Image description
বাণিজ্য বন্ধের উপায়

৫ আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের পর শুরু হয়েছে নতুন বাংলাদেশের অভিযাত্রা। বৈষম্যমুক্ত এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার ডাক দেওয়া হয় গত বছরের ৫ আগস্টের পর। শান্তি ও সাম্যের এক দেশ গড়ার লক্ষ্যে সবক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। গঠিত হয় নানান সংস্কার কমিশন। কিন্তু নতুন বাংলাদেশে দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। দুর্নীতি চলছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে, আগের মতোই। গত দেড় বছরে পদায়ন বাণিজ্য অব্যাহত রয়েছে। এমনকি সচিব পর্যায়ে পদায়ন ও পদোন্নতির জন্য ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ডিসি নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে জনপ্রশাসন সচিব বদলি হয়েছেন। এই সময় বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর পদায়ন বাণিজ্যের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। যার কোনোটাই সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নাকচ করা হয়নি।

এই সময়ে সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি হয় জেলা প্রশাসক পদায়নের ক্ষেত্রে। শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রামের ডিসি পদায়ন নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে জনপ্রশাসন সচিব ও এপিডিকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর আগে গত বছরও তার বিরুদ্ধে বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছিল। ঘুষের চেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছিল। শুধু ডিসি নয়, উপদেষ্টা হওয়ার জন্য এক চিকিৎসক শতকোটি টাকার চেক দিয়েছিলেন। সচিব পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ পর্যন্ত উঠেছে।

গত দেড় বছরে পদায়ন ও বদলি বাণিজ্য আগের মতোই আছে। এই সময়ে চিকিৎসক, পুলিশ বাহিনীসহ বিভিন্ন পদে বদলি বাণিজ্যের খবর পাওয়া যায়। এ সময়ে ৩ হাজার মেডিকেল অফিসার ও ৫০০ কর্মচারীর চেয়ার রদবদল করা হয়েছে। এত স্বল্প সময়ে অতীতে এমন বদলি হয়নি অধিদপ্তরে। বদলি হওয়া অনেক চিকিৎসক জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কর্মস্থলে যোগ দেননি। নতুন করে উপজেলা পর্যায় থেকে আওয়ামী লীগপন্থি চিকিৎসকদের ঢাকায় আনা হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডে উপজেলা পর্যায়ে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। এই অস্বাভাবিক বদলিকে কেন্দ্র করে ড্যাব নেতা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর একটি চক্র অর্থ লেনদেন করেছে। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার করা এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটির অনুসন্ধানে অধিদপ্তরের চার কর্মকর্তা ও পাঁচ কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতা মিলেছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের পাশ কাটিয়ে ময়মনসিংহ, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও খুলনাসহ বিভিন্ন বিভাগে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলিতে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি তদন্ত করা এবং আসন্ন আমন সংগ্রহ অভিযানকে সামনে রেখে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়ন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।

গত ৩ নভেম্বর জারি করা আদেশে বলা হয়েছে, চলতি মৌসুমের আমন সংগ্রহ অভিযান নিরবচ্ছিন্ন ও সফলভাবে সম্পন্ন এবং লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের স্বার্থে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়ন স্থগিত থাকবে। এই সিদ্ধান্তের আওতায় এলএসডির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সিএসডির ব্যবস্থাপক এবং সাইলোসমূহের অধীক্ষকরাও অন্তর্ভুক্ত থাকবেন।

চট্টগ্রামে প্রধান বন সংরক্ষকের বিরুদ্ধে বদলি বাণিজ্যে ১০ কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মোল্লা রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়ে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। গত ৯ জানুয়ারি একযোগে ৭৭ জন বন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের তাদের পছন্দমতো জায়গায় বদলি করা হয়। প্রত্যেক বদলির জন্য লেনদেন হয় মোটা অঙ্কের টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় ১০ কোটি টাকা এ বদলি বাণিজ্যে লেনদেন করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

প্রায় ৭ শতাধিক সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষক, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দপ্তরের কর্মচারী ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার বদলি হয়েছে। এর মধ্যে একজন বেপরোয়া উপপরিচালকের ফারুক নামের কোটিপতি পিএর বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্যর অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিটি বদলির ৭০ ভাগ উপপরিচালকের ৩০ ভাগ ফারুকের।

জানা যায়, বিএনপি নেতা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের দোহাই দিয়ে করা বদলিগুলোর অধিকাংশই এই বদলি বাণিজ্য চক্রের। ফারুকসহ কয়েজন কর্মচারী ঘুষ বাণিজ্যে লিপ্ত থেকে একজন উপপরিচালককে সর্বাত্মক সহায়তা করছেন-এমন অভিযোগ শিক্ষা ক্যাডার সদস্য ও কর্মচারীদের মুখে মুখে।

বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে পুলিশ কর্মকর্তাদের পদায়নেও। গুরুত্বপূর্ণ থানার ওসি ও অন্য কর্মকর্তাদের বদলি এবং পদায়নে রাজনৈতিক সুপারিশের আড়ালে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। ওয়াশার এমডি পদেও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, পুরোনো রূপেই ফিরে এসেছে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য। কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশে দুর্নীতির উৎস হলো এটাই। নিয়োগ এবং বদলি বাণিজ্য বন্ধ না হলে দেশের মানুষ দুর্নীতি থেকে মুক্তি পাবে না।

অন্তর্র্বর্তী সরকার যেসব বিষয়ে সংস্কার কমিশন গঠন করেছে তার মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার অন্যতম। এই কমিশন ইতোমধ্যে একটি সুপারিশ দিয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুদক সংস্কার করলেই দুর্নীতি বন্ধ হবে না। তাদের মতে, দুর্নীতির উৎস বন্ধ না করতে পারলে দুর্নীতি দমন কমিশন যতই শক্তিশালী হোক না কেন তাতে লাভ হবে না। সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করতে হলে সবার আগে সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। আর সেটা করার জন্য নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। একজন সাব-রেজিস্ট্রার বা একজন পাসপোর্ট অফিসার যদি ঘুষ না দিয়ে একটি দায়িত্বে বসেন তাহলে তিনি জনগণকে সেবা দিতে উদ্যোগী হবেন। কিন্তু গত দেড় বছরে এই নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেই।