
খাগড়াছড়িতে এক মারমা কিশোরী ধর্ষণের কথিত অভিযোগ তুলে চলছে ব্যাপক অরাজকতা। শহরে প্রশাসনিক তৎপরতা বাড়ানোয় গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সহিংসতা। এরই অংশ হিসেবে গতকাল রোববার দিনভর জেলার গুইমারা এলাকাসহ আশপাশের এলাকায় বাঙালিদের বাড়িঘর ও স্থাপনায় হামলা হচ্ছে। সংঘর্ষে তিনজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ সহিংসতা পুরো পার্বত্যাঞ্চল, এমনকি গোটা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, পাহাড় অশান্ত করতে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত হচ্ছে। হাত আছে বিশেষ মহলেরও। তারা ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এবার স্থানীয় দুটি সশস্ত্র ও বিবদমান সংগঠন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)’ ও ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে (ইউপিডিএফ)’ ঐক্যবদ্ধ করছে। আর পুরো বিষয়টি তত্ত্বাবধান করছে ভারত। যার মধ্যস্থতায় আছেন প্রতিবেশী দেশটির রাজধানী দিল্লিতে বসবাসরত দিঘিনালার এক কথিত বৌদ্ধ ভিক্ষু বা ধর্মগুরু।
এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে খাগড়াছড়িতে ওই সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে চলমান অস্থিরতায় জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের প্রতি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নামার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে আরেক সশস্ত্র সংগঠন ইউপিডিএফ।
স্থানীয় কয়েকটি সূত্র জানায়, এই আহ্বান শুধু আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। মূলত ভারতের মধ্যস্থতায় কয়েক মাস আগেই বিবদমান দুই পক্ষের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে সমঝোতা হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে জড়িত দুই পক্ষের তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে ধর্ষণের অভিযোগকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তারা আরো জানায়, চলতি বছরের ৩ থেকে ১০ মের মধ্যে জেএসএসের তাত্ত্বিক নেতা সন্তু লারমা আর ইউপিডিএফের দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে দুই দফায় সমঝোতা বৈঠক হয় দিল্লিতে। গত ২৭ জুলাই ওই গোপন বৈঠকের খবর প্রকাশ করে আমার দেশ। বৈঠকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর এক কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। এতে দুই পক্ষকেই আশ্বস্ত করা হয় যে, কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা ছড়িয়ে দিতে সহিংসতায় নেপথ্যে থেকে অর্থনৈতিক ও লজিস্টিক সহায়তা করবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গা-ঢাকা দিয়ে থাকা আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। চাঞ্চল্যকর ওই খবর প্রকাশের পরও সরকারের উদাসীনতা আর প্রশাসনের পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাবে দুই মাসের মধ্যে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।
সহিংসতার নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের পরিকল্পনা আছে খাগড়াছড়ির পর একদিনে রাঙামাটি ও বান্দরবানে কথিত এই আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়া হবে। একইসঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মানুষদেরও মাঠে নামানো হবে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামানোর টার্গেট রয়েছে কথিত এই আন্দোলনের নেপথ্যের কারিগরদের। এসব কর্মসূচি থেকে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে উসকানি দিয়ে ছাত্রসমাজকে বিভ্রান্ত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জোর তৎপরতা চলছে।
সহিংসতার সূত্রপাত যেভাবে
গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাত আনুমানিক ৯টার দিকে খাগড়াছড়ির সিঙ্গিনালা এলাকায় প্রাইভেট পড়া শেষে বাড়ি ফেরার সময় অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া এক মারমা কিশোরী অপহরণের শিকার হয়েছে বলে প্রচার করা হয় কথিত জুম্ম আন্দোলনে সক্রিয় ফেসবুক পেজ থেকে। পরদিন ভোরে অজ্ঞাত পরিচয়ের তিনজনের বিরুদ্ধে ওই শিক্ষার্থীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করা হয়। কিন্তু কথিত ভুক্তভোগী ছাত্রীর মেডিকেল পরীক্ষায় ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। অথচ এই অজুহাতে বাঙালিদের বাড়ি ও স্থাপনায় হানা দিচ্ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উচ্ছৃঙ্খল যুবকরা। হামলা-ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটছে। গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে বাঙালি তরুণ নয়ন শীলকে।
কথিত অভিযোগকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর বাজারে অবস্থিত পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠন ইউপিডিএফের প্রধান কার্যালয় থেকে আন্দোলনের নামে অস্থিরতা ছড়ানো হয়। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন উখ্যানু মারমা নামের এক ইউপিডিএফ নেতা। যদিও ‘জুম্ম ছাত্র জনতা’ নামের আলাদা একটি সংগঠনের ব্যানারে তিন পার্বত্য জেলায় বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।
উসকানি ছড়ানো হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে
পার্বত্য চট্টগ্রামের এ ঘটনায় অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অযাচিতভাবে টেনে আনা হচ্ছে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনীকে টার্গেট করে নেতিবাচক প্রচার চালানো অর্ধশতাধিক ফেসবুক পেইজ ও অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। যার অধিকাংশই পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা থেকে ভারতীয় নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। এসব পেজ থেকেই গত এক বছর ধরে সরকারের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো ও পতিত আওয়ামী লীগের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করা হচ্ছে।
গত এক সপ্তাহ ধরে তারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করতে সক্রিয় রয়েছে। রাঙামাটি চাকমা সার্কেলের চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের দ্বিতীয় স্ত্রী ইয়ান ইয়ান রাখাইন তার ফেসবুক আইডি থেকে উসকানিমূলক পোস্ট প্রচার করছেন। একইভাবে কানাডা প্রবাসী প্রজ্ঞা তাপস চাকমা (ফেসবুক আইডি PT Chakma) সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ঘেরাও করার মতো উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়কে উত্তেজিত করার অপচেষ্টা চালিয়ে আসছেন।
সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা
দেশের ভেতরে রাজনৈতিক ইস্যুতে মাঠে নামার চেষ্টা করলে গণপ্রতিরোধের মুখে পড়বে পতিত আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীরা। তাই কৌশলে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্পর্শকাতর ইস্যু নিয়ে এগোতে চাইছে পলাতক সন্ত্রাসীরা। এজন্য বড় একটি পরিকল্পনাও করেছে তারা। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে অনলাইন আর অফলাইন দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। গত এক বছর ধরেই এই পরিকল্পনা চললেও তা জোরেশোরে শুরু হয়েছে গত তিন মাস ধরে ভারতে দুই পক্ষের সমঝোতা বৈঠকের পর থেকে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ব্যাখ্যা
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শহীদ উল্লাহ চৌধুরী জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে পার্বত্য এলাকাকে কেন্দ্র করে যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, এগুলো একটির পর একটি সাজালে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এখানে পতিত আওয়ামী লীগ আর ভারতের ষড়যন্ত্র রয়েছে। তারা যে কোনো মূল্যে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করতে চায়। কারণ, পাহাড়ে বসবাস করা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি পশ্চিমাদেরও একটা সহানুভূতি আছে। তাই এখানে অস্থিরতা তৈরি করতে পারলে তাদেরও বিভ্রান্ত করা যাবে। কদিন আগে ত্রিপুরার রাজা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের সঙ্গে একীভূত করার দাবি জানিয়েছেন। এটিও সুদীর্ঘ পরিকল্পনারই অংশ।
তিনি আরো বলেন, এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সরকারকে খুব কৌশলী হতে হবে। পার্বত্য এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি দ্রুত বাড়াতে হবে। কিন্তু তাদের অনেক ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আগ্রাসী হতে অনেক উসকানি দেবে কথিত আন্দোলনকারীরা। কিন্তু সেই উসকানিতে পা দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতাও বাড়াতে হবে সরকারকে।
এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের আসল চিত্র কূটনৈতিক চ্যানেলে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে হবে। কারণ, ইতোমধ্যে ভারতীয় মিডিয়া বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা শুরু করেছে। দেশে থাকা আওয়ামীপন্থি বুদ্ধিজীবী ও তাদের এনজিওগুলোও সক্রিয় হচ্ছে। এগুলো প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে খুব কৌশলে মোকাবিলা করতে না পারলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠবে।
প্রশাসনের অবস্থান
চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ড. জিয়াউদ্দিন বলেন, প্রশাসনের সব শাখা পার্বত্য এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চেষ্টা চালাচ্ছে। এরপরও একটি মহল নতুন নতুন এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করা হচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
দুটি শসস্ত্র গ্রুপ এক হচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব বিষয়ের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে।