Image description

চ্যালেঞ্জটা বহুমাত্রিক। বাধা পদে পদে। জয়ের পথে প্রতিবন্ধকতা পর্বতসম! তবুও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮১তম অধিবেশনের প্রেসিডেন্ট পদে লড়ছে বাংলাদেশ। নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থিতার প্রশ্নে এখনো অনড় ঢাকা! 

কূটনৈতিক সূত্র বলছে, চলতি মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে নিউ ইয়র্ক থেকে আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু করবে বাংলাদেশ। দেশে দেশে সেই প্রচারণা চলবে আগামী বছরের মে পর্যন্ত। মর্যাদাপূর্ণ ওই লড়াইয়ে বাংলাদেশের প্রার্থী অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। ২০২৬ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠেয় ওই নির্বাচনে ফিলিস্তিনের মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ। এতে জয় পাওয়া ঢাকার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন পেশাদার কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ফিলিস্তিনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের গভীরতা পরিমাপযোগ্য নয়। এটি স্বতন্ত্র এবং অতুলনীয়। নির্যাতিত ফিলিস্তিনের পক্ষে জন্মলগ্ন থেকে রয়েছে বাংলাদেশ। মানবিক এই সম্পর্কে গত ৫৪ বছরে কোনো ঘটনা বা স্বার্থ একটুও চিড় ধরাতে পারেনি। বরং ফিলিস্তিনিদের স্বপ্ন ও অধিকারের প্রতি দল-মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণ এবং এ দেশের সমুদয় সরকারের সমর্থন ছিল প্রকাশ্য। গত সপ্তাহেও জাতিসংঘের ভোটাভুটিতে ফিলিস্তিনের পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে বাংলাদেশ। 
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিদ্যমান সেই সম্পর্কের কাঁটা হতে চলেছে অত্যাসন্ন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন। সংশ্লিষ্টদের দাবি, শেখ হাসিনা আমলে বাংলাদেশ  জাতিসংঘের ৮১তম অধিবেশনের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। তখন অবশ্য ফিলিস্তিনের প্রার্থিতার কোনো আলাপ বা সুযোগ ছিল না। সেগুনবাগিচার দাবি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে এবারে বাংলাদেশের প্রার্থিতার বিষয়টি আগের সরকারের ধারাবাহিকতায়। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টা মানবজমিন-এর সঙ্গে আলাপে এটা স্বীকার করেছেন যে, গুরুত্বপূর্ণ ওই সিদ্ধান্তের আগে উপদেষ্টা পরিষদে কোনো আলোচনা হয়নি। 

ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নির্বাচন করার বিষয়টি খোদ প্রধান উপদেষ্টা জানেন কিনা? তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বশীল এক উপদেষ্টা। স্মরণ করা যায়, ’৮০-এর দশকে জাতিসংঘের ৪১তম সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে বাংলাদেশ নির্বাচিত হয়েছিল। তখন খ্যাতিমান কূটনীতিক তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী (পরবর্তীতে জাতীয় সংসদের স্পিকার) হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এই পদে মনোনয়ন এবং নিরংকুশ জয় পেয়েছিলেন। সেই থেকে ঠিক ৪০ বছর পর এবার ফের নির্বাচনে বাংলাদেশ। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রার্থিতার শুরুটা হয়তো ঠিক ছিল, কিন্তু সময় এবং পরিস্থিতি এখন নানা কারণে বাংলাদেশের জন্য অনুকূলে নেই। প্রথমত, বাংলাদেশকে ফিলিস্তিনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে! মুসলিম বিশ্ব তো বটেই ইউরোপ এবং আফ্রিকায়ও এখন ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতিশীল রাষ্ট্র অনেক। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক যে কোনো নির্বাচনে জিততে হলে রাষ্ট্র এবং সরকারের একনিষ্ঠ অ্যাফোর্ট দিতে হবে। যেটা বাংলাদেশে এই মুহূর্তে পুরোপুরি অনুপস্থিত। তৃতীয়ত, বর্তমান সরকারের মেয়াদ, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঘোষণা এবং পরবর্তী সরকারে বর্তমান প্রার্থিতার সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন।
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা মতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে হবে বহুল আকাঙ্ক্ষিত পরবর্তী জাতীয় সংসদ সংসদ নির্বাচন। নিশ্চিতভাবে মার্চের মধ্যে হবে নতুন রাজনৈতিক সরকার। সেই সরকারে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি পদে বাংলাদেশের প্রার্থী বর্তমান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের অবস্থান বা ভূমিকা কী হবে তা সবার অজানা। এমন অনিশ্চিত অবস্থায় যে কোনো প্রার্থীর জয় পাওয়া দুষ্কর। যদিও এটা চাউর আছে যে, ব্যক্তি মিস্টার হোসেনের বিএনপি, জামায়াত তো বটেই, নাগরিক সমাজেও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। হয়তো পরবর্তী সরকার তার প্রার্থিতায় কোনো পরিবর্তন আনবে না।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘে সাধারণত পাঁচটি আঞ্চলিক গ্রুপ থেকে পালাক্রমে এই পদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এবারের পালা এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের। এই গ্রুপ থেকেই এবার তিনজন প্রার্থী লড়ছেন- বাংলাদেশ, ফিলিস্তিন ছাড়াও মাঠে আছে সাইপ্রাস। যদিও সাইপ্রাস ভৌগোলিকভাবে ইউরোপের অংশ। তবুও তারা জাতিসংঘের গঠনতান্ত্রিক নিয়ম অনুযায়ী এশিয়া-প্যাসিফিক গ্রুপের সদস্য। সাধারণত এই ধরনের নির্বাচন সমঝোতার ভিত্তিতে হয়। কিন্তু এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশ জোরালো হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সক্রিয় ভূমিকা, শান্তিরক্ষা মিশনে অবদান এবং প্রার্থীর ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা এই নির্বাচনে বড় ভূমিকা রাখবে এমনটা আশা করে এক কর্মকর্তা বলছেন- সাইপ্রাসের বিরুদ্ধে তুরস্ক সক্রিয়। ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কারও প্রকাশ্যে তেমন বৈরিতা এখনো নেই। আমরা সেটাই কাজে লাগতে চাই। ওই কর্মকর্তার কাছে প্রশ্ন ছিল- অতীতে জাতিসংঘের বিভিন্ন নির্বাচনে বন্ধু রাষ্ট্র জাপানসহ অনেক দেশকে ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ। এবারে ফিলিস্তিনকে ছাড় না দিয়ে জাতিগত ধ্বংসযজ্ঞের শিকার দেশটির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রার্থিতা কতটা ন্যায়সঙ্গত? জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, ফিলিস্তিন পরে প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে ২০২০ সালে। পাঁচ বছর আগে। সেক্ষেত্রে ফিলিস্তিন বাংলাদেশকে ছাড় দিতে পারতো। তারা আলোচনা পর্যন্ত করেনি। তাছাড়া তাদের ছাড় দিলেও জিততে পারবে এমন নিশ্চয়তা নেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল তাদের ওই চেয়ারে বসতে দেবে বলে মনে হয় না।