Image description
বৈদেশিক ঋণের বড় অঙ্ক কাটছাঁটের শঙ্কা

উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আনতে পারছে না অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও এক্ষেত্রে সফলতা আসেনি। বৈদেশিক সহায়তানির্ভর প্রকল্পগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। এমন পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে কমতে পারে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যেই বৈদেশিক ঋণের অংশ কাটছাঁটের প্রক্রিয়া শুরু করেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। আগামী ২ নভেম্বর থেকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে শুরু হচ্ছে চার দিনের সিরিজ বৈঠক। ইআরডির সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দীকির সভাপতিত্বে সিরিজ বৈঠকে গত তিন মাসের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে সংশোধিত এডিপির জন্য বরাদ্দ নির্ধারণসংক্রান্ত আলোচনাও হবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

এডিপি সংশোধন প্রসঙ্গে এর আগে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ জানিয়েছিলেন, চলতি অর্থবছর আগেভাগেই এডিপি সংশোধনের কাজ করা হবে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে সংশোধনের কাজটি নির্বাচনের আগেই করতে হবে। গত অর্থবছর ডিসেম্বর থেকে এ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যেই মন্ত্রণালয় ও বিভাগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছি। প্রকল্প বাস্তবায়নের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। সমাধানের প্রচেষ্টা চলছে। ৫ আগস্টের পর অনেক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক পালিয়ে যায়। সেখানে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ঠিকাদার পালিয়েছিল। এখনো সবগুলোতে নতুন ঠিকাদার দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে প্রকল্প বাস্তবায়ন কম হলেই যে সব শেষ হয়ে গেল বিষয়টি এমন নয়, প্রয়োজন মানসম্মত বাস্তবায়ন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সে চেষ্টাই করছে।

সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বৈদেশিক অর্থের বরাদ্দ দেওয়া আছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট এডিপির ৩৬ দশমিক ০৩ শতাংশ। এর মধ্যে গত তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো খরচ করতে পেরেছে পাঁচ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে খরচ হয়েছিল পাঁচ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে সাত হাজার ৫০০ কোটি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সাত হাজার ৯৪২ কোটি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছয় হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল।

এদিকে চলতি অর্থবছরের তিন মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত খরচের খাতাই খুলতে পারেনি ৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এগুলো হলো-সেতু বিভাগ, সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান-পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আরও আছে জননিরাপত্তা বিভাগ, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এছাড়া এক শতাংশের নিচে বাস্তবায়ন হার ৮ প্রতিষ্ঠানের। এগুলো হলো কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ২ শতাংশের নিচে বৈদেশিক অর্থ খরচ করা চারটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ হলো-রেলপথ মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয় এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এ অবস্থায় গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে সংশোধিত এডিপিতে বৈদেশিক অর্থের বরাদ্দ দেওয়া হতে পারে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছর ছেঁটে ফেলা হয়েছিল ১৯ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

ইআরডি সূত্র জানায়, সিরিজ বৈঠকের শুরুতে ২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে বিদ্যুৎ বিভাগ, কৃষি মন্ত্রণালয়, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ-বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ, ভূমি এবং জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সঙ্গে। ৩ নভেম্বর বৈঠক হবে স্থানীয় সরকার বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ-আইন ও বিচার বিভাগ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, প্রতিরক্ষা, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সঙ্গে। ৪ নভেম্বর সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ, রেলপথ, নৌ-পরিবহণ, বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন এবং সেতু বিভাগ, সমাজকল্যাণ, মহিলা ও শিশু, শ্রম ও কর্মসংস্থান, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত, তথ্য ও সম্প্রচার, যুব ও ক্রীড়া, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় শিল্প মন্ত্রণালয় এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সঙ্গে বৈঠক হবে। ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, ইআরডি, পরিকল্পনা বিভাগ, আইএমইডি, পসিংখ্যান বিভাগ, দুর্যোগ ও ত্রাণ, স্বরাষ্ট্র, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং অর্থ বিভাগের সঙ্গে।

বৈদেশিক অর্থায়নের প্রকল্পগুলোতে ধীরগতির কারণ প্রসঙ্গে জানা গেছে, যেনতেনভাবে প্রকল্প তৈরি, বাস্তবায়ন পর্যায়ে কার্যকর তদারকির অভাব, নিয়মিত ও কার্যকরভাবে পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) এবং পিএসসি (প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটি) বৈঠক না হওয়া। সেই সঙ্গে জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, দরপত্র প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, উন্নয়ন সহযোগীদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব। আরও আছে, প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড় না হওয়া, প্রকল্প পরিচালকদের অদক্ষতা, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদলিসহ নানা কারণ।

বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সূত্র জানায়, গত অর্থবছরের এডিপিতে বৈদশিক অর্থ বরাদ্দ ছিল এক লাখ কোটি টাকা। অর্থবছরের মাঝপথে এসে ১৯ হাজার কোটি টাকা ছেঁটে ফেলে সংশোধিত বরাদ্দ দেওয়া হয় ৮১ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছেঁটে ফেলা হয়েছিল ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বরাদ্দ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৭ হাজার ৫২০ কোটি. ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৫ হাজার ৩৪৭ কোটি এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৭ হাজার ৯৮৬ কোটি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা কমানো হয়।