরগঞ্জ-৫), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সহসভাপতি তানিয়া রব (লক্ষ্মীপুর-৪) আসনে নির্বাচন করতে চেয়েছেন। এসব আসনে বিএনপি এখন পর্যন্ত কোনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি। তবে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক (ঢাকা-৮) এবং ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু (জামালপুর-৫) আসনে নির্বাচন করতে চান। এই দুটি আসনে দলীয় প্রার্থী দিয়েছে বিএনপি। এ ছাড়া কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা নির্বাচন করতে চান।
এ ছাড়া সমমনা দল ও জোটদের মধ্যে জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার পিরোজপুর-১, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট অলি আহমদের ছেলে অধ্যাপক ওমর ফারুক চট্টগ্রাম-১৪ এবং মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা), বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ ঢাকা-১৭, বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম লক্ষ্মীপুর-১, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর পটুয়াখালী-৩, সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান ঝিনাইদহ-২, সিনিয়র সহসভাপতি ফারুক হাসান ঠাকুরগাঁও-২, এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ ঢাকা-১৩, এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ নড়াইল-২, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ঝালকাঠি-১ আসনে বিএনপির সমর্থন নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান। ওদিকে ঢাকায় ১৫টি আসনের মধ্যে ৯টিতে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে বিএনপি। ৬টি আসন ফাঁকা রেখেছে। এ ছাড়াও নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা জোটের ইসলামি দলগুলোর ১২ নেতা প্রার্থী হতে পারেন। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে গ্রিন সিগন্যালও দেওয়া হয়েছে। বিপ্লবীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গেও বিএনপির আসন সমঝোতা নিয়ে আলোচনার গুঞ্জন রয়েছে। তবে এ নিয়ে দুই দলের পক্ষ থেকে বিষয়টি স্বীকার করেনি। এদিকে নীলফামারী-১ আসনটি এখনো খালি রয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাগনে শাহরিন ইসলাম তুহিন ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মনজুরুল ইসলাম আফেন্দি এই আসনে মনোনয়ন চাইছেন। ফলে কাকে এই আসনের জন্য বেছে নেওয়া হবে, তা নির্ধারণে জটিলতার মধ্যে রয়েছে বিএনপি।
দলীয় সূত্র জানায়, শরিক দলের জমা দেওয়া প্রার্থী তালিকা পর্যালোচনা করে বিএনপি একটি শর্টলিস্ট তৈরি করেছে। এরপর স্থানীয় পর্যায়ে প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা, সাংগঠনিক অবস্থান, বিজয়ের সম্ভাবনা এবং মাঠপর্যায়ের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করা হচ্ছে।
বিএনপি নেতারা জানান, চলতি নভেম্বর মাসের মধ্যেই ফাঁকা ৬৩ আসনে দলীয় ও জোটের মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হবে। তফসিল ঘোষণার আগেই প্রার্থী তালিকা প্রকাশের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে দল। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শিগগিরই জোটের প্রধান নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করবেন। বৈঠকের আলোচনার ওপর নির্ভর করে জোট ও বিএনপির প্রার্থীর নাম একই সঙ্গে নাকি ধাপে ধাপে ঘোষণা করবে।