চট্টগ্রামে মধ্যরাতে মব সৃষ্টি করে এক ব্যক্তিকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। শুক্রবার রাতে চান্দগাঁও থানাধীন পাঠানিয়াগোদা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। রাতে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার পর শনিবার তাকে মামলা থেকে রেহাই দেওয়ার কথা বলে পরিবারের কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। কিন্তু চাঁদার টাকা না পাওয়ায় তুলে দেওয়া হয় পুলিশের হাতে। অগত্যা হতভাগ্য নিরাপরাধ ব্যক্তিকে যেতে হলো কারাগারে।
ভুক্তভোগী ব্যক্তির নাম আনিসুর রহমান। তিনি চান্দগাঁও থানাধীন পাঠানিয়াগোদা এলাকার আবদুস সাত্তারের ছেলে। একটি বেসরকারি কোম্পানিতে ব্যবস্থাপক হিসাবে চাকরি করেন। গ্রেফতারের পেছনে অন্যতম কারণ চাঁদার টাকা না দেওয়া। এনসিপির যুব সংগঠন যুবশক্তি চট্টগ্রাম মহানগর শাখার যুগ্ম সদস্য সচিব মোহাম্মদ সজীব ভুঁইয়ার নেতৃত্বে মব সৃষ্টি করে তাকে পুলিশে তুলে দেওয়া হয়। তথ্য-প্রমাণসহ যুগান্তরের কাছে এমন অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীর পরিবারসহ প্রত্যক্ষদর্শীরা।
সূত্র জানায়, গত শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে চান্দগাঁও থানাধীন পাঠানিয়াগোদা এলাকায় আনিসুর রহমানের বাড়ির সামনে জড়ো হন এনসিপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। তারা সেখানে গিয়ে আনিসুর রহমানকে খুঁজতে থাকেন। পরিবারের সদস্যদের ভয়ভীতি ও হুমকি-ধামকি দিয়ে আনিসকে তাদের হাতে তুলে দিতে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়। তারা যখন এভাবে মব সৃষ্টি করে হট্টগোল করছিলেন তখন হৃদরোগে আক্রান্ত আনিস ঘুমিয়ে ছিলেন। এক পর্যায়ে তারা পরিবারের সদস্যদের ধাক্কা দিয়ে জোরপূর্বক ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র তছনছ করে এবং ঘুমন্ত আনিসকে টেনেহিঁচড়ে তুলে নিয়ে আসেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আনিসের পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। জোরপূর্বক আনিসকে তুলে নেওয়ার সময় পরিবারের সদস্যরা বাধা দিলে উপস্থিত এনসিপির কয়েকজন সদস্য পুলিশকে ফোন করে দ্রুত আসতে বলেন।
এদিকে এক ঘণ্টা তাণ্ডব চালানোর পর রাত সাড়ে ১২টার দিকে চান্দগাঁও থানার ওসি জাহেদুল কবিরের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে আসে। এ সময় আনিসকে আওয়ামী লীগের দোসর উল্লেখ করে পুলিশের হাতে তুলে দেন এনসিপি নেতারা। পরে পুলিশ বাধ্য হয়ে তাকে থানায় নিয়ে আসে। এ সময় সেখানে এনসিপি নেতা সজীব ভুঁইয়ার নেতৃত্বে দিনার, ইকবাল ও মাহাবুব কবিরসহ ৮-১০ জন উপস্থিত ছিলেন।
আনিসের স্ত্রী কলেজ শিক্ষিকা বিবি মরিয়ম যুগান্তরকে বলেন, তার স্বামী একজন হার্টের রোগী। তার হার্টে তিনটি রিং পরানো। একসময় রাজনীতি করলেও দীর্ঘদিন থেকে তিনি নিষ্ক্রিয়। তার বিরুদ্ধে কোথাও কোনো মামলা নেই। এসব কিছু বলার পরও ঘটনাস্থলে উপস্থিত এনসিপি নেতা বা পুলিশ কেউ তাদের কথা শোনেননি। তার অসুস্থ স্বামীকে মধ্যরাতে তুলে নিয়ে যায়। এমনকি পরদিন একটি হত্যা ও বিস্ফোরক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ভুক্তভোগীর পরিবার ও স্থানীয় সূত্র একাধিক সূত্র জানায়, মূলত এনসিপি নেতারা টাকা আদায়ের জন্যই এভাবে মব সৃষ্টি করে। তারা সে ধরনের ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন ঘটনার রাতে। টাকার জন্য এক ঘণ্টা সময়ও নিয়েছেন। কিন্তু পরিবারের পক্ষ থেকে সাড়া না পাওয়ায় তারা পুলিশ ডেকে আনিসকে তুলে দেন।
এদিকে কারাগারে পাঠানোর আগে পরদিন শনিবার এনসিপির লোকজন মুখ ফুটেই আনিসুর রহমানের পরিবারের এক প্রতিনিধিকে প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ১০ লাখ টাকা দিলে আনিসকে মামলা থেকে রেহাই দিয়ে ছেড়ে দিতে বলা হবে। এতে রাজি না হওয়ায় এক পর্যায়ে এনসিপি নেতারা চার লাখ টাকা কমিয়ে ছয় লাখ টাকা দিতে চাপ দেন। তবে কোনো টাকা দিতে অস্বীকার করায় শেষ পর্যন্ত আনিসকে কারাগারে যেতে হয়।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম নগর বিএনপির একাধিক শীর্ষনেতা এবং স্থানীয় গণ্যমান্য অনেকেই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ফোন করে আনিসের পক্ষে সুপারিশ করেন। তারা পুলিশকে জানান, আনিস একসময় রাজনীতি করলেও তিনি ছিলেন নিপাট ভদ্রলোক। কোনো দিন কারও ক্ষতি করেননি। এলাকার সবার কাছে তিনি একজন সজ্জন ভালো মানুষ হিসাবে পরিচিত। কিন্তু মব সৃষ্টিকারী এনসিপি নেতাদের কারণে পুলিশ কারও সুপারিশ আমলে নিতে পারেনি। এনসিপির নানা অভিযোগের দোহাই দিয়ে অসুস্থ আনিসকে হত্যা, অস্ত্র ও বিস্ফোরক মামলার মতো কঠিন মামলার সন্দিগ্ধ আসামি হিসাবে পুলিশ শনিবার দুপুরে তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। এ ঘটনায় এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চান্দগাঁও থানার ওসি জাহেদুল কবির যুগান্তরকে বলেন, ‘এনসিপি নেতারা ফোন করে জানানোর পর তিনি এবং তাদের টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে আনিসকে থানায় নিয়ে আসেন। তাছাড়া পুলিশ না গেলে অন্য কোনো অঘটন ঘটবে-এমন শঙ্কা থেকেও তাদের টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে আনিসকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে।
আনিসুর রহমানের ভাই আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমার ভাই দীর্ঘদিন ধরে হার্টের রোগে ভুগছেন। তার হার্টে তিনটি রিং পরানো হয়েছে। শুক্রবার রাতে সে ঘুমিয়েছিল। রাত সাড়ে ১১টা থেকে এনসিপির নেতারা মব সৃষ্টি করেন। তাদের কথায় একপর্যায়ে পুলিশ এসে আমার ভাইকে তুলে নিয়ে যায়। অথচ আমার ভাই একজন নিরপরাধ ব্যক্তি। তিনি অপরাধ করলে পালিয়ে থাকতেন। তিনি কোনো অপরাধ করেননি। তাই তিনি ৫ আগস্টের পর থেকে বাড়িতেই ছিলেন। অথচ তার অসুস্থতার কথা বললেও পুলিশ এবং এনসিপি নেতারা কেউ এতে কর্ণপাত করেননি।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনসিপির যুবশক্তির চট্টগ্রাম মহানগর শাখার যুগ্ম সদস্য সচিব মোহাম্মদ সজীব ভুঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘আনিসুর রহমান চান্দগাঁও থানা যুবলীগের সাবেক অর্থ সম্পাদক। এ কারণে গণ-অভ্যুত্থানের পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান। শুক্রবার রাতে তিনি বাসায় অবস্থান করার খবর পেয়ে আমরা সেখানে যাই। নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশকে খবর দিলে আনিসুর রহমানকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। পরে তাকে সংশ্লিষ্ট মামলায় আদালতে পাঠানো হয়।’
১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গ্রেফতার হওয়ার পর হাজেরা তজু কলেজের আবদুল গণি স্যার আমাদের কাছে হেল্প চেয়েছিলেন। তিনি আমার কলেজের শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু বিষয়টি তো আমার কাছে নেই, আমি তার কাছে অপারগতা প্রকাশ করেছি। পরে আনিসুর রহমানের পরিবারের পক্ষ থেকে আমাদের টাকা অফার করা হয়েছিল। কিন্তু আমরা রাজি হইনি।’
সূত্র জানায়, পাঁচ আগস্টের পর কখনো বৈষম্যবিরোধী, কখনো এনসিপি পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী, ধনী ব্যক্তি এবং নিরপরাধ আওয়ামী লীগ নেতাদের বাসাবাড়ি, এমনকি বিয়ে বাড়িতেও মব সৃষ্টি করে চাঁদা আদায়ের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। চাঁদা পেলে ছেড়ে দেওয়া হয়, আর চাঁদা না দিলে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এলাকায় এ ধরনের একাধিক ঘটনার উদাহরণ রয়েছে। বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে এনসিপি নেতাদের চাঁদা দাবির একাধিক ভিডিও ভাইরাল হয় এর আগে।
এদিকে এভাবে মব সৃষ্টি করে এনসিপি নেতা নামধারী চাঁদাবাজরা প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি অব্যাহত রাখলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় চলছে এ ধরনের মব। চান্দগাঁও এলাকায় ১৮-২০ জনের একটি গ্যাং এসব অপকর্ম করছে বলে অভিযোগ আছে। আনিসকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনাটিও এই সিন্ডিকেটের কাজ।
এনসিপির চট্টগ্রাম মহানগরের যুগ্ম সমন্বয়কারী আরিফ মঈনুদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ‘মব সৃষ্টি করা বা কাউকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া আমাদের কাজ নয়। এ বিষয়ে নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে কারও বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা শুধু প্রশাসনকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারি। পুলিশ গ্রেফতার করবে কি করবে না, সেটা তাদের বিষয়।’
ভুক্তভোগী মহল যুগান্তরকে জানায়, কেউ কোনো অপরাধ করলে বা মামলার আসামি হলে তাকে পুলিশ গ্রেফতার করবে। এতে কারও কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এভাবে মব সৃষ্টি ও বাড়িঘেরাও করে কাউকে হেনস্তা করা ও পরিবারের সদস্যদের হুমকি-ধমকি প্রদান বা চাঁদা দাবি করার কোনো সুযোগ নেই। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান এমন বাংলাদেশ দেখতে চায়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো পুলিশের প্রশ্রয়ের কারণে এসব চাঁদাবাজরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।