
জাহিদ মালেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে বিশ্বজুড়ে করোনার প্রকোপ শুরু হয়। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশান্তরে। করোনা কেবল বিশ্বজুড়ে অগণিত মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়নি, গোটা বিশ্বকে অচল করে দেয়। বাংলাদেশও কভিডের ভয়াবহতা থেকে মুক্ত ছিল না। কভিড সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে মন্দা সৃষ্টি করে। কিন্তু এ মহামারি বিশ্বব্যাপী সর্বনাশ ডেকে আনলেও বাংলাদেশের কারও কারও জন্য আনে পৌষ মাস। জাহিদ মালেক হলেন সেই সুবিধাভোগীদের একজন। কভিড টিকা আবিষ্কারের পর বাংলাদেশও এই টিকা কেনার তোড়জোড় শুরু করে। আর এ টিকা কিনতে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ভয়াবহ দুর্নীতির আশ্রয় নেন। হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন টিকা কেনার নামে। কভিড-১৯-এর টিকা আমদানিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকসহ সংশ্লিষ্টরা রাষ্ট্রের ২২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন, এমন একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে। অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের উপপরিচালক আফরোজা হক খানের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি কাজ করছে। টিমের অপর তিন সদস্য হলেন-দুদকের সহকারী পরিচালক বিলকিস আক্তার, দুই উপসহকারী পরিচালক মো. জুয়েল রানা ও কাজী হাফিজুর রহমান।
অভিযোগে বলা হয়, ২০২১ সালে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩ কোটি টিকা কেনার জন্য সে বছরের ডিসেম্বরে চুক্তি করে বাংলাদেশ। এতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস।
টিকা কেনার ওই চুক্তি প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ উল্লেখ করে দুদকে করা অভিযোগে বলা হয়, কভিড-১৯ টিকা কেনার ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয়বিধি অনুসরণ করা হয়নি। ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, যা আইনের লঙ্ঘন। নীতিমালা লঙ্ঘন করে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় টিকা আমদানি করা হয়েছে।
সরকার তৃতীয় পক্ষ হিসেবে বেক্সিমকো ফার্মাকে অন্তর্ভুক্ত করায় অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি দামে বাংলাদেশকে সেরামের টিকা কিনতে হয়েছে বলেও অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ভারত থেকে আমদানি করা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রতিটি ডোজ থেকে অন্য সব খরচ মিটিয়ে ৭৭ টাকা করে লাভ করেছে। সরকার সরাসরি সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে টিকা আনলে প্রতি ডোজে যে টাকা বাঁচত তা দিয়ে আরও ৬৮ লাখ বেশি টিকা কেনার চুক্তি করা যেত। এ ছাড়া সরকারিভাবে পরিচালিত একটি কভিড পরীক্ষার জন্য ৩ হাজার টাকা খরচও অনেক বেশি উল্লেখ করে এতেও সীমাহীন দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
দুর্নীতির এই সিন্ডিকেটে অন্য সদস্যদের মধ্যে তৎকালীন স্বাস্থ্যসচিব লোকমান হোসেন ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্যসচিব আহমদ কায়কাউসের নাম অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযোগে আরও বলা হয়, টিকা আমদানি করে চক্রটি অন্তত ২২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, কভিড-১৯ টিকা ক্রয় এবং বিতরণে ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই খরচ সর্বোচ্চ ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।
শুধু তাই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার এবং মডার্নার টিকা আগে আবিষ্কৃত হয়। সে সময় বিনামূল্যে এই ভ্যাকসিন পাওয়ার সুযোগ থাকলেও তা কাজে লাগানো হয়নি, শুধু দুর্নীতির জন্য। সেরাম কোম্পানি মাঝপথে টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশের জনগণ বিপদে পড়ে। এ সময় চীন থেকে বেশি দামে ভ্যাকসিন কিনতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ। অথচ শুরুতে যদি চীন থেকে টিকা কেনা হতো তাহলে দাম অনেক কম লাগত। চীনের টিকা কেনার ক্ষেত্রেও জাহিদ মালেক দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারের দামের চেয়ে বেশি দামে চীনের ভ্যাকসিন কেনা হয়েছে। বেসরকারি একাধিক প্রতিষ্ঠান চীন থেকে ভ্যাকসিন আমদানি করতে চাইলেও জাহিদ মালেক তাদের অনুমতি দেয়নি। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের কয়েকটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদন করার উদ্যোগ নিলেও তাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বাধা দেয়। টিকা আমদানিতে একটি বিশেষ কোম্পানিকে একচেটিয়া ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়ার জন্যই জাহিদ মালেক এসব অপকর্ম করেন। দেশের জনগণের স্বার্থের চেয়ে টিকা দিয়ে টাকা বানানোই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য।