
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এক নতুন ইতিহাসের সাক্ষী হলো মধ্যপ্রাচ্য তথা ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের জনগণ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত চুক্তি অনুযায়ী সোমবার জিম্মি ও বন্দিবিনিময় করেছে হামাস ও ইসরাইল। এতে মুক্তির আনন্দে ভাসছে ইসরাইল ও গাজার জনগণ। দুই বছর যাবৎ ইসরাইলের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ থেকে আপাতত নিস্তার পেয়েছেন গাজাবাসী। পক্ষান্তরে ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর হামাসের হাতে জিম্মি হওয়া জীবিত ২০ ইসরাইলিকে ফিরে পেয়ে আনন্দ অশ্রুতে সিক্ত হয়েছেন ভুক্তভোগীদের পরিবার। এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছেন ডনাল্ড ট্রাম্প। আরব বিশ্ব ও মুসলিম দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ শেষ করতে ২০ দফা প্রস্তাবনা দেন তিনি। যার ভিত্তিতে গত সপ্তাহে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় উভয় পক্ষ। এখন শান্তিচুক্তির প্রথম ধাপ বাস্তবায়িত হয়েছে। এ উপলক্ষে সোমবার মধ্যপ্রাচ্য সফর করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ভাষণ দেন ইসরাইলের পার্লামেন্ট নেসেটে। সেখানে তিনি গাজা পুনর্গঠনে আরব বিশ্ব ও মুসলিম নেতাদের অবদানের কথা স্বীকার করেন এবং তাদের ধন্যবাদ দেন। পাশাপাশি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ও ইসরাইলের মধ্যকার যুদ্ধবিরতিকে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন ভোর বলে আখ্যা দিয়েছেন। এদিকে পার্লামেন্টে ভাষণের সময় বাধার সম্মুখীন হন ট্রাম্প।
নেসেটের দুই সদস্য তার বক্তৃতার বিরোধিতা করেন। প্রতিবাদকারী এ দুই সংসদ সদস্যকে টেনে হিঁচড়ে পার্লামেন্ট হল থেকে বের করে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। তারা হলেন- ইসরাইলের হাদাশ পার্টির প্রধান আরব আইনপ্রণেতা আয়মান ওদেহ এবং আরব দলের একমাত্র ইহুদি আইনপ্রণেতা ওফের কাসিফ। তাদের হাতে প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। সেখানে লিখা ছিল, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দাও। ট্রাম্প ইসরাইলে পৌঁছানোর পরই জীবিত ২০ জিম্মিকে মুক্তি দেয় হামাস। বিনিময়ে কয়েকশত ফিলিস্তিনি বন্দিকে বাসে করে পশ্চিম তীরে পৌঁছে দেয় ইসরাইল। চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরাইলি কারাগার থেকে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেয়া হবে। সোমবার ইসরাইল সফর শেষে মিশরের শার্ম আল শেখে শান্তি সম্মেলনে যোগ দেয়ার কথা ট্রাম্পের। সেখানে তিনি গাজা শান্তিচুক্তি নিয়ে বক্তব্য দেবেন বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মিডিয়া।
আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো ট্রাম্পের ভাষণকে ঐতিহাসিক বলে আখ্যা দিয়েছে। আরব বিশ্বের প্রশংসার পাশাপাশি ইসরাইলকেও বিজয়ী ঘোষণা করেন পশ্চিমা এই নেতা। তিনি বলেন, আপনারা জিতেছেন। হামাস-ইসরাইলের চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইল ও মধ্যপ্রাচ্যে স্বর্ণযুগের সূচনা হলো। পাশাপাশি তিনি দুই বছর ধরে চলা এই যুদ্ধের অবসানকে ‘সন্ত্রাস ও হত্যার যুগের অবসান’ বলে উল্লেখ করেছেন। তার বিশ্বাস এর মধ্যদিয়ে ঈশ্বরের যুগের সূচনা হয়েছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দেশপ্রেম ও দৃঢ়তার প্রশংসা করে রসিকতা করে বলেন, বিবি, এখন আপনি একটু ভালো ব্যবহার করতে পারেন, কারণ আপনি আর যুদ্ধ করছেন না। তিনি ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হার্জগকে নেতানিয়াহুর দুর্নীতির মামলার জন্য ক্ষমা করে দেয়ার অনুরোধ করেন। যদিও নেতানিয়াহু যুদ্ধ শেষ হয়েছে কিনা, তা নিয়ে সরাসরি কিছু বলেননি। তবে ট্রাম্প দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন যুদ্ধ শেষ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার কথাও জানিয়েছেন ট্রাম্প।
গাজা পুনর্গঠন প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গাজার পুনর্গঠন শুরু হবে। পাশাপাশি ওই অঞ্চলের শাসনের জন্য ‘বোর্ড অব পিস’ নামে একটি নতুন আন্তর্জাতিক পর্ষদ গঠিত হবে। চুক্তির অংশ হিসেবে জীবিত থাকা ২০ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। অন্যদিকে ইসরাইলি কারাগার থেকে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেয়া হবে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, এই সংঘাতের শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬৭ হাজার ৮০০ নিহত এবং এক লাখ ৭০ হাজার ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন।
নেসেটে ট্রাম্পকে প্রায় তিন মিনিটের স্ট্যান্ডিং ওভেশন দেয়া হয়। উপস্থিত সদস্যরা ট্রাম্পের নামে স্লোগান দেন। শান্তিতে ট্রাম্পকে নোবেল না দেয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে ইসরাইল। সোমবার নেসেটের স্পিকার আমির ওহানা ট্রাম্পকে ‘শান্তির প্রেসিডেন্ট’ উপাধি দেন। পাশাপাশি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সালে ইহুদি বন্দিদের মুক্তি দেয়া পারস্যের রাজা সাইরাস দ্য গ্রেটের সঙ্গে তুলনা করেন তিনি। আগামী বছর ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার আহ্বানও জানান ওহানা। তেল আবিবের ‘হোস্টেজস স্কোয়ারে’ ট্রাম্পের নামে স্লোগান দেন ইসরাইলের হাজার হাজার মানুষ।
এদিকে এই চুক্তিকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে সোমবার মিশরের শার্ম আল শেখে শান্তি সম্মেলনে যোগ দেয়ার কথা ট্রাম্পের। গুরুত্বপূর্ণ এই সম্মেলনে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন, জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎজসহ কাতার, সৌদি আরব, তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়ার মতো ২০টির বেশি দেশের নেতারা অংশ নিচ্ছেন। এই সম্মেলনে নেতানিয়াহুকে আমন্ত্রণ জানান ট্রাম্প। তবে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। চুক্তি সত্ত্বেও এই যুদ্ধবিরতি ক’দিন স্থায়ী হবে তা নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়ে গেছে। হামাসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, তাদের নিরস্ত্রীকরণ প্রশ্নাতীতভাবে অগ্রহণযোগ্য। অন্যদিকে নেতানিয়াহুও জোর দিয়ে বলেছেন, যুদ্ধবিরতিটি অস্থায়ী এবং হামাস নিরস্ত্রীকরণের চুক্তি না মানলে পুনরায় সামরিক অভিযান শুরু করার অধিকার রাখে তেল আবিব।