
ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আবারও বাড়ছে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পরিবারতান্ত্রিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ দল আওয়ামী লীগ, নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ও অনুসারীদের তৎপরতা। তারা সংগঠিত হয়ে হঠাৎ সড়কে নেমে ঝটিকা মিছিল করে উধাও হয়ে যাচ্ছেন।
ওইসব ঝটিকা মিছিলের ভিডিও তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য। বিষয়টি এরইমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে এসেছে। অনেকে বিষয়টি নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলছেন।
চলতি বছরের প্রথম কয়েক মাসে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নামে তেমন কোনো তৎপরতা না থাকলেও তারা ছদ্মবেশে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেয়।
তবে সেপ্টেম্বরে হঠাৎ করেই তাদের প্রকাশ্য কার্যক্রম বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও তাদের দোসররা এমনিতেই ভয়ে পালিয়ে যান।
শুরুর দিকে সাংগঠনিকভাবে তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা না হলেও কার্যত জনগণের কাছে তারা নিষিদ্ধই ছিলেন।
তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে দেশের কয়েকটি স্থানের পাশাপাশি ঢাকার দুই-এক জায়গায় ভোরের দিকে আওয়ামী নেতা-কর্মীদের মিছিলের সংবাদ পাওয়া যায়। কিন্তু চলতি সেপ্টেম্বর মাসে সকাল, দুপুর, বিকেল—প্রায় সময়েই ঢাকায় তাদের বিক্ষোভ মিছিল দেখা যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এই কার্যক্রম প্রতিরোধে শুধু গ্রেপ্তার নয়, জমায়েতের শুরুতেই ব্যবস্থা নিতে হবে। গোয়েন্দা কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করতে হবে। এ রকম মাস্টার প্ল্যান নিয়ে পুলিশ বাহিনীকে কাজ করতে হবে।
এই কর্মকর্তা বলেন, এলাকায় এলাকায় থানা পুলিশের টহল ডিউটির পাশাপাশি পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের গোয়েন্দা সদস্য ও র্যাবের গোয়েন্দারাও নজরদারিতে থাকেন। এত নজরদারির পরও সাংগঠনিকভাবে নিষিদ্ধ একটি সংগঠন কীভাবে প্রকাশ্যে মিছিল করতে পারে, সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে।
তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার—মিরপুর এলাকায় পৃথক স্থানে দুটি এবং বাংলামোটর ও গুলশানে পৃথক দুটি বিক্ষোভ মিছিলের ঘটনা দেখা গেছে। ফ্যাসিস্ট তৎপরতার প্রতিরোধে পুলিশের পাশাপাশি জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে।
ঝটিকা মিছিল ও পুলিশের ব্যবস্থা
গত শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বাংলামোটর জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) অফিসের সামনে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের কয়েক নেতাকর্মী ও অনুসারী জড়ো হয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে শুরু করে এবং বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের দিকে অগ্রসর হয়।
মিছিলের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরও সন্ধ্যায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বাংলামোটর-গুলশান এলাকায় ঝটিকা মিছিলের প্রস্তুতির সময় ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন— যদি গ্রেপ্তার প্রস্তুতিকালে করা হয়, তাহলে প্রকাশ্যে শত শত মানুষের মিছিল কীভাবে সম্ভব হলো? এ ছাড়া প্রশ্ন উঠছে, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভের আগে কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের নেতাকর্মীরা কীভাবে সেখানে জড়ো হতে পারলেন?
পুলিশ বলছে, বৃহস্পতিবার বিকেলে মিরপুরের দারুসসালাম এলাকার টেকনিক্যাল মোড়ে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ঝটিকা মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। স্থানীয়দের সহায়তায় পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে অভিযান চালিয়ে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে।
একইদিন দুপুরে মিরপুরের পাইকপাড়া ডি-টাইপ স্টাফ কোয়ার্টারের ১ নম্বর গেট এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সরকারবিরোধী স্লোগান দিচ্ছিলেন এবং নাশকতার পরিকল্পনা করছিলেন। মিরপুর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, বাকিরা পালিয়ে যায়।
২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বনানীতে ভোরে নিষিদ্ধ ঘোষিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কয়েকজন ঝটিকা মিছিল করেছে। মিছিলের ব্যানারে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে স্লোগান ছিল। বনানী থানা সেদিনই গণমাধ্যমকে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে। সকাল ৬টার দিকে মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। তবে এ ঘটনায় এখনও কাউকে আটক করা যায়নি।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় তাদের কার্যক্রম ও বিক্ষোভ মিছিল করার চেষ্টা করলেও পুলিশ তা প্রতিহত করছে। শুক্রবার বাংলামোটর ও গুলশান থেকে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কার্যক্রম নিষিদ্ধ এরকম যেকোনো সংগঠন ঢাকার সড়কে অথবা যে কোন জায়গায় বিশৃঙ্খলা করতে না পারে ডিএমপির সব থানার পুলিশ সবসময় প্রস্তুত থাকে। এ ছাড়া পুলিশের বিভিন্ন গোয়েন্দা ইউনিট কাজ করছে বলেও জানান তিনি।
শনিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনেরর ঝটিকা বিক্ষোভ মিছিল প্রতিরোধের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেককে গ্রেপ্তার করেছে।
গত ৮ মে ২০২৫ সালে রাতে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যে’র ব্যানারে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১০ মে ২০২৫ সালে সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান মামলার রায় না আসা পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে।
গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে সরকারে থাকা দল আওয়ামী লীগের পতন হয়। এরপর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। তার দলের নেতাকর্মীরা অনেকে আত্মগোপনে যান, গ্রেপ্তার হন।