চীনের ১৪০ কোটির বেশি ভোক্তার বিশাল বাজার বাংলাদেশের জন্য এখনো প্রায় শতভাগ পণ্যে শুল্কমুক্ত। এক ঐতিহাসিক সুযোগের দুয়ার খুলে দিয়েছে বেইজিং। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ‘কাগজে-কলমে শতভাগ সুবিধা, বাস্তবে শূন্যতার হাহাকার।’ গত এক দশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য তিন গুণ বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এর প্রায় পুরোটা জুড়ে রয়েছে শুধু আমদানি।
বড় অঙ্কের এই বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশের পাশেও দাঁড়িয়েছে চীন। ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় দেশটি।
ধাপে ধাপে শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতা বাড়ালেও এই সুবিধার সুফল ঘরে তুলতে পারছে না বাংলাদেশ। প্রশ্ন উঠেছে, চীনের মতো বিশ্বের বৃহত্তম আমদানিকারক দেশে এমন সুযোগ পেয়েও কেন সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে না? সমস্যাটি কি সক্ষমতার ঘাটতি, পণ্যের বৈচিত্র্যহীনতা, নাকি কৌশলগত ভুল?
ব্যবসায়ী নেতা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদন সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, পণ্য বৈচিত্র্যের অভাব এবং প্রতিযোগিতামূলক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তাঁরা বলছেন, চীনের বাজার ধরতে হলে বাংলাদেশকে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিতে হবে। অপ্রচলিত কিন্তু সম্ভাবনাময় পণ্যগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর উৎপাদন ও রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। চীনের বিভিন্ন প্রদেশে একক বাংলাদেশি পণ্যের মেলার আয়োজন করে ব্র্যান্ডিং বাড়াতে হবে।
বাণিজ্য ঘাটতির চিত্র
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত অর্থবছরে চীন থেকে আমদানি ব্যয় ছাড়িয়েছে এক হাজার ৬৬৪ কোটি ডলার, যা মোট আমদানি ব্যয়ের ২৬.৩১ শতাংশ। বিপরীতে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৪১ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য, যা মোট রপ্তানির মাত্র ১ শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় দুই হাজার ১৭০ কোটি ডলার। এই সময়ে বাংলাদেশ চীনে রপ্তানি করেছে মাত্র ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য, বিপরীতে আমদানি করেছে দুই হাজার ১১২ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৪৪ কোটি ডলারে, যা দেশের মোট বাণিজ্য ঘাটতির এক-তৃতীয়াংশের বেশি।
সুবিধা কাজে লাগাতে ব্যর্থতার কারণ
বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) সাবেক সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের পরিধি সীমিত হওয়ায় বাজার সম্প্রসারণে নতুন খাত শনাক্ত করতে হবে। গার্মেন্টস, টেক্সটাইল ও ফার্মাসিউটিক্যালস—এই তিনটি খাতে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা বাংলাদেশের পক্ষে কঠিন। চীন পোশাকশিল্পে তাদের মেশিনারি, দক্ষতা ও কাঁচামাল দিয়ে বিশ্ববাজারে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। আমাদের ব্যাকোয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিংকেজ, বাণিজ্য অবকাঠামো ও লজিস্টিক সেবা এখনো চীনের পর্যায়ে পৌঁছায়নি।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বাজার চীন আমাদের ৯৮ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার পরও চীনে রপ্তানি বাড়াতে পারিনি। আমাদের রপ্তানি ঝুড়ি এখনো একটি বা দুটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। চীন আমাদের তৈরি পোশাক খুব বেশি নেবে না, কারণ তারা নিজেরাই এ খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাদের উৎপাদন সক্ষমতা আরো লাভজনক জায়গায় ব্যস্ত রেখে তারা কিছু পণ্য আমদানি করে থাকে। তারা যেসব পণ্য আমদানি করে সেগুলো আমাদের রপ্তানি ঝুড়িতে নেই, কিছু থাকলেও সেটা তাদের যথেষ্ট পরিমাণ চাহিদামতো বাড়ানো হচ্ছে না। যার ফলে আমাদের রপ্তানিযোগ্য পণ্যে তাদের তেমন চাহিদা নেই।’
সম্ভাবনাময় নতুন খাত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৈরি পোশাকের বাইরে বেশ কিছু খাতে চীনের বাজারে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার, পাট ও পাটজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, সিরামিক, ওষুধ, কাঁকড়া ও কুঁচে, শুকনা খাবার, তিল, আম ও কাঁঠালের মতো মৌসুমি ফল এবং তথ্য-প্রযুক্তি সেবা অন্যতম।
বিশেষ করে চীনের ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানসম্মত চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে এরই মধ্যে চীনে কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি হচ্ছে এবং এর বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে আম ও কাঁঠাল আমদানিতেও আগ্রহ দেখিয়েছে চীন।
সম্ভাবনাময় নতুন খাত সম্পর্কে মামুন মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চামড়া, হিমায়িত মৎস্য, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি বাড়ানো যায়, বরং এসব খাতে রপ্তানিমুখী বিনিয়োগও আকর্ষণ করা সম্ভব। এ ছাড়া আমাদের খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প যদি চীনের মানদণ্ড অনুসরণ করে, তবে সেখানেও উল্লেখযোগ্য সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘চীনের বাজার বিবেচনায় আমাদের উৎপাদন কৌশল ও মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে বাণিজ্য সহায়ক নীতিমালা এবং লজিস্টিক সুবিধা বাড়ানোর মাধ্যমে চীনের বাজারে আমাদের অবস্থান শক্তিশালী করতে হবে।’
কাঁকড়া-বাগদায় সীমিত হিমায়িত মৎস্য রপ্তানি
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি তরিকুল ইসলাম জহির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খুলনা অঞ্চল থেকে চীনে হিমায়িত চিংড়ি, স্বল্প পরিসরে কাঁকড়া রপ্তানি হয়। শুধু চীন নয়, জিআই তালিকাভুক্ত হিসেবে বাইরের দেশগুলোতে বাংলাদেশের চিংড়ি বিশেষ করে বাগদার চাহিদা বেশি। তবে ব্যাংকের ১৫-১৬ শতাংশ সুদহার, রপ্তানি ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যাংকিং জটিলতায় রপ্তানিকারকরা বিপাকে রয়েছেন।’
চিংড়ি রপ্তানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশ ভারত মাত্র ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ করে। সেখানে আমরা দুই লাখ হেক্টর জমিতে চাষ করেও তাদের সমান উৎপাদন করতে পারছি না। ফিশ-ফিডের দাম বৃদ্ধি, নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এ জন্য আমরা চিংড়িকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণার দাবি করে আসছি। নতুন নতুন পণ্য রপ্তানি, বাজার সৃষ্টিতে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। ব্যাংকিং, রপ্তানি ব্যয় সংকোচন করা হলে রপ্তানিকারকরা বিকল্প বাজারের সুবিধা কাজে লাগাতে পারবেন।
খাদ্যপণ্যের বিশাল সম্ভাবনা
চীনে বাংলাদেশি খাদ্যপণ্যের বাজার সম্প্রসারণের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রাণ গ্রুপের বিস্কুট, ফ্রুটস জুস ও কনফেকশনারি পণ্যের সাফল্য দেখিয়ে দেয় যে চীনের বিশাল বাজারে বাংলাদেশি খাদ্যপণ্যের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। চীনে রপ্তানিতে পরিবহন খরচের সুবিধা কাজে লাগানো যেতে পারে, কারণ বাংলাদেশ থেকে চীনের আমদানি করা পণ্যের কনটেইনারগুলো খালি ফেরত যায় বলে রপ্তানিতে পরিবহন খরচ তুলনামূলকভাবে কম। এই সুবিধা কাজে লাগাতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘চীনের মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের খাদ্যাভ্যাসের কিছু পার্থক্য আছে। চীনের ভোক্তাদের রুচি ও খাদ্যাভ্যাস বিবেচনায় নিয়ে পণ্য উন্নয়ন ও আকর্ষণীয় প্যাকেজিং নিশ্চিত করতে হবে।’
রপ্তানি বাড়াতে নতুন পণ্য ও বাজার কৌশল জরুরি
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের অন্যতম উদ্যোক্তা ও ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চীনে বিরাট বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে রপ্তানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। চীন তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে লো-এন্ডের পণ্য উৎপাদনে আমাদের চেয়ে বেশি দক্ষ। তাই একই ধরনের পণ্য রপ্তানির চেষ্টা না করে মিডিয়াম ও হাই-অ্যান্ড পণ্যে মনোযোগ দিতে হবে, যেগুলো চীন নিজে আমদানি করে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা চীনের জন্য সময় ও আর্থিকভাবে বেশি সাশ্রয়ী। তাই আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিংয়ে আমরা যেভাবে অভিজ্ঞ, চীনের বাজারে সেভাবে অভিজ্ঞ নই। এই বৃহৎ বাজারে অগ্রাধিকার বাড়ালে আমাদের উন্নতির সুযোগ রয়েছে।’
তিনি পরামর্শ দেন, ‘চীনে আমাদের অপ্রচলিত পণ্যের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি করলে বাণিজ্য ঘাটতি কমতে পারে। আমাদের উৎপাদন কৌশল ও বিপণন পদ্ধতি চীনের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী সাজাতে হবে।’
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাবনা
চীনের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে কিছু অশুল্ক বাধাও প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। এর মধ্যে রয়েছে দেশটির নিজস্ব মান সনদ, জটিল ও সময়সাপেক্ষ ছাড়পত্রপ্রক্রিয়া এবং ভাষার সমস্যা। এসব কারণে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিতে উৎসাহিত হন না। এ ছাড়া ‘রুলস অব অরিজিন’ বা উৎস বিধির শর্ত অনুযায়ী, শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে হলে একটি পণ্যে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজন বাংলাদেশে হতে হবে। অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই এই শর্ত পূরণ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এই অচলাবস্থা কাটাতে এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে দুই দেশই এখন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরের দিকে এগোচ্ছে। এরই মধ্যে দুই দেশের মধ্যে এফটিএ সম্পাদনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন বিনিময় হয়েছে।
বিসিসিআই সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, ‘চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে হলে রপ্তানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। শুল্কমুক্ত সুবিধা একটি বড় সুযোগ, কিন্তু আমাদের পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। আমরা আশা করছি, এফটিএ স্বাক্ষরিত হলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে একটি ভারসাম্য আসবে।’
তবে অর্থনীতিবিদরা এফটিএ নিয়ে কিছুটা সতর্ক। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘এফটিএ একটি দ্বিমুখী তলোয়ার। এর ফলে আমাদের স্থানীয় বাজার চীনা পণ্যের জন্য আরো উন্মুক্ত হয়ে যাবে, যা দেশীয় শিল্পের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে। তাই চুক্তির আগে আমাদের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে।’
রপ্তানি সম্প্রসারণে করণীয়
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান আরিফ বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তাবাজার চীনের বাজারে আরো ভালো প্রবেশাধিকার অর্জনে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের সহায়তা করা। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদন খরচ এখন পর্যন্ত অনেক কম। এখন নীতি সহায়তা বাড়িয়ে শিল্প-কারখানাগুলোকে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করতে পারলে রপ্তানি খাতে বড় সফলতা আসবে।’
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, চীনের বাজার ধরতে হলে বাংলাদেশকে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিতে হবে। অপ্রচলিত কিন্তু সম্ভাবনাময় পণ্যগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর উৎপাদন ও রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। চীনের বিভিন্ন প্রদেশে একক বাংলাদেশি পণ্যের মেলার আয়োজন করে ব্র্যান্ডিং বাড়াতে হবে। অশুল্ক বাধাগুলো দূর করতে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে এবং এফটিএর আলোচনা সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে, যাতে দেশের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।
অর্থনীতিবিদ মাশরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের রপ্তানিমুখী চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। এতে বাংলাদেশে পণ্য তৈরি করে চীনেই রপ্তানি হতো, এক্সপোর্ট মার্কেটিং আরো ভালো হতো। এখন অপ্রচলিত নতুন পণ্যের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাজার সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুতি ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’
চীনের ১৪০ কোটির বেশি ভোক্তার বিশাল বাজার বাংলাদেশের জন্য এখনো প্রায় শতভাগ পণ্যে শুল্কমুক্ত। এক ঐতিহাসিক সুযোগের দুয়ার খুলে দিয়েছে বেইজিং। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ‘কাগজে-কলমে শতভাগ সুবিধা, বাস্তবে শূন্যতার হাহাকার।’ গত এক দশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য তিন গুণ বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এর প্রায় পুরোটা জুড়ে রয়েছে শুধু আমদানি।
বড় অঙ্কের এই বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশের পাশেও দাঁড়িয়েছে চীন। ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় দেশটি।
ধাপে ধাপে শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতা বাড়ালেও এই সুবিধার সুফল ঘরে তুলতে পারছে না বাংলাদেশ। প্রশ্ন উঠেছে, চীনের মতো বিশ্বের বৃহত্তম আমদানিকারক দেশে এমন সুযোগ পেয়েও কেন সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে না? সমস্যাটি কি সক্ষমতার ঘাটতি, পণ্যের বৈচিত্র্যহীনতা, নাকি কৌশলগত ভুল?
ব্যবসায়ী নেতা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদন সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, পণ্য বৈচিত্র্যের অভাব এবং প্রতিযোগিতামূলক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তাঁরা বলছেন, চীনের বাজার ধরতে হলে বাংলাদেশকে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিতে হবে। অপ্রচলিত কিন্তু সম্ভাবনাময় পণ্যগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর উৎপাদন ও রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। চীনের বিভিন্ন প্রদেশে একক বাংলাদেশি পণ্যের মেলার আয়োজন করে ব্র্যান্ডিং বাড়াতে হবে।
বাণিজ্য ঘাটতির চিত্র
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত অর্থবছরে চীন থেকে আমদানি ব্যয় ছাড়িয়েছে এক হাজার ৬৬৪ কোটি ডলার, যা মোট আমদানি ব্যয়ের ২৬.৩১ শতাংশ। বিপরীতে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৪১ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য, যা মোট রপ্তানির মাত্র ১ শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় দুই হাজার ১৭০ কোটি ডলার। এই সময়ে বাংলাদেশ চীনে রপ্তানি করেছে মাত্র ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য, বিপরীতে আমদানি করেছে দুই হাজার ১১২ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৪৪ কোটি ডলারে, যা দেশের মোট বাণিজ্য ঘাটতির এক-তৃতীয়াংশের বেশি।
সুবিধা কাজে লাগাতে ব্যর্থতার কারণ
বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) সাবেক সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের পরিধি সীমিত হওয়ায় বাজার সম্প্রসারণে নতুন খাত শনাক্ত করতে হবে। গার্মেন্টস, টেক্সটাইল ও ফার্মাসিউটিক্যালস—এই তিনটি খাতে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা বাংলাদেশের পক্ষে কঠিন। চীন পোশাকশিল্পে তাদের মেশিনারি, দক্ষতা ও কাঁচামাল দিয়ে বিশ্ববাজারে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। আমাদের ব্যাকোয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিংকেজ, বাণিজ্য অবকাঠামো ও লজিস্টিক সেবা এখনো চীনের পর্যায়ে পৌঁছায়নি।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বাজার চীন আমাদের ৯৮ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার পরও চীনে রপ্তানি বাড়াতে পারিনি। আমাদের রপ্তানি ঝুড়ি এখনো একটি বা দুটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। চীন আমাদের তৈরি পোশাক খুব বেশি নেবে না, কারণ তারা নিজেরাই এ খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাদের উৎপাদন সক্ষমতা আরো লাভজনক জায়গায় ব্যস্ত রেখে তারা কিছু পণ্য আমদানি করে থাকে। তারা যেসব পণ্য আমদানি করে সেগুলো আমাদের রপ্তানি ঝুড়িতে নেই, কিছু থাকলেও সেটা তাদের যথেষ্ট পরিমাণ চাহিদামতো বাড়ানো হচ্ছে না। যার ফলে আমাদের রপ্তানিযোগ্য পণ্যে তাদের তেমন চাহিদা নেই।’
সম্ভাবনাময় নতুন খাত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৈরি পোশাকের বাইরে বেশ কিছু খাতে চীনের বাজারে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার, পাট ও পাটজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, সিরামিক, ওষুধ, কাঁকড়া ও কুঁচে, শুকনা খাবার, তিল, আম ও কাঁঠালের মতো মৌসুমি ফল এবং তথ্য-প্রযুক্তি সেবা অন্যতম।
বিশেষ করে চীনের ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানসম্মত চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে এরই মধ্যে চীনে কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি হচ্ছে এবং এর বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে আম ও কাঁঠাল আমদানিতেও আগ্রহ দেখিয়েছে চীন।
সম্ভাবনাময় নতুন খাত সম্পর্কে মামুন মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চামড়া, হিমায়িত মৎস্য, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি বাড়ানো যায়, বরং এসব খাতে রপ্তানিমুখী বিনিয়োগও আকর্ষণ করা সম্ভব। এ ছাড়া আমাদের খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প যদি চীনের মানদণ্ড অনুসরণ করে, তবে সেখানেও উল্লেখযোগ্য সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘চীনের বাজার বিবেচনায় আমাদের উৎপাদন কৌশল ও মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে বাণিজ্য সহায়ক নীতিমালা এবং লজিস্টিক সুবিধা বাড়ানোর মাধ্যমে চীনের বাজারে আমাদের অবস্থান শক্তিশালী করতে হবে।’
কাঁকড়া-বাগদায় সীমিত হিমায়িত মৎস্য রপ্তানি
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি তরিকুল ইসলাম জহির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খুলনা অঞ্চল থেকে চীনে হিমায়িত চিংড়ি, স্বল্প পরিসরে কাঁকড়া রপ্তানি হয়। শুধু চীন নয়, জিআই তালিকাভুক্ত হিসেবে বাইরের দেশগুলোতে বাংলাদেশের চিংড়ি বিশেষ করে বাগদার চাহিদা বেশি। তবে ব্যাংকের ১৫-১৬ শতাংশ সুদহার, রপ্তানি ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যাংকিং জটিলতায় রপ্তানিকারকরা বিপাকে রয়েছেন।’
চিংড়ি রপ্তানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশ ভারত মাত্র ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ করে। সেখানে আমরা দুই লাখ হেক্টর জমিতে চাষ করেও তাদের সমান উৎপাদন করতে পারছি না। ফিশ-ফিডের দাম বৃদ্ধি, নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এ জন্য আমরা চিংড়িকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণার দাবি করে আসছি। নতুন নতুন পণ্য রপ্তানি, বাজার সৃষ্টিতে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। ব্যাংকিং, রপ্তানি ব্যয় সংকোচন করা হলে রপ্তানিকারকরা বিকল্প বাজারের সুবিধা কাজে লাগাতে পারবেন।
খাদ্যপণ্যের বিশাল সম্ভাবনা
চীনে বাংলাদেশি খাদ্যপণ্যের বাজার সম্প্রসারণের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রাণ গ্রুপের বিস্কুট, ফ্রুটস জুস ও কনফেকশনারি পণ্যের সাফল্য দেখিয়ে দেয় যে চীনের বিশাল বাজারে বাংলাদেশি খাদ্যপণ্যের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। চীনে রপ্তানিতে পরিবহন খরচের সুবিধা কাজে লাগানো যেতে পারে, কারণ বাংলাদেশ থেকে চীনের আমদানি করা পণ্যের কনটেইনারগুলো খালি ফেরত যায় বলে রপ্তানিতে পরিবহন খরচ তুলনামূলকভাবে কম। এই সুবিধা কাজে লাগাতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘চীনের মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের খাদ্যাভ্যাসের কিছু পার্থক্য আছে। চীনের ভোক্তাদের রুচি ও খাদ্যাভ্যাস বিবেচনায় নিয়ে পণ্য উন্নয়ন ও আকর্ষণীয় প্যাকেজিং নিশ্চিত করতে হবে।’
রপ্তানি বাড়াতে নতুন পণ্য ও বাজার কৌশল জরুরি
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের অন্যতম উদ্যোক্তা ও ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চীনে বিরাট বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে রপ্তানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। চীন তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে লো-এন্ডের পণ্য উৎপাদনে আমাদের চেয়ে বেশি দক্ষ। তাই একই ধরনের পণ্য রপ্তানির চেষ্টা না করে মিডিয়াম ও হাই-অ্যান্ড পণ্যে মনোযোগ দিতে হবে, যেগুলো চীন নিজে আমদানি করে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা চীনের জন্য সময় ও আর্থিকভাবে বেশি সাশ্রয়ী। তাই আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিংয়ে আমরা যেভাবে অভিজ্ঞ, চীনের বাজারে সেভাবে অভিজ্ঞ নই। এই বৃহৎ বাজারে অগ্রাধিকার বাড়ালে আমাদের উন্নতির সুযোগ রয়েছে।’
তিনি পরামর্শ দেন, ‘চীনে আমাদের অপ্রচলিত পণ্যের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি করলে বাণিজ্য ঘাটতি কমতে পারে। আমাদের উৎপাদন কৌশল ও বিপণন পদ্ধতি চীনের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী সাজাতে হবে।’
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাবনা
চীনের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে কিছু অশুল্ক বাধাও প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। এর মধ্যে রয়েছে দেশটির নিজস্ব মান সনদ, জটিল ও সময়সাপেক্ষ ছাড়পত্রপ্রক্রিয়া এবং ভাষার সমস্যা। এসব কারণে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিতে উৎসাহিত হন না। এ ছাড়া ‘রুলস অব অরিজিন’ বা উৎস বিধির শর্ত অনুযায়ী, শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে হলে একটি পণ্যে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজন বাংলাদেশে হতে হবে। অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই এই শর্ত পূরণ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এই অচলাবস্থা কাটাতে এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে দুই দেশই এখন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরের দিকে এগোচ্ছে। এরই মধ্যে দুই দেশের মধ্যে এফটিএ সম্পাদনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন বিনিময় হয়েছে।
বিসিসিআই সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, ‘চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে হলে রপ্তানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। শুল্কমুক্ত সুবিধা একটি বড় সুযোগ, কিন্তু আমাদের পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। আমরা আশা করছি, এফটিএ স্বাক্ষরিত হলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে একটি ভারসাম্য আসবে।’
তবে অর্থনীতিবিদরা এফটিএ নিয়ে কিছুটা সতর্ক। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘এফটিএ একটি দ্বিমুখী তলোয়ার। এর ফলে আমাদের স্থানীয় বাজার চীনা পণ্যের জন্য আরো উন্মুক্ত হয়ে যাবে, যা দেশীয় শিল্পের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে। তাই চুক্তির আগে আমাদের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে।’
রপ্তানি সম্প্রসারণে করণীয়
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান আরিফ বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তাবাজার চীনের বাজারে আরো ভালো প্রবেশাধিকার অর্জনে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের সহায়তা করা। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদন খরচ এখন পর্যন্ত অনেক কম। এখন নীতি সহায়তা বাড়িয়ে শিল্প-কারখানাগুলোকে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করতে পারলে রপ্তানি খাতে বড় সফলতা আসবে।’
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, চীনের বাজার ধরতে হলে বাংলাদেশকে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিতে হবে। অপ্রচলিত কিন্তু সম্ভাবনাময় পণ্যগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর উৎপাদন ও রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। চীনের বিভিন্ন প্রদেশে একক বাংলাদেশি পণ্যের মেলার আয়োজন করে ব্র্যান্ডিং বাড়াতে হবে। অশুল্ক বাধাগুলো দূর করতে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে এবং এফটিএর আলোচনা সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে, যাতে দেশের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।
অর্থনীতিবিদ মাশরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের রপ্তানিমুখী চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। এতে বাংলাদেশে পণ্য তৈরি করে চীনেই রপ্তানি হতো, এক্সপোর্ট মার্কেটিং আরো ভালো হতো। এখন অপ্রচলিত নতুন পণ্যের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাজার সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুতি ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’
চীনের ১৪০ কোটির বেশি ভোক্তার বিশাল বাজার বাংলাদেশের জন্য এখনো প্রায় শতভাগ পণ্যে শুল্কমুক্ত। এক ঐতিহাসিক সুযোগের দুয়ার খুলে দিয়েছে বেইজিং। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ‘কাগজে-কলমে শতভাগ সুবিধা, বাস্তবে শূন্যতার হাহাকার।’ গত এক দশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য তিন গুণ বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এর প্রায় পুরোটা জুড়ে রয়েছে শুধু আমদানি।
বড় অঙ্কের এই বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশের পাশেও দাঁড়িয়েছে চীন। ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় দেশটি।
ধাপে ধাপে শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতা বাড়ালেও এই সুবিধার সুফল ঘরে তুলতে পারছে না বাংলাদেশ। প্রশ্ন উঠেছে, চীনের মতো বিশ্বের বৃহত্তম আমদানিকারক দেশে এমন সুযোগ পেয়েও কেন সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে না? সমস্যাটি কি সক্ষমতার ঘাটতি, পণ্যের বৈচিত্র্যহীনতা, নাকি কৌশলগত ভুল?
ব্যবসায়ী নেতা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদন সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, পণ্য বৈচিত্র্যের অভাব এবং প্রতিযোগিতামূলক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তাঁরা বলছেন, চীনের বাজার ধরতে হলে বাংলাদেশকে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিতে হবে। অপ্রচলিত কিন্তু সম্ভাবনাময় পণ্যগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর উৎপাদন ও রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। চীনের বিভিন্ন প্রদেশে একক বাংলাদেশি পণ্যের মেলার আয়োজন করে ব্র্যান্ডিং বাড়াতে হবে।
বাণিজ্য ঘাটতির চিত্র
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত অর্থবছরে চীন থেকে আমদানি ব্যয় ছাড়িয়েছে এক হাজার ৬৬৪ কোটি ডলার, যা মোট আমদানি ব্যয়ের ২৬.৩১ শতাংশ। বিপরীতে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৪১ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য, যা মোট রপ্তানির মাত্র ১ শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় দুই হাজার ১৭০ কোটি ডলার। এই সময়ে বাংলাদেশ চীনে রপ্তানি করেছে মাত্র ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য, বিপরীতে আমদানি করেছে দুই হাজার ১১২ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৪৪ কোটি ডলারে, যা দেশের মোট বাণিজ্য ঘাটতির এক-তৃতীয়াংশের বেশি।
সুবিধা কাজে লাগাতে ব্যর্থতার কারণ
বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) সাবেক সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের পরিধি সীমিত হওয়ায় বাজার সম্প্রসারণে নতুন খাত শনাক্ত করতে হবে। গার্মেন্টস, টেক্সটাইল ও ফার্মাসিউটিক্যালস—এই তিনটি খাতে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা বাংলাদেশের পক্ষে কঠিন। চীন পোশাকশিল্পে তাদের মেশিনারি, দক্ষতা ও কাঁচামাল দিয়ে বিশ্ববাজারে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। আমাদের ব্যাকোয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিংকেজ, বাণিজ্য অবকাঠামো ও লজিস্টিক সেবা এখনো চীনের পর্যায়ে পৌঁছায়নি।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বাজার চীন আমাদের ৯৮ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার পরও চীনে রপ্তানি বাড়াতে পারিনি। আমাদের রপ্তানি ঝুড়ি এখনো একটি বা দুটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। চীন আমাদের তৈরি পোশাক খুব বেশি নেবে না, কারণ তারা নিজেরাই এ খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাদের উৎপাদন সক্ষমতা আরো লাভজনক জায়গায় ব্যস্ত রেখে তারা কিছু পণ্য আমদানি করে থাকে। তারা যেসব পণ্য আমদানি করে সেগুলো আমাদের রপ্তানি ঝুড়িতে নেই, কিছু থাকলেও সেটা তাদের যথেষ্ট পরিমাণ চাহিদামতো বাড়ানো হচ্ছে না। যার ফলে আমাদের রপ্তানিযোগ্য পণ্যে তাদের তেমন চাহিদা নেই।’
সম্ভাবনাময় নতুন খাত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৈরি পোশাকের বাইরে বেশ কিছু খাতে চীনের বাজারে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার, পাট ও পাটজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, সিরামিক, ওষুধ, কাঁকড়া ও কুঁচে, শুকনা খাবার, তিল, আম ও কাঁঠালের মতো মৌসুমি ফল এবং তথ্য-প্রযুক্তি সেবা অন্যতম।
বিশেষ করে চীনের ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানসম্মত চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে এরই মধ্যে চীনে কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি হচ্ছে এবং এর বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে আম ও কাঁঠাল আমদানিতেও আগ্রহ দেখিয়েছে চীন।
সম্ভাবনাময় নতুন খাত সম্পর্কে মামুন মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চামড়া, হিমায়িত মৎস্য, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি বাড়ানো যায়, বরং এসব খাতে রপ্তানিমুখী বিনিয়োগও আকর্ষণ করা সম্ভব। এ ছাড়া আমাদের খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প যদি চীনের মানদণ্ড অনুসরণ করে, তবে সেখানেও উল্লেখযোগ্য সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘চীনের বাজার বিবেচনায় আমাদের উৎপাদন কৌশল ও মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে বাণিজ্য সহায়ক নীতিমালা এবং লজিস্টিক সুবিধা বাড়ানোর মাধ্যমে চীনের বাজারে আমাদের অবস্থান শক্তিশালী করতে হবে।’
কাঁকড়া-বাগদায় সীমিত হিমায়িত মৎস্য রপ্তানি
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি তরিকুল ইসলাম জহির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খুলনা অঞ্চল থেকে চীনে হিমায়িত চিংড়ি, স্বল্প পরিসরে কাঁকড়া রপ্তানি হয়। শুধু চীন নয়, জিআই তালিকাভুক্ত হিসেবে বাইরের দেশগুলোতে বাংলাদেশের চিংড়ি বিশেষ করে বাগদার চাহিদা বেশি। তবে ব্যাংকের ১৫-১৬ শতাংশ সুদহার, রপ্তানি ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যাংকিং জটিলতায় রপ্তানিকারকরা বিপাকে রয়েছেন।’
চিংড়ি রপ্তানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশ ভারত মাত্র ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ করে। সেখানে আমরা দুই লাখ হেক্টর জমিতে চাষ করেও তাদের সমান উৎপাদন করতে পারছি না। ফিশ-ফিডের দাম বৃদ্ধি, নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এ জন্য আমরা চিংড়িকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণার দাবি করে আসছি। নতুন নতুন পণ্য রপ্তানি, বাজার সৃষ্টিতে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। ব্যাংকিং, রপ্তানি ব্যয় সংকোচন করা হলে রপ্তানিকারকরা বিকল্প বাজারের সুবিধা কাজে লাগাতে পারবেন।
খাদ্যপণ্যের বিশাল সম্ভাবনা
চীনে বাংলাদেশি খাদ্যপণ্যের বাজার সম্প্রসারণের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রাণ গ্রুপের বিস্কুট, ফ্রুটস জুস ও কনফেকশনারি পণ্যের সাফল্য দেখিয়ে দেয় যে চীনের বিশাল বাজারে বাংলাদেশি খাদ্যপণ্যের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। চীনে রপ্তানিতে পরিবহন খরচের সুবিধা কাজে লাগানো যেতে পারে, কারণ বাংলাদেশ থেকে চীনের আমদানি করা পণ্যের কনটেইনারগুলো খালি ফেরত যায় বলে রপ্তানিতে পরিবহন খরচ তুলনামূলকভাবে কম। এই সুবিধা কাজে লাগাতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘চীনের মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের খাদ্যাভ্যাসের কিছু পার্থক্য আছে। চীনের ভোক্তাদের রুচি ও খাদ্যাভ্যাস বিবেচনায় নিয়ে পণ্য উন্নয়ন ও আকর্ষণীয় প্যাকেজিং নিশ্চিত করতে হবে।’
রপ্তানি বাড়াতে নতুন পণ্য ও বাজার কৌশল জরুরি
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের অন্যতম উদ্যোক্তা ও ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চীনে বিরাট বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে রপ্তানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। চীন তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে লো-এন্ডের পণ্য উৎপাদনে আমাদের চেয়ে বেশি দক্ষ। তাই একই ধরনের পণ্য রপ্তানির চেষ্টা না করে মিডিয়াম ও হাই-অ্যান্ড পণ্যে মনোযোগ দিতে হবে, যেগুলো চীন নিজে আমদানি করে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা চীনের জন্য সময় ও আর্থিকভাবে বেশি সাশ্রয়ী। তাই আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিংয়ে আমরা যেভাবে অভিজ্ঞ, চীনের বাজারে সেভাবে অভিজ্ঞ নই। এই বৃহৎ বাজারে অগ্রাধিকার বাড়ালে আমাদের উন্নতির সুযোগ রয়েছে।’
তিনি পরামর্শ দেন, ‘চীনে আমাদের অপ্রচলিত পণ্যের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি করলে বাণিজ্য ঘাটতি কমতে পারে। আমাদের উৎপাদন কৌশল ও বিপণন পদ্ধতি চীনের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী সাজাতে হবে।’
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাবনা
চীনের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে কিছু অশুল্ক বাধাও প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। এর মধ্যে রয়েছে দেশটির নিজস্ব মান সনদ, জটিল ও সময়সাপেক্ষ ছাড়পত্রপ্রক্রিয়া এবং ভাষার সমস্যা। এসব কারণে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিতে উৎসাহিত হন না। এ ছাড়া ‘রুলস অব অরিজিন’ বা উৎস বিধির শর্ত অনুযায়ী, শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে হলে একটি পণ্যে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজন বাংলাদেশে হতে হবে। অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই এই শর্ত পূরণ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এই অচলাবস্থা কাটাতে এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে দুই দেশই এখন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরের দিকে এগোচ্ছে। এরই মধ্যে দুই দেশের মধ্যে এফটিএ সম্পাদনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন বিনিময় হয়েছে।
বিসিসিআই সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, ‘চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে হলে রপ্তানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। শুল্কমুক্ত সুবিধা একটি বড় সুযোগ, কিন্তু আমাদের পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। আমরা আশা করছি, এফটিএ স্বাক্ষরিত হলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে একটি ভারসাম্য আসবে।’
তবে অর্থনীতিবিদরা এফটিএ নিয়ে কিছুটা সতর্ক। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘এফটিএ একটি দ্বিমুখী তলোয়ার। এর ফলে আমাদের স্থানীয় বাজার চীনা পণ্যের জন্য আরো উন্মুক্ত হয়ে যাবে, যা দেশীয় শিল্পের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে। তাই চুক্তির আগে আমাদের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে।’
রপ্তানি সম্প্রসারণে করণীয়
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান আরিফ বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তাবাজার চীনের বাজারে আরো ভালো প্রবেশাধিকার অর্জনে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের সহায়তা করা। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদন খরচ এখন পর্যন্ত অনেক কম। এখন নীতি সহায়তা বাড়িয়ে শিল্প-কারখানাগুলোকে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করতে পারলে রপ্তানি খাতে বড় সফলতা আসবে।’
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, চীনের বাজার ধরতে হলে বাংলাদেশকে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিতে হবে। অপ্রচলিত কিন্তু সম্ভাবনাময় পণ্যগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর উৎপাদন ও রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। চীনের বিভিন্ন প্রদেশে একক বাংলাদেশি পণ্যের মেলার আয়োজন করে ব্র্যান্ডিং বাড়াতে হবে। অশুল্ক বাধাগুলো দূর করতে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে এবং এফটিএর আলোচনা সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে, যাতে দেশের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।
অর্থনীতিবিদ মাশরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের রপ্তানিমুখী চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। এতে বাংলাদেশে পণ্য তৈরি করে চীনেই রপ্তানি হতো, এক্সপোর্ট মার্কেটিং আরো ভালো হতো। এখন অপ্রচলিত নতুন পণ্যের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাজার সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুতি ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’
চীনের ১৪০ কোটির বেশি ভোক্তার বিশাল বাজার বাংলাদেশের জন্য এখনো প্রায় শতভাগ পণ্যে শুল্কমুক্ত। এক ঐতিহাসিক সুযোগের দুয়ার খুলে দিয়েছে বেইজিং। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ‘কাগজে-কলমে শতভাগ সুবিধা, বাস্তবে শূন্যতার হাহাকার।’ গত এক দশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য তিন গুণ বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এর প্রায় পুরোটা জুড়ে রয়েছে শুধু আমদানি।
বড় অঙ্কের এই বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশের পাশেও দাঁড়িয়েছে চীন। ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় দেশটি।
ধাপে ধাপে শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতা বাড়ালেও এই সুবিধার সুফল ঘরে তুলতে পারছে না বাংলাদেশ। প্রশ্ন উঠেছে, চীনের মতো বিশ্বের বৃহত্তম আমদানিকারক দেশে এমন সুযোগ পেয়েও কেন সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে না? সমস্যাটি কি সক্ষমতার ঘাটতি, পণ্যের বৈচিত্র্যহীনতা, নাকি কৌশলগত ভুল?
ব্যবসায়ী নেতা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদন সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, পণ্য বৈচিত্র্যের অভাব এবং প্রতিযোগিতামূলক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তাঁরা বলছেন, চীনের বাজার ধরতে হলে বাংলাদেশকে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিতে হবে। অপ্রচলিত কিন্তু সম্ভাবনাময় পণ্যগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর উৎপাদন ও রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। চীনের বিভিন্ন প্রদেশে একক বাংলাদেশি পণ্যের মেলার আয়োজন করে ব্র্যান্ডিং বাড়াতে হবে।
বাণিজ্য ঘাটতির চিত্র
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত অর্থবছরে চীন থেকে আমদানি ব্যয় ছাড়িয়েছে এক হাজার ৬৬৪ কোটি ডলার, যা মোট আমদানি ব্যয়ের ২৬.৩১ শতাংশ। বিপরীতে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৪১ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য, যা মোট রপ্তানির মাত্র ১ শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় দুই হাজার ১৭০ কোটি ডলার। এই সময়ে বাংলাদেশ চীনে রপ্তানি করেছে মাত্র ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য, বিপরীতে আমদানি করেছে দুই হাজার ১১২ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৪৪ কোটি ডলারে, যা দেশের মোট বাণিজ্য ঘাটতির এক-তৃতীয়াংশের বেশি।
সুবিধা কাজে লাগাতে ব্যর্থতার কারণ
বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) সাবেক সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের পরিধি সীমিত হওয়ায় বাজার সম্প্রসারণে নতুন খাত শনাক্ত করতে হবে। গার্মেন্টস, টেক্সটাইল ও ফার্মাসিউটিক্যালস—এই তিনটি খাতে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা বাংলাদেশের পক্ষে কঠিন। চীন পোশাকশিল্পে তাদের মেশিনারি, দক্ষতা ও কাঁচামাল দিয়ে বিশ্ববাজারে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। আমাদের ব্যাকোয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিংকেজ, বাণিজ্য অবকাঠামো ও লজিস্টিক সেবা এখনো চীনের পর্যায়ে পৌঁছায়নি।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বাজার চীন আমাদের ৯৮ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার পরও চীনে রপ্তানি বাড়াতে পারিনি। আমাদের রপ্তানি ঝুড়ি এখনো একটি বা দুটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। চীন আমাদের তৈরি পোশাক খুব বেশি নেবে না, কারণ তারা নিজেরাই এ খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাদের উৎপাদন সক্ষমতা আরো লাভজনক জায়গায় ব্যস্ত রেখে তারা কিছু পণ্য আমদানি করে থাকে। তারা যেসব পণ্য আমদানি করে সেগুলো আমাদের রপ্তানি ঝুড়িতে নেই, কিছু থাকলেও সেটা তাদের যথেষ্ট পরিমাণ চাহিদামতো বাড়ানো হচ্ছে না। যার ফলে আমাদের রপ্তানিযোগ্য পণ্যে তাদের তেমন চাহিদা নেই।’
সম্ভাবনাময় নতুন খাত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৈরি পোশাকের বাইরে বেশ কিছু খাতে চীনের বাজারে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার, পাট ও পাটজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, সিরামিক, ওষুধ, কাঁকড়া ও কুঁচে, শুকনা খাবার, তিল, আম ও কাঁঠালের মতো মৌসুমি ফল এবং তথ্য-প্রযুক্তি সেবা অন্যতম।
বিশেষ করে চীনের ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানসম্মত চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে এরই মধ্যে চীনে কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি হচ্ছে এবং এর বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে আম ও কাঁঠাল আমদানিতেও আগ্রহ দেখিয়েছে চীন।
সম্ভাবনাময় নতুন খাত সম্পর্কে মামুন মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চামড়া, হিমায়িত মৎস্য, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি বাড়ানো যায়, বরং এসব খাতে রপ্তানিমুখী বিনিয়োগও আকর্ষণ করা সম্ভব। এ ছাড়া আমাদের খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প যদি চীনের মানদণ্ড অনুসরণ করে, তবে সেখানেও উল্লেখযোগ্য সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘চীনের বাজার বিবেচনায় আমাদের উৎপাদন কৌশল ও মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে বাণিজ্য সহায়ক নীতিমালা এবং লজিস্টিক সুবিধা বাড়ানোর মাধ্যমে চীনের বাজারে আমাদের অবস্থান শক্তিশালী করতে হবে।’
কাঁকড়া-বাগদায় সীমিত হিমায়িত মৎস্য রপ্তানি
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি তরিকুল ইসলাম জহির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খুলনা অঞ্চল থেকে চীনে হিমায়িত চিংড়ি, স্বল্প পরিসরে কাঁকড়া রপ্তানি হয়। শুধু চীন নয়, জিআই তালিকাভুক্ত হিসেবে বাইরের দেশগুলোতে বাংলাদেশের চিংড়ি বিশেষ করে বাগদার চাহিদা বেশি। তবে ব্যাংকের ১৫-১৬ শতাংশ সুদহার, রপ্তানি ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যাংকিং জটিলতায় রপ্তানিকারকরা বিপাকে রয়েছেন।’
চিংড়ি রপ্তানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশ ভারত মাত্র ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ করে। সেখানে আমরা দুই লাখ হেক্টর জমিতে চাষ করেও তাদের সমান উৎপাদন করতে পারছি না। ফিশ-ফিডের দাম বৃদ্ধি, নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এ জন্য আমরা চিংড়িকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণার দাবি করে আসছি। নতুন নতুন পণ্য রপ্তানি, বাজার সৃষ্টিতে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। ব্যাংকিং, রপ্তানি ব্যয় সংকোচন করা হলে রপ্তানিকারকরা বিকল্প বাজারের সুবিধা কাজে লাগাতে পারবেন।
খাদ্যপণ্যের বিশাল সম্ভাবনা
চীনে বাংলাদেশি খাদ্যপণ্যের বাজার সম্প্রসারণের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রাণ গ্রুপের বিস্কুট, ফ্রুটস জুস ও কনফেকশনারি পণ্যের সাফল্য দেখিয়ে দেয় যে চীনের বিশাল বাজারে বাংলাদেশি খাদ্যপণ্যের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। চীনে রপ্তানিতে পরিবহন খরচের সুবিধা কাজে লাগানো যেতে পারে, কারণ বাংলাদেশ থেকে চীনের আমদানি করা পণ্যের কনটেইনারগুলো খালি ফেরত যায় বলে রপ্তানিতে পরিবহন খরচ তুলনামূলকভাবে কম। এই সুবিধা কাজে লাগাতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘চীনের মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের খাদ্যাভ্যাসের কিছু পার্থক্য আছে। চীনের ভোক্তাদের রুচি ও খাদ্যাভ্যাস বিবেচনায় নিয়ে পণ্য উন্নয়ন ও আকর্ষণীয় প্যাকেজিং নিশ্চিত করতে হবে।’
রপ্তানি বাড়াতে নতুন পণ্য ও বাজার কৌশল জরুরি
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের অন্যতম উদ্যোক্তা ও ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চীনে বিরাট বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে রপ্তানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। চীন তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে লো-এন্ডের পণ্য উৎপাদনে আমাদের চেয়ে বেশি দক্ষ। তাই একই ধরনের পণ্য রপ্তানির চেষ্টা না করে মিডিয়াম ও হাই-অ্যান্ড পণ্যে মনোযোগ দিতে হবে, যেগুলো চীন নিজে আমদানি করে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা চীনের জন্য সময় ও আর্থিকভাবে বেশি সাশ্রয়ী। তাই আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিংয়ে আমরা যেভাবে অভিজ্ঞ, চীনের বাজারে সেভাবে অভিজ্ঞ নই। এই বৃহৎ বাজারে অগ্রাধিকার বাড়ালে আমাদের উন্নতির সুযোগ রয়েছে।’
তিনি পরামর্শ দেন, ‘চীনে আমাদের অপ্রচলিত পণ্যের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি করলে বাণিজ্য ঘাটতি কমতে পারে। আমাদের উৎপাদন কৌশল ও বিপণন পদ্ধতি চীনের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী সাজাতে হবে।’
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাবনা
চীনের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে কিছু অশুল্ক বাধাও প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। এর মধ্যে রয়েছে দেশটির নিজস্ব মান সনদ, জটিল ও সময়সাপেক্ষ ছাড়পত্রপ্রক্রিয়া এবং ভাষার সমস্যা। এসব কারণে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিতে উৎসাহিত হন না। এ ছাড়া ‘রুলস অব অরিজিন’ বা উৎস বিধির শর্ত অনুযায়ী, শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে হলে একটি পণ্যে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজন বাংলাদেশে হতে হবে। অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই এই শর্ত পূরণ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এই অচলাবস্থা কাটাতে এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে দুই দেশই এখন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরের দিকে এগোচ্ছে। এরই মধ্যে দুই দেশের মধ্যে এফটিএ সম্পাদনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন বিনিময় হয়েছে।
বিসিসিআই সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, ‘চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে হলে রপ্তানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। শুল্কমুক্ত সুবিধা একটি বড় সুযোগ, কিন্তু আমাদের পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। আমরা আশা করছি, এফটিএ স্বাক্ষরিত হলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে একটি ভারসাম্য আসবে।’
তবে অর্থনীতিবিদরা এফটিএ নিয়ে কিছুটা সতর্ক। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘এফটিএ একটি দ্বিমুখী তলোয়ার। এর ফলে আমাদের স্থানীয় বাজার চীনা পণ্যের জন্য আরো উন্মুক্ত হয়ে যাবে, যা দেশীয় শিল্পের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে। তাই চুক্তির আগে আমাদের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে।’
রপ্তানি সম্প্রসারণে করণীয়
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান আরিফ বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তাবাজার চীনের বাজারে আরো ভালো প্রবেশাধিকার অর্জনে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের সহায়তা করা। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদন খরচ এখন পর্যন্ত অনেক কম। এখন নীতি সহায়তা বাড়িয়ে শিল্প-কারখানাগুলোকে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করতে পারলে রপ্তানি খাতে বড় সফলতা আসবে।’
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, চীনের বাজার ধরতে হলে বাংলাদেশকে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিতে হবে। অপ্রচলিত কিন্তু সম্ভাবনাময় পণ্যগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর উৎপাদন ও রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। চীনের বিভিন্ন প্রদেশে একক বাংলাদেশি পণ্যের মেলার আয়োজন করে ব্র্যান্ডিং বাড়াতে হবে। অশুল্ক বাধাগুলো দূর করতে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে এবং এফটিএর আলোচনা সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে, যাতে দেশের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।
অর্থনীতিবিদ মাশরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের রপ্তানিমুখী চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। এতে বাংলাদেশে পণ্য তৈরি করে চীনেই রপ্তানি হতো, এক্সপোর্ট মার্কেটিং আরো ভালো হতো। এখন অপ্রচলিত নতুন পণ্যের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাজার সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুতি ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’
চীনের ১৪০ কোটির বেশি ভোক্তার বিশাল বাজার বাংলাদেশের জন্য এখনো প্রায় শতভাগ পণ্যে শুল্কমুক্ত। এক ঐতিহাসিক সুযোগের দুয়ার খুলে দিয়েছে বেইজিং। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ‘কাগজে-কলমে শতভাগ সুবিধা, বাস্তবে শূন্যতার হাহাকার।’ গত এক দশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য তিন গুণ বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এর প্রায় পুরোটা জুড়ে রয়েছে শুধু আমদানি।
বড় অঙ্কের এই বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশের পাশেও দাঁড়িয়েছে চীন। ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় দেশটি।
ধাপে ধাপে শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতা বাড়ালেও এই সুবিধার সুফল ঘরে তুলতে পারছে না বাংলাদেশ। প্রশ্ন উঠেছে, চীনের মতো বিশ্বের বৃহত্তম আমদানিকারক দেশে এমন সুযোগ পেয়েও কেন সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে না? সমস্যাটি কি সক্ষমতার ঘাটতি, পণ্যের বৈচিত্র্যহীনতা, নাকি কৌশলগত ভুল?
ব্যবসায়ী নেতা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদন সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, পণ্য বৈচিত্র্যের অভাব এবং প্রতিযোগিতামূলক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তাঁরা বলছেন, চীনের বাজার ধরতে হলে বাংলাদেশকে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিতে হবে। অপ্রচলিত কিন্তু সম্ভাবনাময় পণ্যগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর উৎপাদন ও রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। চীনের বিভিন্ন প্রদেশে একক বাংলাদেশি পণ্যের মেলার আয়োজন করে ব্র্যান্ডিং বাড়াতে হবে।
বাণিজ্য ঘাটতির চিত্র
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত অর্থবছরে চীন থেকে আমদানি ব্যয় ছাড়িয়েছে এক হাজার ৬৬৪ কোটি ডলার, যা মোট আমদানি ব্যয়ের ২৬.৩১ শতাংশ। বিপরীতে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৪১ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য, যা মোট রপ্তানির মাত্র ১ শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় দুই হাজার ১৭০ কোটি ডলার। এই সময়ে বাংলাদেশ চীনে রপ্তানি করেছে মাত্র ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য, বিপরীতে আমদানি করেছে দুই হাজার ১১২ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৪৪ কোটি ডলারে, যা দেশের মোট বাণিজ্য ঘাটতির এক-তৃতীয়াংশের বেশি।
সুবিধা কাজে লাগাতে ব্যর্থতার কারণ
বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) সাবেক সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের পরিধি সীমিত হওয়ায় বাজার সম্প্রসারণে নতুন খাত শনাক্ত করতে হবে। গার্মেন্টস, টেক্সটাইল ও ফার্মাসিউটিক্যালস—এই তিনটি খাতে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা বাংলাদেশের পক্ষে কঠিন। চীন পোশাকশিল্পে তাদের মেশিনারি, দক্ষতা ও কাঁচামাল দিয়ে বিশ্ববাজারে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। আমাদের ব্যাকোয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিংকেজ, বাণিজ্য অবকাঠামো ও লজিস্টিক সেবা এখনো চীনের পর্যায়ে পৌঁছায়নি।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বাজার চীন আমাদের ৯৮ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার পরও চীনে রপ্তানি বাড়াতে পারিনি। আমাদের রপ্তানি ঝুড়ি এখনো একটি বা দুটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। চীন আমাদের তৈরি পোশাক খুব বেশি নেবে না, কারণ তারা নিজেরাই এ খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাদের উৎপাদন সক্ষমতা আরো লাভজনক জায়গায় ব্যস্ত রেখে তারা কিছু পণ্য আমদানি করে থাকে। তারা যেসব পণ্য আমদানি করে সেগুলো আমাদের রপ্তানি ঝুড়িতে নেই, কিছু থাকলেও সেটা তাদের যথেষ্ট পরিমাণ চাহিদামতো বাড়ানো হচ্ছে না। যার ফলে আমাদের রপ্তানিযোগ্য পণ্যে তাদের তেমন চাহিদা নেই।’
সম্ভাবনাময় নতুন খাত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৈরি পোশাকের বাইরে বেশ কিছু খাতে চীনের বাজারে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার, পাট ও পাটজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, সিরামিক, ওষুধ, কাঁকড়া ও কুঁচে, শুকনা খাবার, তিল, আম ও কাঁঠালের মতো মৌসুমি ফল এবং তথ্য-প্রযুক্তি সেবা অন্যতম।
বিশেষ করে চীনের ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানসম্মত চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে এরই মধ্যে চীনে কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি হচ্ছে এবং এর বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে আম ও কাঁঠাল আমদানিতেও আগ্রহ দেখিয়েছে চীন।
সম্ভাবনাময় নতুন খাত সম্পর্কে মামুন মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চামড়া, হিমায়িত মৎস্য, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি বাড়ানো যায়, বরং এসব খাতে রপ্তানিমুখী বিনিয়োগও আকর্ষণ করা সম্ভব। এ ছাড়া আমাদের খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প যদি চীনের মানদণ্ড অনুসরণ করে, তবে সেখানেও উল্লেখযোগ্য সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘চীনের বাজার বিবেচনায় আমাদের উৎপাদন কৌশল ও মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে বাণিজ্য সহায়ক নীতিমালা এবং লজিস্টিক সুবিধা বাড়ানোর মাধ্যমে চীনের বাজারে আমাদের অবস্থান শক্তিশালী করতে হবে।’
কাঁকড়া-বাগদায় সীমিত হিমায়িত মৎস্য রপ্তানি
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি তরিকুল ইসলাম জহির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খুলনা অঞ্চল থেকে চীনে হিমায়িত চিংড়ি, স্বল্প পরিসরে কাঁকড়া রপ্তানি হয়। শুধু চীন নয়, জিআই তালিকাভুক্ত হিসেবে বাইরের দেশগুলোতে বাংলাদেশের চিংড়ি বিশেষ করে বাগদার চাহিদা বেশি। তবে ব্যাংকের ১৫-১৬ শতাংশ সুদহার, রপ্তানি ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যাংকিং জটিলতায় রপ্তানিকারকরা বিপাকে রয়েছেন।’
চিংড়ি রপ্তানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশ ভারত মাত্র ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ করে। সেখানে আমরা দুই লাখ হেক্টর জমিতে চাষ করেও তাদের সমান উৎপাদন করতে পারছি না। ফিশ-ফিডের দাম বৃদ্ধি, নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এ জন্য আমরা চিংড়িকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণার দাবি করে আসছি। নতুন নতুন পণ্য রপ্তানি, বাজার সৃষ্টিতে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। ব্যাংকিং, রপ্তানি ব্যয় সংকোচন করা হলে রপ্তানিকারকরা বিকল্প বাজারের সুবিধা কাজে লাগাতে পারবেন।
খাদ্যপণ্যের বিশাল সম্ভাবনা
চীনে বাংলাদেশি খাদ্যপণ্যের বাজার সম্প্রসারণের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রাণ গ্রুপের বিস্কুট, ফ্রুটস জুস ও কনফেকশনারি পণ্যের সাফল্য দেখিয়ে দেয় যে চীনের বিশাল বাজারে বাংলাদেশি খাদ্যপণ্যের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। চীনে রপ্তানিতে পরিবহন খরচের সুবিধা কাজে লাগানো যেতে পারে, কারণ বাংলাদেশ থেকে চীনের আমদানি করা পণ্যের কনটেইনারগুলো খালি ফেরত যায় বলে রপ্তানিতে পরিবহন খরচ তুলনামূলকভাবে কম। এই সুবিধা কাজে লাগাতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘চীনের মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের খাদ্যাভ্যাসের কিছু পার্থক্য আছে। চীনের ভোক্তাদের রুচি ও খাদ্যাভ্যাস বিবেচনায় নিয়ে পণ্য উন্নয়ন ও আকর্ষণীয় প্যাকেজিং নিশ্চিত করতে হবে।’
রপ্তানি বাড়াতে নতুন পণ্য ও বাজার কৌশল জরুরি
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের অন্যতম উদ্যোক্তা ও ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চীনে বিরাট বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে রপ্তানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। চীন তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে লো-এন্ডের পণ্য উৎপাদনে আমাদের চেয়ে বেশি দক্ষ। তাই একই ধরনের পণ্য রপ্তানির চেষ্টা না করে মিডিয়াম ও হাই-অ্যান্ড পণ্যে মনোযোগ দিতে হবে, যেগুলো চীন নিজে আমদানি করে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা চীনের জন্য সময় ও আর্থিকভাবে বেশি সাশ্রয়ী। তাই আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিংয়ে আমরা যেভাবে অভিজ্ঞ, চীনের বাজারে সেভাবে অভিজ্ঞ নই। এই বৃহৎ বাজারে অগ্রাধিকার বাড়ালে আমাদের উন্নতির সুযোগ রয়েছে।’
তিনি পরামর্শ দেন, ‘চীনে আমাদের অপ্রচলিত পণ্যের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি করলে বাণিজ্য ঘাটতি কমতে পারে। আমাদের উৎপাদন কৌশল ও বিপণন পদ্ধতি চীনের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী সাজাতে হবে।’
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাবনা
চীনের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে কিছু অশুল্ক বাধাও প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। এর মধ্যে রয়েছে দেশটির নিজস্ব মান সনদ, জটিল ও সময়সাপেক্ষ ছাড়পত্রপ্রক্রিয়া এবং ভাষার সমস্যা। এসব কারণে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিতে উৎসাহিত হন না। এ ছাড়া ‘রুলস অব অরিজিন’ বা উৎস বিধির শর্ত অনুযায়ী, শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে হলে একটি পণ্যে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজন বাংলাদেশে হতে হবে। অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই এই শর্ত পূরণ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এই অচলাবস্থা কাটাতে এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে দুই দেশই এখন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরের দিকে এগোচ্ছে। এরই মধ্যে দুই দেশের মধ্যে এফটিএ সম্পাদনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন বিনিময় হয়েছে।
বিসিসিআই সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, ‘চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে হলে রপ্তানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। শুল্কমুক্ত সুবিধা একটি বড় সুযোগ, কিন্তু আমাদের পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। আমরা আশা করছি, এফটিএ স্বাক্ষরিত হলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে একটি ভারসাম্য আসবে।’
তবে অর্থনীতিবিদরা এফটিএ নিয়ে কিছুটা সতর্ক। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘এফটিএ একটি দ্বিমুখী তলোয়ার। এর ফলে আমাদের স্থানীয় বাজার চীনা পণ্যের জন্য আরো উন্মুক্ত হয়ে যাবে, যা দেশীয় শিল্পের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে। তাই চুক্তির আগে আমাদের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে।’
রপ্তানি সম্প্রসারণে করণীয়
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান আরিফ বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তাবাজার চীনের বাজারে আরো ভালো প্রবেশাধিকার অর্জনে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের সহায়তা করা। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদন খরচ এখন পর্যন্ত অনেক কম। এখন নীতি সহায়তা বাড়িয়ে শিল্প-কারখানাগুলোকে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করতে পারলে রপ্তানি খাতে বড় সফলতা আসবে।’
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, চীনের বাজার ধরতে হলে বাংলাদেশকে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিতে হবে। অপ্রচলিত কিন্তু সম্ভাবনাময় পণ্যগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর উৎপাদন ও রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। চীনের বিভিন্ন প্রদেশে একক বাংলাদেশি পণ্যের মেলার আয়োজন করে ব্র্যান্ডিং বাড়াতে হবে। অশুল্ক বাধাগুলো দূর করতে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে এবং এফটিএর আলোচনা সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে, যাতে দেশের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।
অর্থনীতিবিদ মাশরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের রপ্তানিমুখী চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। এতে বাংলাদেশে পণ্য তৈরি করে চীনেই রপ্তানি হতো, এক্সপোর্ট মার্কেটিং আরো ভালো হতো। এখন অপ্রচলিত নতুন পণ্যের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাজার সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুতি ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’
চীনের ১৪০ কোটির বেশি ভোক্তার বিশাল বাজার বাংলাদেশের জন্য এখনো প্রায় শতভাগ পণ্যে শুল্কমুক্ত। এক ঐতিহাসিক সুযোগের দুয়ার খুলে দিয়েছে বেইজিং। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ‘কাগজে-কলমে শতভাগ সুবিধা, বাস্তবে শূন্যতার হাহাকার।’ গত এক দশকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য তিন গুণ বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এর প্রায় পুরোটা জুড়ে রয়েছে শুধু আমদানি।
বড় অঙ্কের এই বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশের পাশেও দাঁড়িয়েছে চীন। ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় দেশটি।
ধাপে ধাপে শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতা বাড়ালেও এই সুবিধার সুফল ঘরে তুলতে পারছে না বাংলাদেশ। প্রশ্ন উঠেছে, চীনের মতো বিশ্বের বৃহত্তম আমদানিকারক দেশে এমন সুযোগ পেয়েও কেন সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে না? সমস্যাটি কি সক্ষমতার ঘাটতি, পণ্যের বৈচিত্র্যহীনতা, নাকি কৌশলগত ভুল?
ব্যবসায়ী নেতা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদন সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, পণ্য বৈচিত্র্যের অভাব এবং প্রতিযোগিতামূলক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তাঁরা বলছেন, চীনের বাজার ধরতে হলে বাংলাদেশকে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিতে হবে। অপ্রচলিত কিন্তু সম্ভাবনাময় পণ্যগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর উৎপাদন ও রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। চীনের বিভিন্ন প্রদেশে একক বাংলাদেশি পণ্যের মেলার আয়োজন করে ব্র্যান্ডিং বাড়াতে হবে।
বাণিজ্য ঘাটতির চিত্র
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত অর্থবছরে চীন থেকে আমদানি ব্যয় ছাড়িয়েছে এক হাজার ৬৬৪ কোটি ডলার, যা মোট আমদানি ব্যয়ের ২৬.৩১ শতাংশ। বিপরীতে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৪১ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য, যা মোট রপ্তানির মাত্র ১ শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় দুই হাজার ১৭০ কোটি ডলার। এই সময়ে বাংলাদেশ চীনে রপ্তানি করেছে মাত্র ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য, বিপরীতে আমদানি করেছে দুই হাজার ১১২ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৪৪ কোটি ডলারে, যা দেশের মোট বাণিজ্য ঘাটতির এক-তৃতীয়াংশের বেশি।
সুবিধা কাজে লাগাতে ব্যর্থতার কারণ
বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) সাবেক সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের পরিধি সীমিত হওয়ায় বাজার সম্প্রসারণে নতুন খাত শনাক্ত করতে হবে। গার্মেন্টস, টেক্সটাইল ও ফার্মাসিউটিক্যালস—এই তিনটি খাতে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা বাংলাদেশের পক্ষে কঠিন। চীন পোশাকশিল্পে তাদের মেশিনারি, দক্ষতা ও কাঁচামাল দিয়ে বিশ্ববাজারে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। আমাদের ব্যাকোয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিংকেজ, বাণিজ্য অবকাঠামো ও লজিস্টিক সেবা এখনো চীনের পর্যায়ে পৌঁছায়নি।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বাজার চীন আমাদের ৯৮ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার পরও চীনে রপ্তানি বাড়াতে পারিনি। আমাদের রপ্তানি ঝুড়ি এখনো একটি বা দুটি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। চীন আমাদের তৈরি পোশাক খুব বেশি নেবে না, কারণ তারা নিজেরাই এ খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাদের উৎপাদন সক্ষমতা আরো লাভজনক জায়গায় ব্যস্ত রেখে তারা কিছু পণ্য আমদানি করে থাকে। তারা যেসব পণ্য আমদানি করে সেগুলো আমাদের রপ্তানি ঝুড়িতে নেই, কিছু থাকলেও সেটা তাদের যথেষ্ট পরিমাণ চাহিদামতো বাড়ানো হচ্ছে না। যার ফলে আমাদের রপ্তানিযোগ্য পণ্যে তাদের তেমন চাহিদা নেই।’
সম্ভাবনাময় নতুন খাত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৈরি পোশাকের বাইরে বেশ কিছু খাতে চীনের বাজারে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার, পাট ও পাটজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, সিরামিক, ওষুধ, কাঁকড়া ও কুঁচে, শুকনা খাবার, তিল, আম ও কাঁঠালের মতো মৌসুমি ফল এবং তথ্য-প্রযুক্তি সেবা অন্যতম।
বিশেষ করে চীনের ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানসম্মত চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে এরই মধ্যে চীনে কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি হচ্ছে এবং এর বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে আম ও কাঁঠাল আমদানিতেও আগ্রহ দেখিয়েছে চীন।
সম্ভাবনাময় নতুন খাত সম্পর্কে মামুন মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চামড়া, হিমায়িত মৎস্য, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি বাড়ানো যায়, বরং এসব খাতে রপ্তানিমুখী বিনিয়োগও আকর্ষণ করা সম্ভব। এ ছাড়া আমাদের খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প যদি চীনের মানদণ্ড অনুসরণ করে, তবে সেখানেও উল্লেখযোগ্য সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘চীনের বাজার বিবেচনায় আমাদের উৎপাদন কৌশল ও মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে বাণিজ্য সহায়ক নীতিমালা এবং লজিস্টিক সুবিধা বাড়ানোর মাধ্যমে চীনের বাজারে আমাদের অবস্থান শক্তিশালী করতে হবে।’
কাঁকড়া-বাগদায় সীমিত হিমায়িত মৎস্য রপ্তানি
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি তরিকুল ইসলাম জহির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খুলনা অঞ্চল থেকে চীনে হিমায়িত চিংড়ি, স্বল্প পরিসরে কাঁকড়া রপ্তানি হয়। শুধু চীন নয়, জিআই তালিকাভুক্ত হিসেবে বাইরের দেশগুলোতে বাংলাদেশের চিংড়ি বিশেষ করে বাগদার চাহিদা বেশি। তবে ব্যাংকের ১৫-১৬ শতাংশ সুদহার, রপ্তানি ব্যয় বৃদ্ধি, ব্যাংকিং জটিলতায় রপ্তানিকারকরা বিপাকে রয়েছেন।’
চিংড়ি রপ্তানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশ ভারত মাত্র ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ করে। সেখানে আমরা দুই লাখ হেক্টর জমিতে চাষ করেও তাদের সমান উৎপাদন করতে পারছি না। ফিশ-ফিডের দাম বৃদ্ধি, নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এ জন্য আমরা চিংড়িকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণার দাবি করে আসছি। নতুন নতুন পণ্য রপ্তানি, বাজার সৃষ্টিতে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। ব্যাংকিং, রপ্তানি ব্যয় সংকোচন করা হলে রপ্তানিকারকরা বিকল্প বাজারের সুবিধা কাজে লাগাতে পারবেন।
খাদ্যপণ্যের বিশাল সম্ভাবনা
চীনে বাংলাদেশি খাদ্যপণ্যের বাজার সম্প্রসারণের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রাণ গ্রুপের বিস্কুট, ফ্রুটস জুস ও কনফেকশনারি পণ্যের সাফল্য দেখিয়ে দেয় যে চীনের বিশাল বাজারে বাংলাদেশি খাদ্যপণ্যের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। চীনে রপ্তানিতে পরিবহন খরচের সুবিধা কাজে লাগানো যেতে পারে, কারণ বাংলাদেশ থেকে চীনের আমদানি করা পণ্যের কনটেইনারগুলো খালি ফেরত যায় বলে রপ্তানিতে পরিবহন খরচ তুলনামূলকভাবে কম। এই সুবিধা কাজে লাগাতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘চীনের মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের খাদ্যাভ্যাসের কিছু পার্থক্য আছে। চীনের ভোক্তাদের রুচি ও খাদ্যাভ্যাস বিবেচনায় নিয়ে পণ্য উন্নয়ন ও আকর্ষণীয় প্যাকেজিং নিশ্চিত করতে হবে।’
রপ্তানি বাড়াতে নতুন পণ্য ও বাজার কৌশল জরুরি
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের অন্যতম উদ্যোক্তা ও ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চীনে বিরাট বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে রপ্তানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। চীন তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে লো-এন্ডের পণ্য উৎপাদনে আমাদের চেয়ে বেশি দক্ষ। তাই একই ধরনের পণ্য রপ্তানির চেষ্টা না করে মিডিয়াম ও হাই-অ্যান্ড পণ্যে মনোযোগ দিতে হবে, যেগুলো চীন নিজে আমদানি করে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা চীনের জন্য সময় ও আর্থিকভাবে বেশি সাশ্রয়ী। তাই আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিংয়ে আমরা যেভাবে অভিজ্ঞ, চীনের বাজারে সেভাবে অভিজ্ঞ নই। এই বৃহৎ বাজারে অগ্রাধিকার বাড়ালে আমাদের উন্নতির সুযোগ রয়েছে।’
তিনি পরামর্শ দেন, ‘চীনে আমাদের অপ্রচলিত পণ্যের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি করলে বাণিজ্য ঘাটতি কমতে পারে। আমাদের উৎপাদন কৌশল ও বিপণন পদ্ধতি চীনের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী সাজাতে হবে।’
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাবনা
চীনের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে কিছু অশুল্ক বাধাও প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। এর মধ্যে রয়েছে দেশটির নিজস্ব মান সনদ, জটিল ও সময়সাপেক্ষ ছাড়পত্রপ্রক্রিয়া এবং ভাষার সমস্যা। এসব কারণে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিতে উৎসাহিত হন না। এ ছাড়া ‘রুলস অব অরিজিন’ বা উৎস বিধির শর্ত অনুযায়ী, শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে হলে একটি পণ্যে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজন বাংলাদেশে হতে হবে। অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই এই শর্ত পূরণ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এই অচলাবস্থা কাটাতে এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে দুই দেশই এখন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরের দিকে এগোচ্ছে। এরই মধ্যে দুই দেশের মধ্যে এফটিএ সম্পাদনের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন বিনিময় হয়েছে।
বিসিসিআই সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, ‘চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে হলে রপ্তানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। শুল্কমুক্ত সুবিধা একটি বড় সুযোগ, কিন্তু আমাদের পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। আমরা আশা করছি, এফটিএ স্বাক্ষরিত হলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে একটি ভারসাম্য আসবে।’
তবে অর্থনীতিবিদরা এফটিএ নিয়ে কিছুটা সতর্ক। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘এফটিএ একটি দ্বিমুখী তলোয়ার। এর ফলে আমাদের স্থানীয় বাজার চীনা পণ্যের জন্য আরো উন্মুক্ত হয়ে যাবে, যা দেশীয় শিল্পের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে। তাই চুক্তির আগে আমাদের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে।’
রপ্তানি সম্প্রসারণে করণীয়
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান আরিফ বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তাবাজার চীনের বাজারে আরো ভালো প্রবেশাধিকার অর্জনে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের সহায়তা করা। প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদন খরচ এখন পর্যন্ত অনেক কম। এখন নীতি সহায়তা বাড়িয়ে শিল্প-কারখানাগুলোকে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করতে পারলে রপ্তানি খাতে বড় সফলতা আসবে।’
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, চীনের বাজার ধরতে হলে বাংলাদেশকে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিতে হবে। অপ্রচলিত কিন্তু সম্ভাবনাময় পণ্যগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর উৎপাদন ও রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। চীনের বিভিন্ন প্রদেশে একক বাংলাদেশি পণ্যের মেলার আয়োজন করে ব্র্যান্ডিং বাড়াতে হবে। অশুল্ক বাধাগুলো দূর করতে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে এবং এফটিএর আলোচনা সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে, যাতে দেশের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।
অর্থনীতিবিদ মাশরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের রপ্তানিমুখী চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। এতে বাংলাদেশে পণ্য তৈরি করে চীনেই রপ্তানি হতো, এক্সপোর্ট মার্কেটিং আরো ভালো হতো। এখন অপ্রচলিত নতুন পণ্যের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বাজার সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুতি ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’