Image description

ফাহিম খুনের পর আতঙ্ক বালুচরে। এর পেছনে শুধু নাম একটাই- সন্ত্রাসী মাইল্যা। পুরো নাম আলী হোসেন। ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী। বলা হয়- ‘হেলিচুয়্যাল ক্রাইমার’। এমন কোনো অপরাধ নেই যেটির সঙ্গে সে জড়িত নয়। শেল্টার অদৃশ্য। আর এই শেল্টারেই মাইল্যা হয়ে উঠেছে মূর্তিমান আতঙ্ক। বালুচরের অপরাধ গলি ২ নম্বর মসজিদের পাশে ১০ই নভেম্বর সশস্ত্র অবস্থায় হামলা চালানো হয়েছে ফাহিম আহমদের ওপর। ১২ই নভেম্বর ফাহিম মারা যায়। কিন্তুখুনের ঘোষণা আসে আগেই। মাইল্যার অন্যতম সহযোগী বাগানি দুলন গোমেজের বোন রানী গোমেজ। একদিন আগেই তিনি একটি ভিডিও বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি জানান, ‘মাইল্যা বলেছে; সে একটি খুন করবে।’ ফাহিম মার্ডারের পর এই ভিডিও এখন সিলেটে ভাইরাল। ঘোষণা দিয়ে ফাহিমকে খুন করেছে মাইল্যা। তবে, তার আগেই তার ভাইয়ের অপরাধের জন্য সবার কাছে ক্ষমা চান রানী গোমেজ। এলাকার মানুষ বলছে, মাইল্যা এক ভয়ঙ্কর অপরাধী। তার পিতা কাদির মিয়ার বাড়ি কুমিল্লার নাসির নগরে। 

নব্বই দশকে স্ত্রীকে নিয়ে তিনি সিলেটে আসেন। তখন বালুচর শহরতলী। বাগান এলাকা। ওখানে কলোনিতে ভাড়া বাসায় থাকেন। বাগান থেকে কাঠ কেটে বিক্রি করতেন শাহী ঈদগাহের কাঠ বাজারে। বালুচরে বসবাসের সময়ই জন্ম নেয় মাইল্যা। স্কুলের গণ্ডি পেরোইনি। বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে অপরাধে। জোনাকি এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা মানবজমিনকে জানিয়েছেন, মাইল্যার পরিবারও ছিল মাদক ব্যবসায়ী। তখন গাঁজা বিক্রি করতো তারা। আর তা দেখে দেখেই মাইল্যা বড় হতে থাকে। বড় হওয়ার পর সে কিশোর গ্যাংয়ের গডফাদার হয়ে ওঠে। কয়েকজন লন্ডন প্রবাসী নিজেদের জায়গা-জমি দখলমুক্ত রাখতে মাইল্যাকে ব্যবহার করেন। এতে করে মাইল্যা এলাকায় শক্তি পায়। এখন তার বয়স ৩৫ বছর। কিন্তু ১৫ বছর বয়স থেকেই অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশ জানিয়েছে, মাইল্যা ভয়ঙ্কর অপরাধী। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। মামলার সংখ্যা ১৫-১৬টি হবে। নগরের শাহী ঈদগাহ্‌ এলাকা থেকে ব্র্যাক ব্যাংকের পাঁচ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনার মূলহোতা সে। এ মামলায় সে সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়ে কারাবরণ করেছে। ছয়-সাতটি ছিনতাই মামলার আসামি সে। রয়েছে সিএনজি দিয়ে ডাকাতির মামলাও। 

এদিকে, বালুচরে প্রায় সময়ই বহিরাগত ডাকাতরা হানা দেয়। স্থানীয় শেল্টারদাতা হিসেবে থাকে মাইল্যা। সবাই জানেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ দেয়ার সাহস পান না। মাইল্যার মূল আস্তানা বালুচরের জোনাকি আবাসিক এলাকার ক্লাবের ভেতরে আবুল ও মাসুকের দোকান। সেখানেই সহযোগীদের নিয়ে বসে। নিয়ন্ত্রণ করে পুরো এলাকা। মাদক বিক্রির ওপেন হাটও ওই এলাকা। মাইল্যার সহযোগীদের মধ্যে রয়েছে তারই চাচাতো ভাই সন্ত্রাসী জাহাঙ্গীর, শাকিল, একটি মামলায় আট বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি বিল্লাল, বাগানি দীপন দাশ, রশিদ ওরফে চোরা রশিদ, সোহেল, জাহাঙ্গীর (২), কালা মিয়া ও দোলন গোমেজ। এর বাইরে ২০ থেকে ২৫ জনের তার একটি চক্র রয়েছে। বছর খানেক আগে এক সেনা সদস্যের ভাইয়ের ওপর মাইল্যার নেতৃত্বে হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় থানায় মামলা করা হয়েছে। মাইল্যার বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ থানায় দিয়েছিলেন বালুচরের বাসিন্দা আলাউদ্দিন। তার কাছে মাইল্যা ও তার গ্রুপের সদস্যরা দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল। আলাউদ্দিন জানান, মাইল্যার বিরুদ্ধে জমি দখলের ২০ থেকে ২৫টি অভিযোগ রয়েছে। জোনাকি আবাসিক এলাকার যে বাসায় মাইল্যা বসবাস করেন, সেই বাসার মালিক টিলাগড়ের বাসিন্দা খসরু আহমদের প্রবাসী বোন। বাসাটির দেখভাল করেন খসরু আহমদ। 

বিগত চার বছর ধরে মাইল্যা বাসার কোনো ভাড়া না দিয়ে কলোনির অন্য বাসার ভাড়া তুলে নেয়। এর প্রতিবাদ করায় উল্টো খসরুর কাছে চাওয়া হয় ১০ লাখ টাকা চাঁদা। বালুচর ছিল টিলাময় ভূমি। জোনাকি, আল ইসলাহ, সোনাবাংলা সহ কয়েকটি এলাকায় অবাধে টিলা কাটা হয় মাইল্যার নেতৃত্বে। মধ্যরাতে শুরু হয় টিলা কাটা। চলে ভোর পর্যন্ত। দিনে প্রশাসনের কর্মকর্তারা গেলে ভয়ে তাদের কাছে মাইল্যার নাম বলে না স্থানীয়রা। পাশেই চা বাগান। মাইল্যার চোখ রাঙানিতে থাকে বাগানিরা। সব অত্যাচার বাগানিরা মুখ বুঝে সয়ে যাচ্ছেন। বাগানের বাসিন্দা দোলন গোমেজকে কৌশলে সঙ্গে রেখে সে কুলিদের নানাভাবে ব্যবহার করে। বালুচর, টিবি গেইট, শাহী ঈদগাহ এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গণ-অভ্যুত্থানের আগে ওই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতো সাবেক কাউন্সিলর নীপু’র সহযোগীরা। ওই সময় ঘটেছিল ছাত্রলীগ কর্মী আরিফ হত্যা। পরে সেটি দখলে নেয় নুরুজ্জামান, মাইল্যা, মাদক বিক্রেতা আলম। এরপর থেকে ওই এলাকায় প্রতিদিনই ছিনতাই সহ নানা ঘটনা ঘটে। ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে গোটা এলাকা। সন্ধ্যা হলেই গোটা শহরের মাদকসেবীরা ভিড় জমায় বালুচরে। 

বাইল্যার সেকেন্ড ইন কমান্ড আলম মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। রাত হলেই ইয়াবার অন্যতম হাট বসে ওখানে। সর্বশেষ মাইল্যা ও আলমের নেতৃত্বে খুন করা হলো ফাহিমকে। ফাহিম হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহপরান থানার এসআই সুব্রত দাশ মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ফাহিমের ওপর হামলার পর অপরাধীদের ভিডিও ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ায় তারা গা-ঢাকা দিয়েছে। এ কারণে মামলা দায়েরের পর অভিযান চালালেও মাইল্যা ও তার সহযোগীদের পাওয়া যায়নি। একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পালিয়ে যাওয়া আসামিরা যাতে গ্রেপ্তার হয়, সে ব্যাপারে পুলিশ সক্রিয় রয়েছে। এদিকে, বালুচরে সাম্প্রতিক ঘটনায় ক্ষুব্ধ এলাকার মানুষ। তারা অপরাধমুক্ত এলাকা চায়। ইতিমধ্যে তারা কয়েকটি বৈঠক করে কিছু দাবিও তুলেছে। ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর প্রার্থী ও সাংবাদিক বদরুর রহমান বাবর জানিয়েছেন, আমরা এলাকায় শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে আপাতত একটি পুলিশ ক্যাম্প চাই। পুলিশ সার্বক্ষণিক থাকলে মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক বিরাজ করছে, সেটি কেটে যাবে এবং দ্রুতই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।