
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেড় শতাধিক আসনে প্রার্থিতায় পরিবর্তন আনার চিন্তা করছে বিএনপি। এসব আসনে ইতঃপূর্বে দলের যারা নির্বাচন করেছেন, তাদের জায়গায় মনোনয়ন দেয়া হতে পারে অপেক্ষাকৃত তরুণ, জনবান্ধব ও ইমেজধারীদের। জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপির হাইকমান্ডকে এ ধরনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পরামর্শকরা বলেছেন, আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে দলীয় মার্কা-ই যথেষ্ট নয়, ব্যক্তির ইমেজও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে যদি পুরনো পথে বিএনপি হাটে তাহলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে একই পরিবার থেকে একাধিক মনোনয়ন না দেয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এমন অবস্থায় নির্বাচন সামনে রেখে প্রার্থী চূড়ান্ত করতে বিএনপিও নানামুখী তৎপরতা শুরু করেছে। অভ্যন্তরীণ একাধিক জরিপসহ নানা প্রক্রিয়ায় প্রার্থী চূড়ান্তে কাজ করছেন দলের হাইকমান্ড। অবশ্য ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে প্রায় দেড় শ’ আসনের প্রার্থিতা নিয়ে তেমন ভাবছে না বিএনপি। হাইকমান্ডের পর্যবেক্ষণ, এসব আসনে দলীয় প্রার্থিতা নিয়ে তেমন সমস্যা বা জটিলতা হবে না। এই আসনগুলোর প্রার্থীরা মোটামুটি নির্ধারিত, ২০১৮ সালের নির্বাচনে এদের অনেকেই দলের প্রার্থী ছিলেন। অন্যগুলোর মধ্যে কোনো কোনো আসনে সমস্যা রয়েছে, জরিপের মাধ্যমে বিএনপির হাইকমান্ড ইতোমধ্যে তা চিহ্নিত করেছেন। সে অনুযায়ী দলটি দেড় শতাধিক আসনকে ‘জটিলতাপূর্ণ’ বলে মনে করছে। এসব আসনের প্রতিটিতে সম্ভাব্য একাধিক প্রার্থী মাঠে তৎপর রয়েছেন। এমন অবস্থায় প্রার্থীদের কেন্দ্রে ডেকে ‘জটিলতা নিরসনে’ উদ্যোগী হয়েছে বিএনপি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, যেগুলোতে জটিলতা বা সমস্যা রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ আসনেই এবার প্রার্থিতায় পরিবর্তন আসতে পারে। বিতর্কিত কাউকে প্রার্থী না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন হাইকমান্ড। গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে এলাকায় জনপ্রিয়, ক্লিন ইমেজসম্পন্ন ব্যক্তিদের এসব আসনে দলীয় প্রার্থী করা হবে। তাই যেসব আসনে একাধিক প্রার্থী রয়েছে কিংবা নানা গ্রুপিং বিরাজমান, তাদেরকে কেন্দ্রে ডেকে এনে দলের বার্তা-নির্দেশনা জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে গত সোমবার থেকে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ‘জটিলতাপূর্ণ’ বিভিন্ন আসনের প্রার্থীদের নিয়ে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করছেন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট, বরিশাল, বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলার অর্ধশত আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে পৃথকভাবে বৈঠক করেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও অধ্যাপক ডা: এ জেড এম জাহিদ হোসেন।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, এসব বৈঠকে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে এই বার্তা দিচ্ছেন যে, আগামী নির্বাচনে দল থেকে যাকেই প্রার্থী করা হবে, তাকেই মেনে নিতে হবে এবং গ্রুপিং-বিভেদ ভুলে তাকে বিজয়ী করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। অন্যথায় কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জানতে চাইলে বৈঠকে অংশ নেয়া রাজশাহী ও বরিশাল বিভাগের সম্ভাব্য একাধিক প্রার্থী বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আসনভিত্তিক সম্ভাব্য সব প্রার্থীকে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা তাদেরকে জানিয়েছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরাও ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তারা বলেছেন, সামনে যাকেই একক প্রার্থী করা হোক না কেন, ঐক্যবদ্ধভাবেই তাকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালাবেন। সবার লক্ষ্য থাকবে ধানের শীষের প্রার্থীকেই জয়ী করা।
বৈঠকে অংশ নেয়া একজন প্রার্থী বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে স্থায়ী কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা তাদেরকে জানিয়েছেন যে, আগামী মাসের মধ্যে দেড় শ’ থেকে দুই শ’ আসনে দলের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করে ঘোষণা করা হতে পারে। প্রস্তুতি প্রায় শেষ দিকে।
এ দিকে জটিলতাপূর্ণ আসনগুলোর সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকরাও কাজ করছেন। এর অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিভিন্ন আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে নিয়মিত বৈঠক করছেন তারা। এসব বৈঠকেও দলের নির্দেশনা তুলে ধরে প্রার্থীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম বলেন, কেন্দ্রের নির্দেশে আমরা বিভিন্ন আসনের নেতাদের নিয়ে নিয়মিত বসছি। এসব বৈঠকের উদ্দেশ্য একটাই, আগামীতে দল যাকেই মনোনয়ন দেবে, তার পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে সবাইকে কাজ করতে হবে। কোনো ভেদাভেদের সুযোগ নেই। কবে নাগাদ প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হবে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কেন্দ্র শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেবে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতা গতকাল আলাপকালে নয়া দিগন্তকে বলেন, আগামী নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীই তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। দলটি অনেক আগেই তাদের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করেছে। সেই অনুযায়ী প্রতিটি আসনে প্রার্থীরা পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনের মাঠে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা প্রতিটি ভোটার টার্গেট করে ডোর টু ডোর যাচ্ছেন। অন্য দিকে আমাদের দলে এখনো প্রার্থিতা চূড়ান্ত হয়নি। ফলে সম্ভাব্য সব প্রার্থীই নিজেদের মতো করে বিচ্ছিন্নভাবে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে করে গ্রুপিংও বাড়ছে। কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে এভাবে ক্যাম্পেইনের পর্ব এখনি শেষ হওয়া উচিত। একইসাথে পুরো দলকে ঐক্যবদ্ধ করে জনবান্ধব নানা কর্মসূচি নিয়ে নির্বাচনের মাঠে নামিয়ে দেয়া উচিত।
জানা গেছে, বিএনপির গত দুইটি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। সেখানে প্রার্থীদের ডোর টু ডোর ক্যাম্পেইনের উপর জোর দেয়া হয়েছে। তবে তার আগে প্রার্থী জটিলতাও নিরসন করার বিষয়ে মতামত দেন শীর্ষ নেতারা। দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে কাকে কোন আসনে ধানের শীষের প্রার্থী করা হচ্ছে, সে বিষয়টি প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত করা হবে। এ দিকে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত এক নেতা জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে একই পরিবার থেকে একাধিক প্রার্থী নির্বাচনের প্রত্যাশা করছেন। এসব প্রার্থীরা যোগ্যতাসম্মন্ন; কিন্তু দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে- একই পরিবার থেকে একাধিক প্রার্থীকে এবার মনোনয়ন দেয়া হবে না।