Image description

বিএনপি দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। তাদের প্রতিটি আসনে একাধিক যোগ্য প্রার্থী রয়েছে। এমনকি অনেক আসনে পাঁচ-ছয়জন থেকে শুরু করে ১০-১২ জন পর্যন্ত প্রার্থী মাঠে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এতে ওই এলাকার বিএনপির নেতা-কর্মী, সমর্থক ও ভোটাররাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছেন।

তাই আসনওয়ারি প্রার্থী নির্ধারণে চূড়ান্ত নির্দেশনা দিয়েছে বিএনপি, যাতে দলের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে সবাই একযোগে কাজ করে ধানের শীষকে বিজয়ী করতে পারেন। বিভিন্ন বিভাগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে চূড়ান্ত বৈঠকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। দল যাঁকেই মনোয়ন দিক না কেন, তাঁর পক্ষে কাজ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।

গতকাল রবিবার রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের সাংগঠনিক পাঁচ বিভাগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে বৈঠক হয়। বিভাগগুলো হলো চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও কুমিল্লা। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সভাপতিত্ব করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সঞ্চালনা করেন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবীর রিজভী।

আজ সোমবার দলের বাকি পাঁচ সাংগাঠনিক বিভাগ ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে বৈঠক করবেন তারেক রহমান।

বিএনপি সূত্র জানায়, প্রতিটি আসনেই একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকায় কে বেশি জনপ্রিয় তা নির্ধারণে হিমশিম খেতে হচ্ছে দলের শীর্ষ নেতাদের। একাধিক টিমের (জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা) মাধ্যমে জরিপের পাশাপাশি সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে দলটি। প্রথমে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাংগাঠনিক সম্পাদকরা সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে বসেছেন। এরপর দলের মহাসচিব বিভিন্ন এলাকার প্রার্থীদের সঙ্গে বসছেন। এখন চূড়ান্তভাবে বসছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। 

বিএনপির গুলশান কার্যালয় সূত্র জানায়, চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের নিচতলার কনফারেন্স রুম ও কার্যালয়ের পেছনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বসার ব্যবস্থা করা হয়। সামনে দেওয়া হয় বড় এলইডি মনিটর। যেখান থেকে সরাসরি যাতে তারেক রহমান সভায় অংশ নেওয়া মনোনয়নপ্রত্যাশীদের দেখতে পান।

গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের সামনের ও পাশের সড়কে অবস্থান করছেন মনোনয়নপ্রত্যাশী ও তাঁদের সমর্থকরা। এমনকি সড়কে দাঁড়ানোর জায়গা না পাওয়ায় কার্যালয়ের সামনে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ পার্কের ভেতরে অপেক্ষা করছেন সমর্থকরা।

বৈঠক শেষে গত রাতে বিএনপির কুমিল্লা বিভাগীয় সাংগাঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দল যাকেই মনোনয়ন দিক, তার পক্ষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছেন তারেক রহমান। সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। কোনো বিভেদ সৃষ্টি করা যাবে না বলে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর কেউ সহযোগিতা না করলে তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানানো হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়, এই বৈঠকটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারেন।’

সভায় অংশ নেওয়া একাধিক প্রার্থী জানান, তাঁদের ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেন কেউ না যান, সে ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এলাকার মানুষের সঙ্গে কিভাবে আরো সম্পৃক্ত হওয়া যায় সে ব্যাপারেও নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এমনকি মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়া পর্যন্ত কিভাবে কাজ করতে হবে সে ব্যাপারেও গাইডলাইন দেওয়া হয়।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির উপজাতি বিষয়ক সম্পাদক কর্নেল (অব.) মনীষ দেওয়ান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাঙামাটি থেকে এসেছি। আমাদের প্রতি দলের বার্তা, যাঁকেই নমিনেশন দেওয়া হোক তাঁর পেছনেই আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়ব। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।’

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম-১৩ আসনে আমাদের সাতজনকে ডাকা হয়েছে। দল যাঁকে মনোনয়ন দেবে, তাঁর পক্ষেই কাজ করতে হবে বলে আমাদের বার্তা দেওয়া হয়েছে। সবার একটাই মার্কা, ধানের শীষ।’

জানা যায়, অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে প্রায় এক মাস সারা দেশের বিভিন্ন আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ডেকে এনে কথা বলেন দলের স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য। তাঁর মধ্যে ছিলেন ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমদসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকরা।

সম্প্রতি সিলেট বিভাগ ও বগুড়া জেলার মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে পৃথকভাবে বৈঠক করেন। বৈঠকে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের অনেকে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড মহাসচিবের কাছে উপস্থাপন করেন। বিএনপি মহাসচিব বৈঠকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কিছু বার্তা মনোনয়নপ্রত্যাশীদের জানিয়ে দেন। তিনি বলেছেন, একাধিক জরিপের মাধ্যমে দল সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রার্থীকেই বাছাই করবে। সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য নেতাকেই দল মনোনয়ন দেবে। কেউ যদি দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করেন, তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মোট কথা, সবাইকে ধানের শীষের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গত শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘চলতি মাসের মধ্যেই বিএনপির পক্ষ থেকে প্রায় ২০০ আসনের সম্ভাব্য একক প্রার্থীকে গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হবে। সেই প্রক্রিয়ায় আছে বিএনপি, যাতে নির্বাচনী মাঠে প্রার্থী হিসেবে তাঁরা কাজ করতে পারেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা সমঝোতা ও আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে একক প্রার্থী নির্ধারণ করতে পারব। এর পরও যদি কেউ দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে, তাহলে সাংগঠনিকভাবে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা নেওয়া হবে।’

জানা যায়, জামায়াতে ইসলামী এরই মধ্যে ৩০০ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করেছে এবং পুরোদমে তাদের প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় প্রচারণা চালাচ্ছেন। অন্যদিকে দেশের সর্ববৃহৎ ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপি এখনো প্রার্থী চূড়ান্ত করতে পারেনি। দল কোনো কোনো প্রার্থীকে গ্রিন সিগন্যাল দিলেও প্রতিটি নির্বাচনী আসনেই প্রচার-প্রচারণা ও কাজ করে যাচ্ছেন একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী। বিএনপি এসব প্রার্থীর মধ্য থেকে বিগত দিনে আন্দোলন-সংগ্রামে ত্যাগী, নেতাকর্মী ও জনগণের কাছে জনপ্রিয় প্রার্থীদের তালিকা করছে। জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে, এমন প্রার্থীদেরই এবার মনোনয়ন দিতে চায় দলটি।

দলের স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানান, প্রতিটি আসনে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীকে প্রতিযোগিতাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে দলটি। তবে তাঁদের মধ্য থেকে বিগত দেড় দশকের আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই-সংগ্রামে যাঁরা হামলা, মামলা, নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, স্থানীয় নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন এবং ভোটারদের কাছে যাঁর গ্রহণযোগ্যতা বেশি রয়েছে, এমন প্রার্থীকেই মনোনয়ন দিতে চান শীর্ষ নেতারা। এ লক্ষ্যে দলের বাইরে একাধিক টিম গঠন করে প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেই তথ্য এবং দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনার অভিজ্ঞতার আলোকে প্রতিটি আসনে প্রাথমিক প্রার্থী চূড়ান্ত করছেন তিনি।