ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ৩ মাস বাকি। ১৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি এখন পুরোদমে নির্বাচনের পথে। ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে নানামুখী কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দলটি। এরই অংশ হিসেবে দলের সব কর্মসূচি এখন নির্বাচনমুখী। হাইকমান্ডের নির্দেশে কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা নিজ নিজ সংসদীয় এলাকায় নির্বচনকেন্দ্রিক কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে।
এদিকে নভেম্বরের মধ্যে সারাদেশের প্রতিটি সংসদীয় আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করার টার্গেট নিয়ে কাজ করলেও এখনো তা করতে পারেনি বিএনপি। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫০ আসনে প্রার্থী ঠিক করে তাদের নির্বাচনের জন্য মাঠে সক্রিয় থাকার সবুজ সংকেত দিলেও বাকি অর্ধেক আসন নিয়ে চিন্তিত বিএনপি। একই আসনে বেশ ক’জন যোগ্য প্রার্থী মাঠে সক্রিয় থাকায় কাকে রেখে কাকে প্রার্থী করবে এ নিয়ে ভেবে কূল পাচ্ছেন না দলীয় হাইকমান্ড।
সূত্র মতে, সকল আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করতে সম্প্রতি ১০ সাংগঠনিক বিভাগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর আবারও নতুন করে হিসেবনিকেশ শুরু করেছে বিএনপি হাইকমান্ড। বাকি ১৫০ আসনে কাদের মনোনয়ন দেওয়া যায় এ নিয়ে চলছে চুলচেড়া বিশ্লেষণ। তবে এ ১৫০ আসনের মধ্যে ৪০টির মতো আসন শরিক দলগুলোকে ছাড়তে হবে বিধায় এখানেও কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। কারণ, যে ৪০টি আসন ছাড়া হবে সেখানের বিএনপি নেতাদের মধ্যে যারা দীর্ঘদিন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা নাখোশ হতে পারেন।
সূত্র জানায়, দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা এখন নির্বাচনকেন্দ্রিক বিভিন্ন কর্মসূচি পালনে ব্যস্ত। একদিকে সারাদেশের সকল-জেলা-উপজেলা ও মহানগরে সভা-সমাবেশ করে দলকে চাঙ্গা করার পাশাপাশি দলের পক্ষে নির্বাচনী জোয়ার সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। অপরদিকে সংসদীয় এলাকাগুলোতে গণসংযোগ কর্মসূচি জোরদার করা হচ্ছে। প্রতি ২০টি সংসদীয় এলাকার নির্বাচনী কার্যক্রম তদারকির জন্য একজন করে কেন্দ্রীয় নেতাকে বিশেষভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দায়িত্ব প্রাপ্ত নেতাকে প্রতিনিয়ত দলীয় হাইকমান্ডের কাছে সংসদীয় এলাকার সার্বিক অবস্থা সম্পর্কিত রিপোর্ট পাঠাতে বলা হয়েছে। ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে যেখানে যেভাবে হাইকমান্ডের সহযোগিতা প্রয়োজন তা করার প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর বেশি সময় বাকি নেই। তাই দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা এখন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। বিএনপির সকল কর্মকাণ্ড এখন নির্বাচনমুখী। জনগণের মন জয় করে নির্বাচনে বিজয়ী হতে বিএনপি নেতাকর্মীরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, ১৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দল বিএনপির জন্য এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুবর্ণ সুযোগ। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এ সুযোগ কাজে না লাগাতে পারলে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে বড় ধরণের ধাক্কা খাবে। আর যদি এবারের নির্বাচনে বিএনপিকে ধাক্কা খেতে হয় তাহলে আবার ঘুরে দাঁড়াতে বহু সময়ের প্রয়োজন হবে। আর এ কারণেই বিএনপি হাইকমান্ডসহ দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছে।
ছাত্রজনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই বিএনপি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে। আর এ বছরের শুরুতেই জাঁকজমকভাবে দলের বর্ধিত সভা করে সারাদেশের সর্বস্তরের নেতাদের কাছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করার বার্তা দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেন, নির্বাচনকে সামনে কেন্দ্র থেকে দলের যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে তা দলীয় নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থেকে সফল করতে হবে। এর পর সারাদেশের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা নির্বাচনের প্রস্তুতিতে মনোযোগ দেয়।
এক পর্যায়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা দিলে এবং নির্বাচন কমিশন এ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করলে বিএনপি নেতাকর্মীরা ভোটের প্রস্তুতি আরও জোরালো করতে থাকে। আর জুলাই সনদ তৈরি করার আগে বেশ কিছু বিষয়ে বিএনপির আপত্তি থাকলেও শেষ পর্যন্ত দ্রুত নির্বাচনের স্বার্থে অনেক কিছু ছাড় দিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের তৈরি করা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে বিএনপি। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দেওয়া ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে থাকা কয়েক বিষয়ে বিএনপি আপত্তি জানিয়ে এগুলো নির্বাচনের পথে বাধা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে। তবে অতিসম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগেই নির্বাচন হবে। সরকারের এ অবস্থান প্রকাশ করার পর বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি আরও জোরদার করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
জানা যায়, বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা এখন সারাদেশের সকল জেলা, উপজেলা ও মহানগরে সভা-সমাবেশের পাশাপাশি দলীয় ৩১ দফা সংস্কার সংবলিত লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালনে ব্যস্ত রয়েছে। যে সব সংসদীয় এলাকায় প্রার্থী ঠিক করে হাইকমান্ড সবুজ সংকেত দিয়েছে সেসব এলাকায় ওই প্রার্থীর জন্য ধানের শীষে ভোট প্রার্থনা করছে সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। আর যেসব সংসদীয় এলাকায় এখনো প্রার্থী ঠিক করা হয়নি সেখানে কারো জন্য সরাসরি ভোট না চেয়ে বিএনপির পক্ষে ধানের শীষে ভোট চাচ্ছে। সেই সঙ্গে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দেশ এবং সংসদীয় এলাকার জন্য কি কি করবে তা জনসম্মুখে প্রচার করা হচ্ছে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি হাইকমান্ড সকল মনোনয়ন প্রত্যাশীসহ সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের দলের ঐক্য ধরে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। কেউ যেন কোনো বিশৃঙ্খলায় না জড়ায় সে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে। আর যাকে যে সংসদীয় আসনে প্রার্থী করা হবে তার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। এর মাধ্যমে দলের বিজয় নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু নির্বাচনের সময় কেউ দলের বিরুদ্ধে কোনো কর্মকাণ্ডে জড়ালে তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন অপপ্রচার থেকে মুক্ত থাকতে কৌশল ঠিক করেছেন বিএনপি হাইকমান্ড। নির্বাচনকালে কোনো সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচারের কোনো তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার কাউন্টার দেবে বিএনপি। এ জন্য কিছু প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগ করা হচ্ছে। এ ছাড়া সংবাদ মাধ্যমে যাতে কোনো অপপ্রচার না হয় সে জন্য দলের একটি টিম সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখবে। এই টিমের সদস্যরা দেশে-বিদেশে বিএনপির পক্ষে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। এ ছাড়া দলের যেসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে অভিযোগ আসছে দ্রুত তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই প্রায় ৭ হাজার নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অপপ্রচার রোধে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিও নজরদারি রাখছে বিএনপি।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় হয়। তাই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এ জন্যই দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করতে মাঠে অধিক সক্রিয় রয়েছে। আর কোনো কারণে এ সময়ের মধ্যে সংসদ নির্বাচন না হলে দেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার বিষটি অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। তাই এ নির্বাচনের বিষয়ে সরকারকে চাপে রাখার পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে বিএনপির পক্ষ থেকে।
উল্লেখ্য, ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছে বিএনপি। বর্তমানে বিএনপির চেয়ারম্যান বেগম খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দীর্ঘদিন লন্ডনে অবস্থান করছেন। তবে তিনি লন্ডনে থাকলেও দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে ও দিক নির্দেশনা দিয়ে দলকে এগিয়ে নিচ্ছেন। নির্বাচনের সময় এগিয়ে এলে তিনিও দেশে ফিরে আসবেন এবং তার নেতৃত্বেই দলের নির্বাচন কার্যক্রম পরিচালিত হবে।