Image description

গুম, খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের পৃথক তিন মামলার আসামি ২৫ সেনা কর্মকর্তার মধ্যে ১৫ জন এখনো কর্মরত বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। রোববার দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম এ কথা বলেন। তিনি বলেন, আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ সেনা কর্মকর্তার মামলার তারিখ পরিবর্তন করে ২৩ ও ২৪ নভেম্বর ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

এদিকে ৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছিলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কারও বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হলে সেই ব্যক্তি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। এমন ব্যক্তি সরকারি চাকরিও করতে পারবেন না। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এ আনা সংশোধনীতে এসব বিষয় যুক্ত করা হয়েছে।

৮ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরিপ্রেক্ষিতে ২২ অক্টোবর আদালতে হাজির করা হলে ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। আদালতের আদেশের পর তাদের ঢাকা সেনানিবাসের বাশার রোডে সাব-জেলে নেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেনানিবাসের বাশার রোডসংলগ্ন ‘এমইএস বিল্ডিং নম্বর-৫৪’কে সাময়িকভাবে কারাগার ঘোষণা করে। প্রসিকিউশনের বক্তব্য অনুযায়ী অভিযুক্ত ২৫ সেনা কর্মকর্তার মধ্যে ১৫ জন এখনো কর্মরত আছেন। এক্ষেত্রে সংশোধিত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ প্রয়োগ হয়েছে কি না, তা জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রসিকিউটর জানান, আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। এখানে কেউই আইনের বাইরে নয়। এখনো ১৫ সেনা কর্মকর্তা চাকরিতে থাকা দুঃখজনক। ট্রাইব্যুনালের জ্যেষ্ঠ প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম বলেন, প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম কী বলেছেন আমি জানি না। না জেনে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।

সেনা কর্মকর্তাদের ১৫ জন এখনো কর্মরত : ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিক প্রসিকিউটরকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি সেনা কর্মকর্তাদের ‘সার্ভিং’ বলছেন। কিন্তু সংশোধিত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ অনুযায়ী, ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হলেই তাদের চাকরি থাকার কথা নয়। এ অবস্থায় তারা চাকরিচ্যুত না কর্মরত-কোনটি বলা হবে?’

জবাবে প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম বলেন, ২২ অক্টোবর সেনা হেফাজতে থাকা ওই ১৫ কর্মকর্তা ট্রাইব্যুনালে হাজির হলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। পরে তাদের ঢাকা সেনানিবাস এলাকায় সাব-জেলে নেওয়া হয়।

তামিম বলেন, ‘যেটা আইনে বলা আছে, সেটাই আইনের ব্যাখ্যা। এখন সেনা সদর দপ্তর সিদ্ধান্ত নেবে, এই আইন কবে তাদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করবে। যতক্ষণ না তা প্রয়োগ হচ্ছে, ততক্ষণ তো ‘সার্ভিং’ (কর্মরত) বলাই যায়।’

মানবতাবিরোধী অপরাধের তিন মামলার মধ্যে দুটি দায়ের করা হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গুম ও নির্যাতনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। অপর মামলাটি গত জুলাইয়ে গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরা ও বনশ্রী এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়। এসব মামলায় ২৫ জন সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তা আসামি হিসাবে আছেন। তাদের মধ্যে ১৫ জন কর্মরত, একজন অবসরোত্তর ছুটিতে (এলপিআর) এবং ৯ জন অবসরপ্রাপ্ত।

প্রসিকিউটর তামিম জানান, গুম-নির্যাতনের দুটি মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ আগে ছিল ২০ নভেম্বর। তবে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে তারিখ পরিবর্তনের আবেদন করা হলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করে ২৩ নভেম্বর নির্ধারণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রসিকিউশনের নিজস্ব জটিলতার কারণে এই সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছিল।’ এছাড়া জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রামপুরা এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দুই সেনা কর্মকর্তা আসামি রয়েছেন। এর পরবর্তী শুনানির তারিখ ৫ নভেম্বর থাকলেও পরিবর্তনের আবেদন মঞ্জুর করে আদালত নতুন তারিখ ২৪ নভেম্বর ধার্য করেছেন বলে জানান গাজী এমএইচ তামিম।

ওসি আশরাফের জামিন নামঞ্জুর : জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ঘিরে কলেজছাত্র হৃদয় হোসেনকে হত্যার পর লাশ গুমের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গাজীপুরের কোনাবাড়ী থানার সাবেক ওসি কেএম আশরাফ উদ্দিনের জামিন নামঞ্জুর করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এদিন দুপুরে ট্রাইব্যুনালে কেএম আশরাফের হয়ে জামিন আবেদন করেন আইনজীবী সিফাত মাহমুদ। কোনাবাড়ী থানার সাবেক এই ওসির স্ত্রী অসুস্থ বলে জানান তিনি। ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশে আইনজীবী সিফাত বলেন, আশরাফের স্ত্রী টিউমারে আক্রান্ত ছিলেন। তা ধীরে ধীরে ক্যানসারে রূপ নেয়। স্ত্রীকে দেখভালের মতো তেমন কেউ নেই। তার দুই মেয়ে রয়েছে। তাই তাকে জামিন দেওয়ার আবেদন করছি।

তার পরিবারে অন্য আর কেউ কি নেই জানতে চান ট্রাইব্যুনাল। তখন আইনজীবী বলেন, আশরাফের পরিবারে আর তেমন কেউ নেই। তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আছেন। তবে অর্থের জোগান ও যত্ন নেওয়ার বিষয় রয়েছে। তাই তার জামিন চাইছি। এছাড়া এ মামলা এখনো তদন্তাধীন।

এ সময় প্রসিকিউশনের পক্ষে প্রসিকিউটর তামিম বলেন, মামলার এই পর্যায়ে কাউকে জামিন দেওয়ার সুযোগ নেই। এছাড়া শেখ হাসিনার মামলার বিচারকাজে আমরা হৃদয় হত্যাকাণ্ডের সেই নির্মম দৃশ্য তুলে ধরেছি। তার মরদেহটিও নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে, যা প্রসিকিউশনের পক্ষে ডুবুরি দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যায়নি। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে তার জামিন নামঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল।

জিয়াউল আহসানসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় বেড়েছে : আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে গুম-খুনের ঘটনায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় বাড়ানো হয়েছে। ১১ ডিসেম্বর এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ধার্য করা হয়েছে।

রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই আদেশ দিয়েছেন। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১-এর অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

এ মামলার ১১ আসামির মধ্যে ৪ জনের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। তারা হলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও জিয়াউল আহসান। বাকি আসামিদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। এ মামলায় মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম বলেন, গুমের অভিযোগে একটি বিবিধ মামলা (মিস কেস) অনেকদিন ধরে চলছে। এ মামলায় ইতোমধ্যে দুটি ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়েছে। এ দুটি মামলায় ২৫ সাবেক-বর্তমান সেনা কর্মকর্তাসহ ২৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। আরেকটি অংশের (আজ যে মামলার শুনানি হয়েছে) তদন্ত চলছে। সেই তদন্তও শেষ পর্যায়ে আছে। আজকের এ মামলায় কিছু আসামির নাম ওই দুটি মামলায় আসামি হিসাবে চলে এসেছে। তাই তাদের আর এ মামলায় যুক্ত করা হবে না।

এদিকে ট্রাইব্যুনালে জুলাই আন্দোলনে রাজধানীর চানখাঁরপুলে ৬ জনকে গুলি করে হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ২০তম সাক্ষী আব্দুস সালামের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। তিনি এই মামলার জব্দ তালিকার সাক্ষী। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ২ নভেম্বর ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল-১।