চব্বিশের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আজ। দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কোনো সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে এটিই প্রথম রায় হতে যাচ্ছে। এ মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে আইনে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ অভ্যুত্থানে আন্দোলনরত ১৪০০ মানুষকে হত্যা ও ২৫ হাজারের বেশি মানুষ আহত হওয়ার ঘটনায় করা এ মামলায় আনা অভিযোগ প্রমাণ হলে শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড হবে নাকি অন্য কোনো সাজা দেওয়া হবে? এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে সবার দৃষ্টি আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
শেখ হাসিনা ছাড়া তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার সময়ের সর্বশেষ পুলিশপ্রধান (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এ মামলায় আসামি। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক। গণ অভ্যুত্থানে পতনের পর তারা পালিয়ে গিয়ে ভারতে অবস্থান করছেন। আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বর্তমানে কারাগারে। তিনি দোষ স্বীকার করে হয়েছেন রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার)। রাজসাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যও দিয়েছেন সাবেক এই আইজি।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় ঘোষণা করবেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। গত ২৩ অক্টোবর প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের আইনি যুক্তিতর্ক শেষ হলে এ মামলার রায় ঘোষণার তারিখ জানানোর জন্য ১৩ নভেম্বর দিন রাখেন ট্রাইব্যুনাল। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৩ নভেম্বর রায় ঘোষণার জন্য আজকের এই দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। এ রায় ঘোষণা সরাসরি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। প্রসিকিউশন জানিয়েছে, বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম সরাসরি সম্প্রচারের সুযোগ পাবে।
আজকের এ রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারাধীন মামলাগুলোর মধ্যে প্রথম কোনো মামলার বিচারকাজ শেষ হতে যাচ্ছে। রায়ে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চাওয়ার পাশাপাশি ট্রাইব্যুনালের কাছে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের আদেশ চাওয়া হয়েছে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে। আর এ দুই আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন তাদের বেকসুর খালাস চেয়েছেন।
এদিকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় মিছিল করেছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। গতকাল দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনের সামনে থেকে মিছিলটি হাই কোর্টের অ্যানেক্স ভবনে গিয়ে ঘুরে আবার সমিতি ভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়।
মামলার বিবরণ : গত বছরের ৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। এরপর চলতি বছরের ২৫ মে থেকে ৮ অক্টোবরের মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে যেসব মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে, তার মধ্যে জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলা আটটি। এর মধ্যে পাঁচটি মামলায় অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেছেন ট্রাইব্যুনাল। বিচারাধীন পাঁচটি মামলার মধ্যে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে এ মামলাটি ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় মামলা।
রক্তক্ষয়ী লাগাতার আন্দোলনে গত বছর ৫ আগস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের। এরপর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী সরকার। অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে দাবি করে অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা দেয়, এ অপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা হবে। ঘোষণা অনুযায়ী পরে ট্রাইব্যুনাল, প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গত বছর ১৭ অক্টোবর দুই মামলার বিষয়ে প্রথম শুনানি হয়। সেদিন প্রসিকিউশনের আবেদনে ট্রাইব্যুনাল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ এই ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। তার আগে গত বছর ১৪ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দাখিল করা হয়। তদন্ত শুরু হয় গত বছর ১৪ অক্টোবর। ছয় মাস ২৮ দিনে তদন্ত শেষ করে এ বছর ১২ মে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। আসামিদের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলি (ঊর্ধ্বতনের নির্দেশনার দায়), হত্যা, হত্যাচেষ্টা, ব্যাপক মাত্রায় পদ্ধতিগত হত্যা, অপরাধে প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ, সংঘটিত অপরাধ প্রতিহত না করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়।
গত ১ জুন প্রসিকিউশন ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ দাখিল করলে তা আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানকে আত্মসমর্পণ করতে ১৬ জুন সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়। পরদিন সেই বিজ্ঞপ্তি দুটি জাতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। আত্মসমর্পণ না করায় তাদের পলাতক দেখিয়ে গত ১০ জুলাই মামলার অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। তাদের পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী মো. আমির হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওইদিন গ্রেপ্তার আসামি সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এ মামলার রাজসাক্ষী হতে ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন করেন। পরে তার আবেদন মঞ্জুর করা হয়। গত ৩ আগস্ট চিফ প্রসিকিউটরের সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিচারকাজ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাক্ষ্য দেন এ মামলায়। রাজসাক্ষী হিসেবে গত ২ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য দেন আসামি চৌধুরী মামুন। গত ৮ অক্টোবর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলে ১২ অক্টোবর থেকে শুরু হয় যুক্তিতর্ক। টানা পাঁচ দিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। গত ১৬ অক্টোবর প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক শেষ হলে ২০ অক্টোবর থেকে আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শুরু হয়। রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন টানা তিন দিন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। সেই ধারাবাহিকতায় গত ২৩ অক্টোবর পাল্টা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে দুই পক্ষই। তার আগে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান ট্রাইব্যুনালে সমাপনী বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
রায় সরাসরি সম্প্রচার করা হবে : সাবেক সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ মামলার বিচারকাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের ফেসবুক পেজে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় মামলার রায় ঘোষণার অংশবিশেষও আজকে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে বলে জানিয়েছে প্রসিকিউশন।
গতকাল সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে এক ব্রিফিংয়ে প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীম সাংবাদিকদের বলেন, এ মামলার স্পেশাল প্রসেডিংসগুলো (বিশেষ কার্যধারা বা বিচারকাজের বিশেষ অংশ) আমরা ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে সরাসরি সম্প্রচার করেছি। আগামীকাল (আজ) রায়ের যে অংশটুকু ট্রাইব্যুনাল পড়ে শোনাবেন, সে অংশটুকুও ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করবে। আর বাংলাদেশ টেলিভিশনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ যে কয়েকটি সংস্থা আছে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে এ দেশের সব গণমাধ্যম সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে।
খালাস চায় আসামিপক্ষ : এদিকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেনি দাবি করে এ দুই আসামির খালাস চেয়েছেন তাদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন।
তিনি বলেন, প্রসিকিউশন উপস্থাপিত তথ্যপ্রমাণের মাধ্যমে আনীত অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। সাক্ষীদের বক্তব্যেও অভিযোগ প্রমাণ হয় না। তাই আমি মনে করি, আমার ক্লায়েন্টরা খালাস পাবেন। আমি আদালতেও আমার যুক্তিতর্কে এ বক্তব্য রেখেছি। গতকাল আইনজীবী আমির হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব কথা বলেন।