Image description
নতুন পে-স্কেলের বাড়তি অর্থ জোগানের উদ্যোগ

নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়নে সরকারি পরিচালন কাঠামো পুনর্গঠনসহ তিনটি খাতে বড় সংস্কার আসছে। অন্য দুটি হচ্ছে-অভ্যন্তরীণ ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা এবং অগ্রাধিকার পুনর্নির্ধারণ করে রাষ্ট্রের অর্থের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা বাড়ানো। এসব সংস্কারের মাধ্যমে অর্থের অযৌক্তিক ব্যয় কমানোর সঙ্গে আয়ও বাড়ানো হবে। পাশাপাশি পে-স্কেল বাস্তবায়নে বাড়তি অর্থের চাপ সামাল দিতে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো এবং নন-ট্যাক্স রাজস্ব খাত সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ এ পাঁচটি খাতে নজর দিয়ে কাজ শুরু করেছে অর্থ বিভাগ। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

চলতি বাজেট নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা দিতে ৮৪ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা আছে। বিদ্যমান বেতন কাঠামোর তুলনায় শতভাগ বৃদ্ধি পেলে সেক্ষেত্রে আগামী অর্থবছরে এ খাতে দ্বিগুণ ব্যয় বাড়বে। অর্থাৎ টাকার অঙ্কে বরাদ্দ রাখতে হবে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরের তুলনায় বাড়তি অর্থের জোগাড় করতে হবে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যয় কাঠামোতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে। তবে বেতন-ভাতা ৮৫ শতাংশ বাড়লে সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হবে ৬০ হাজার কোটি টাকা।

অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, মন্ত্রণালয়/বিভাগ, অধিদপ্তর, দপ্তর, করপোরেশন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা মিলিয়ে সরকারের মোট অনুমোদিত পদসংখ্যা ১৯ লাখ ১৯ হাজার ১১১টি। এর বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৮৯১ জন। এছাড়া সিভিল, সিডিজিএফ, রেলওয়ে ও অন্যান্য ক্যাটাগরিতে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী তথা পেনশনারের সংখ্যা বর্তমানে ৮ লাখ ৩৫ হাজার ১৫ জন।

এদিকে নতুন বেতন-ভাতা খাতে বড় ধরনের টাকার জোগান নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় পে-কমিশন এক ধরনের উদ্বেগে আছে। কারণ, দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিতে সংকটকালীন সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর জন্য পে-কমিশন গঠন করা হয়েছে। যদিও সরকার সার্বিক ব্যয় কমানোর জন্য কৃচ্ছ সাধন কর্মসূচি পালন করছে। তবে চাকরিজীবীদের বেতনের বিষয়টিও যৌক্তিক। কারণ, বিগত ১০ বছরে তাদের বেতন-ভাতার কাঠামো বাড়ানো হয়নি। সর্বশেষ ২০১৫ সালে পে-কমিশন গঠন হয়েছিল।

জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি যুগান্তরকে বলেছেন, নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নে অর্থের সমস্যা হবে না। চলতি সংশোধিত বাজেটে আংশিক বরাদ্দ রাখা হবে। আশা করছি, নতুন বছরের শুরুতেই এটি বাস্তবায়ন হবে।

সূত্রমতে, নতুন বেতন স্কেল বাস্তবায়নে বাড়তি অর্থের সংস্থান নিয়ে অর্থ বিভাগ ইতোমধ্যে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা আনা। প্রতিবছর সরকার বাজেট বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে অভ্যন্তরীণ ঋণ নিয়ে থাকে। চলতি অর্থবছরেও ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এ ঋণ প্রতিবছরই বাড়ছে। সরকার এ খাতে সংস্কারের আওতায় এনে ঋণজনিত ব্যয় কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, প্রতিবছর মন্ত্রণালয়গুলো সুষ্ঠুভাবে বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারছে না। দেখা যায়, বছরের শেষদিকে অস্বাভাবিকভাবে টাকা খরচ করে, অথচ শুরুতে ধীরগতিতে অর্থ ব্যয় হয়। ফলে সরকারের সীমিত সম্পদের অপব্যবহার, অপচয় এবং নানা অনিয়ম হচ্ছে। এছাড়া সরকারের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে, যা মোকাবিলা করতে গিয়ে অপরিকল্পিত ঋণ গ্রহণ করতে হয় সরকারকে। এ ধরনের ঋণজনিত ব্যয়ের দায়ভারও বহন করতে গিয়ে আর্থিক শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে। এ খাতে সংস্কার করে ঋণজনিত ব্যয় কমানো হবে, যা শেষ পর্যন্ত আয়ে যোগ হবে।

এছাড়া বর্তমান সরকারের পরিচালন ব্যয় প্রায় সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা। এ ব্যয়ের খাতটি পুনর্গঠন করার মধ্য দিয়ে অযৌক্তিক ব্যয় কমানো হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পণ্য, সেবা, কার্যক্রম ও বুদ্ধিভিত্তিক সেবা কেনার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, মেরামত ও সংরক্ষণ, নির্মাণ ও পূর্তকাজ, মালামাল ক্রয় ও সংগ্রহের মতো কাজ অর্থবছরের শেষদিকে করা হয়। ফলে সরকারি ব্যয়ের গুণগত মান ঠিক রাখা যায় না। যে কারণে বছর শেষে অপরিকল্পিত ঋণের দায় গ্রহণ করতে হয়। ওই সংস্কারে এসব ব্যয়ে পরিবর্তন আনা হবে। বিশেষ করে অর্থবছরের শুরুতে মেরামত ও সংরক্ষণ কাজ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এমনভাবে শুরু করা হবে যেন প্রতি কোয়ার্টারে কাজের বিল ভারসাম্যপূর্ণভাবে পরিশোধ করা যায়; শেষ কোয়ার্টারে এসে বিল পরিশোধের চাপ সৃষ্টি না হয়।

সূত্র আরও জানায়, বাড়তি অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে নন-ট্যাক্স রাজস্ব আয় বাড়ানো হবে। এর আওতায় বিভিন্ন প্রশাসনিক ফি, টোল আদায় ও সরকারি বিভিন্ন অবকাঠামোর ভাড়া এবং ইজারার হার পুনর্নির্ধারণের মাধ্যমে বাড়ানো হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে সরকারের জরিমানা আদায়, দন্ড ও বাজেয়াপ্তকরণ খাতসহ সুদ, লভ্যাংশ ও মুনাফা, সেবা, অবাণিজ্যিক বিক্রয়, মূলধন রাজস্ব ও কর ব্যতীত অন্যান্য রাজস্ব ও প্রাপ্তির হারও বাড়ানো হবে। বর্তমানে এসব খাত থেকে সরকারের আয় হচ্ছে বছরে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টদের মতে, এ খাতে বিভিন্ন আদায় হার পুনর্নির্ধারণ করলে টাকা আদায়ের পরিমাণ বর্তমানের তুলনায় আরও বাড়বে। এছাড়া রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে অর্থ বিভাগ।

এদিকে বাড়তি অর্থ সংস্থানের বিষয়ে জাতীয় পে-কমিশনকে অর্থ বিভাগ বলেছে নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের ফলে সরকারি পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক, তবে এক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের পূর্বপ্রস্তুতি ও রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্যোগের মাধ্যমে এই চাপ সামাল দেওয়া সম্ভব। সেখানে আরও বলা হয়, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির পাশাপাশি কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় হ্রাস, অগ্রাধিকার পুনর্নির্ধারণ এবং অভ্যন্তরীণ ঋণ ব্যবস্থাপনার সচেতন ব্যবহার সরকারকে নতুন পে-স্কেল কার্যকর করার সুযোগ দেবে। নতুন বেতন কাঠামো কেবল ব্যয় বৃদ্ধি নয়, বরং রাজস্বের পরিধিও সম্প্রসারিত করবে। নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন সরকারের আর্থিক সক্ষমতা, জনবল উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে, যা দেশের প্রশাসনিক দক্ষতা ও জনসেবার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

অর্থ বিভাগ আরও বলেছে, অতিরিক্ত অর্থের সংস্থান নিশ্চিত করতে অর্থবিভাগ যথাযথ কার্যক্রম পরিচালনা করবে। ব্যয় বৃদ্ধির চাপ নিয়ন্ত্রণে রেখে রাজস্ব স্থিতিশীলতা ও আর্থিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি, নন-ট্যাক্স রাজস্ব বৃদ্ধি, ব্যয় পুনর্গঠন ও অগ্রাধিকার পুনর্নির্ধারণ বিনিয়োগ দক্ষতা বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ ঋণ ব্যবস্থাপনা স্থিতিশীল রাখা প্রভৃতি বিষয়ে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করছে অর্থবিভাগ। এসব কার্যক্রমের অর্জিত অতিরিক্ত রাজস্ব থেকে বেতন কমিশন বেতন বাড়ানোর সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে অতিরিক্ত অর্থের সংস্থান করতে সক্ষম হবে।