Image description

বেশ কয়েকটি ইস্যুতে জটিল সমীকরণে রূপ নিচ্ছে রাজনীতি। ইস্যুগুলোর মধ্যে রয়েছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা বা ‘রিফাইনড ফর্মুলা’য় আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফেরানো, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার, গণপরিষদ নির্বাচন করে সংবিধান সংশোধন, জুলাই গণহত্যার বিচার ও জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এসব বিষয়ে গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধান না আসায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়েও সংশয় তৈরি হচ্ছে। তবে সরকার থেকে বারবার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে।

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর গত ২৩ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘যে কোনো পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারে সমর্থন রয়েছে তার। আগামী (ওই সময় থেকে) ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে, সে জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে এই সরকারকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতির কথা জানান তিনি।’ সে হিসেবে চলতি বছরের ডিসেম্বর বা আগামী বছরের জুনে নির্বাচন হতে পারে।

দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি চলতি বছরের জুনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে। তারা স্বল্প সময়ে সংস্কার করে ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষেও মত দিয়েছে।

অন্য বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বলছে, সংস্কার ও গণহত্যার বিচার করে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষেও জামায়াতের সমর্থন রয়েছে।

নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারা বলছেন, ‘আগে সংস্কার, গণহত্যার বিচার, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। রিফাইনড বা অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়ার বিপক্ষেও অবস্থান নিয়েছে ছাত্ররা। তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচন করে সংবিধান সংশোধন ও জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এরই মধ্যে তারা ভোটার হওয়ার বয়স ১৬ করাসহ বেশ কিছু প্রস্তাবও তুলে ধরেন। তারা জেন-জিদের ভোটার করতে ভোটার হওয়ার বয়স ১৬ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ন্যূনতম বয়স ২৩ বছর প্রস্তাব করেছে।

এদিকে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর স্বাভাবিক হয়নি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জনসাধারণের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। ভয়ানক রূপ নিয়েছে মব জাস্টিস ও গণপিটুনি দিয়ে হত্যার মতো নৃশংস অপরাধ। এরই মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বৈঠকে আগামী ডিসেম্বরকে নির্বাচনের সময় ধরে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।

দেশে দ্রব্যমূল্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণ থাকলেও নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না। আসছে না নতুন বিনিয়োগ। সাধারণ মানুষ মনে করছে, দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার জন্য প্রয়োজন নির্বাচিত সরকার। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যেভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, সেটা অনির্বাচিত বা অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে সম্ভব নয়। নির্বাচিত সরকারের জন্য প্রয়োজন নির্বাচন। কিন্তু সেই নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচি ও তপশিল নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

যদিও এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন ও গণপরিষদ নির্বাচনের বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে আরও এক বছর সময় প্রয়োজন। তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে নয়—এমনটাই জানিয়েছেন। আগামী ডিসেম্বরকে নির্বাচনের সময় ধরে প্রস্তুতিও নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন।

গত শুক্রবার রাজধানীর ইস্কাটনের লেডিস ক্লাবে পেশাজীবীদের সম্মানে বিএনপি আয়োজিত ইফতার মাহফিলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, চলমান জটিল সংকট উত্তরণে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার প্রয়োজন। তিনি বলেন, এখন সমস্যা সমাধানের জন্য অত্যন্ত দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠান দরকার। নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় যে সংস্কার দরকার, সেগুলোকে সম্পন্ন করে নির্বাচন অনুষ্ঠান করাই হবে সবচেয়ে বড় উইজডমের (প্রজ্ঞা) কাজ।

অন্যদিকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল শনিবার বলেছেন, ‘সংস্কার আগে না নির্বাচন পরে, কিংবা নির্বাচন আগে না সংস্কার পরে’ এ ধরনের অনাবশ্যক বিতর্কের অবকাশ নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠন প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত থাকায় জনমনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রশাসন যন্ত্রকে ব্যবহার করার নানা প্রকার লক্ষণ ও প্রমাণ ক্রমেই প্রকাশ পাচ্ছে, যা দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য মোটেই সুখকর নয়। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের করণীয় হচ্ছে ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা এবং নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা। কেননা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ এবং ন্যায়বিচার ও সুশাসন নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ নির্বাচিত সরকারের পক্ষেই গ্রহণযোগ্য সংস্কার সম্পাদন সম্ভব।’

আলোচনায় এনসিসি নামক নতুন ফ্রেম: এদিকে গতকাল গুলশানে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল (এনসিসি) নামে একটি ফ্রেমের প্রস্তাব করা হয়েছে। সেটার গঠন প্রক্রিয়া ও কার্যপরিধি যেগুলো বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে সব স্তরে দেখা যায় অনির্বাচিত বিভিন্ন ব্যক্তিরা এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবেন এবং সাংবিধানিকভাবে তাদের ক্ষমতায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। তাতে দেখা যাবে, নির্বাচিত প্রতিনিধির আর কোনো গুরুত্ব নেই। প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি রাষ্ট্রের অনির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সম্পন্ন হবে, যদি এগুলো গৃহীত হয়।’

কোনো দাবির মুখে নির্বাচন পেছাবে না সরকার: এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং কোনো দাবির কারণে ভোট পিছিয়ে দেওয়া হবে না। গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ড. কমফোর্ট ইরোর নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনায় অধ্যাপক ইউনূস জানান, সরকার নির্বাচনের জন্য দুটি সম্ভাব্য সময়সীমা নির্ধারণ করেছে এবং নির্ধারিত তারিখ পরিবর্তন করা হবে না। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, যদি রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে সীমিতসংখ্যক সংস্কার চায়, তাহলে নির্বাচন এই বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে। আর যদি বৃহত্তর সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনের কোনো কারণ নেই। পাশাপাশি, তিনি জোর দিয়ে বলেন আসন্ন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে।

রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বিষয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে দলের যেসব নেতার বিরুদ্ধে হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, তাদের বাংলাদেশের আদালতে বিচার করা হবে।’ তার মতে, ‘জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সম্ভাব্য অপরাধের অভিযোগ থাকায় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি), হেগ-এ মামলা করার বিষয়টি সরকার বাতিল করেনি। এটি এখনো আলোচনার টেবিলে রয়েছে।

বিশ্লেষক মহল বলছেন, ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনৈতিক চিত্র ক্ষণে ক্ষণে পাল্টাচ্ছে। ক্রমেই জটিল সমীকরণে রূপ নিচ্ছে রাজনীতি। শেখ হাসিনার পতনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য স্পষ্ট হলেও সময়ের পরিক্রমায় তাতে যেন চিড় ধরেছে। দলগুলো তাদের নিজস্ব রাজনীতি আর কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। বছরের পর বছর যারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভোটাধিকারসহ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে রাজপথে শামিল ছিলেন, মাত্র সাত মাসের মাথায় এসে তাদের বিরোধ এখন প্রকাশ্য হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে তৃতীয় কোনো পক্ষ সুযোগ নিতে চেষ্টা করবে। তবে সেটি হতে দেওয়া যাবে না। যে কোনো মূল্যে ঐক্য ও স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে হবে।

রাজনীতিতে কেন জটিল সমীকরণ: জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। উদ্ধার হয়নি থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র। দেশের আমলাতন্ত্রও এখনো স্বাভাবিক নয়। ফ্যাসিবাদের দোসর অনেকে এখনো প্রশাসনের কেন্দ্রে রয়ে গেছে। ফলে নির্বাচিত সরকার ছাড়া এই গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে না। এ ছাড়া আগে সংস্কার, নাকি সংসদ নির্বাচন? কিংবা আগে জাতীয় নির্বাচন নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন এ বিষয় নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি বিরোধ অনেকটা প্রকাশ্য। পরস্পরের বিরুদ্ধে বক্তব্য পাল্টা বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এনসিপি ও গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্রদের বক্তব্যের সঙ্গে জামায়াত নেতাদের বক্তব্য মিলে যাচ্ছে।

পতিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ যে কোনো পক্রিয়ায় আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে কী হবে—সেটিও এখন ভাবনার বিষয়। দলটি নিষিদ্ধ করা নিয়েও চলছে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সম্প্রতি বলেছেন, ‘গণহত্যা বা অন্য কোনো অপরাধে অভিযুক্ত নন, এমন আওয়ামী লীগারদের নির্বাচনে বাধা নেই’। অবশ্য, এ বিষয়ে তাদের চিন্তাভাবনায় এখন অনেক পরিবর্তন ঘটেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে কি পারবে না, তা গণহত্যার বিচারের পর জনগণ ঠিক করবে। বিচারের পর জনগণ আওয়ামী লীগকে রাজনীতির সুযোগ দিলে সেখানে আমাদের কিছু বলার নেই।’

জানা যায়, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। গত ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। শুরুতেই দেশের সর্বস্তরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবি উঠলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গুরুত্বপূর্ণ খাতের কতগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করেন। এরই মধ্যে সব কমিশন তাদের সংস্কার প্রস্তাব বা রূপরেখা প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করেছেন। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা সংলাপও করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সংস্কার ইস্যুতে মতামত চেয়ে চিঠি দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তরফে একাধিকবার বলা হয়েছে যে, আগে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কার। এরপর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার করা হবে। তারপর একটি গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিদায় নেবে। সে মোতাবেক ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের অগ্রাধিকার বিষয় হলো—রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার, গণহত্যাকারীদের বিচার এবং সবশেষে একটি সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

অন্যদিকে বিএনপি শুরু থেকেই সরকারকে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে আসছে। এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে কয়েক দফা দেখা করে প্রয়োজনীয় প্রস্তাব এবং নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছে দলটি। এই ইস্যুতে সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে দেশের সব বিভাগ ও মহানগরে সমাবেশ করেছে বিএনপি। বিএনপি শুরু থেকেই দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলে আসছে।

এদিকে জামায়াতে ইসলামী চাইছে, সংস্কার ও গণহত্যার বিচার শেষে যৌক্তিক সময়েরমধ্যে নির্বাচন। অন্যান্য দলের অবস্থানও কমবেশি একই। কিন্তু ছাত্রদের নতুন দল এনসিপি বলছে, গণপরিষদ নির্বাচনের কথা। যেটাকে বিএনপি দেখছে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র হিসেবে। যদিও সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন আগে—এমন প্রশ্নের মধ্যে দ্রুত নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক চাপ তৈরি করে বিএনপি। সরকার অবশ্য এরই মধ্যে আগামী ডিসেম্বর ধরে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমার কথা জানিয়েছে।

তবে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির নেতারা বলছেন, ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে আন্দোলন দমনের নামে যাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার ও অসংখ্য মানুষ হত্যার অভিযোগ আছে, সুষ্ঠু তদন্ত ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে সবার আগে তাদের বিচার হতে হবে। এ নিয়ে দ্বিমত নেই এবং তার আগে নির্বাচন নিয়ে যাতে কেউ কথা না বলে। কেননা, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এক স্বৈরাচারের বিদায় মানেই আরেকটি দলকে ক্ষমতায় বসানো নয়। গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনামলে দেশের পুলিশ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচনী ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসহ প্রতিটি ক্ষেত্র যেভাবে ধ্বংস হয়েছে; নির্লজ্জ দলীয়করণের মধ্য দিয়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা যেভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি অবাধে লুটপাট করে দেশকে খাদের কিনারে নিয়ে গেছেন—এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বড় ধরনের সংস্কার এবং কোথাও কোথাও পরিবর্তন আনতে হবে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশের দিন এনসিপি বলছে—দেশে সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করা হবে।

নতুন সমীকরণ প্রশ্নে যা বলছেন রাজনীতিকরা: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান আজাদ কালবেলাকে বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়ো না করে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার পক্ষে জামায়াত। যেহেতু দেশের অধিকাংশ মানুষ চায় সংস্কার। আমরাও সেটির পক্ষে। তবে সংস্কার যাতে দীর্ঘায়িত না হয়।’

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিছু সংস্কার করছে। তার মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কার আছে। অনেকে সংস্কার চায় না, নির্বাচন চায়। আমরা চাই আগে সংস্কার হবে এবং পরে নির্বাচন হবে।’

১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ‘স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনটি জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, সেজন্য মানুষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে, গণতন্ত্র উত্তরণের পথ সেটাকে তারা পূরণ করতে চায়। আমরা বলছি, প্রয়োজনীয় সংস্কার করুন। কিন্তু সেটা কতদিন? দেশের অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা ও দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বুঝতে হবে স্থানীয় সরকার দেশ চালায় না; দেশ চালায় কিন্তু জাতীয় সংসদ। সুতরাং অবিলম্বে দেশের স্থিতিশীলতা ফেরাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিকল্প নেই।’

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য বদরুল আলম চৌধুরী শিপলু বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের মানুষের সম্মতিতেই ক্ষমতায় বসেছে। আমরা একটি নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলছি। যাতে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন ঘটতে পারে। যারাই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন তারাই সরকার গঠন করবেন। সেটিই হলো গণতন্ত্র। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করাই বর্তমান সরকারের মূল দায়িত্ব। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত হবে কালবিলম্ব না করে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা।’

নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার গতকাল শনিবার এনসিপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ পরিষ্কারভাবে একটি দেশবিরোধী শক্তি এবং ভারতের এজেন্ট। তারা যদি আন্দোলনে নামে, সেটাকে আমরা আন্দোলন বলব না। তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য নামবে। সে ক্ষেত্রে পুলিশের যে বল প্রয়োগের অধিকার আছে, সেটা থাকবে।’

এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব জয়নাল আবেদিন শিশির গতকাল কালবেলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ হচ্ছে গণহত্যাকারী ও গণঅভ্যুত্থানে পরাজিত এবং পলায়নকারী দল। যারা গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যায়, তাদের পুনর্বাসনের নজির বিশ্বের কোথাও নেই। অতীতে আওয়ামী লীগকে বেশ কয়েকবার পুনর্বাসন করা হয়েছে। এবারও বিদেশি একটি চক্র এ বিষয়ে চক্রান্ত করছে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। আমরা দেশবাসীকে নিয়ে সব ষড়যন্ত্র রুখে দেব, ইনশাআল্লাহ। তিনি আরও বলেন, আমরা বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানাই। সেইসঙ্গে নিষিদ্ধ হওয়ার আগে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রমেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।’

এদিকে এবি পার্টি জানিয়েছে, ‘নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে’ সংবিধান সংশোধন বর্তমান সংবিধানের আলোকে অগ্রহণযোগ্য। বর্তমান সংবিধান স্থগিত বা বাতিল না করে অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা বর্তমান সংবিধান সাপেক্ষে বেআইনি। তবে বর্তমান সংবিধান স্থগিত করে জুলাই বিপ্লবের চেতনার আলোকে প্রস্তাবিত সাংবিধানিক বিধানগুলো পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে নতুন সংবিধান পুনর্লিখন করা যেতে পারে। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে আপিল বিভাগের কাছে সরকার অধিকতর সাংবিধানিক ব্যাখ্যা চাইতে পারে। দলটির নেতারা সংস্কার শেষে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পক্ষে।

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু কালবেলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ অবশ্যই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে, তবে তার আগে তারা যাদের নৃশংসভাবে খুন করেছে সেই হাজার হাজার সন্তানহারা মায়ের কোলে তাদের সন্তানদের ফিরিয়ে দিতে হবে। যাদের পৈশাচিক নির্যাতন করে পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে তাদের চোখ, হাত, পা ফেরত দিতে হবে। আমাদের লুট করা লাখ লাখ কোটি টাকা ফেরত আনতে হবে।’ তিনি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অধিকার নির্ধারণের জন্য প্রয়োজনে গণভোট দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, ‘সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে হবে।’

বিশ্লেষক যা বলেন: দেশের চলমান রাজনৈতিক জটিল সমীকরণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক বিশিষ্ট বিশ্লেষক ড. শামছুল আলম সেলিম কালবেলাকে বলেন, ‘কোনো ধরনের লুকোচুরি না করে দ্রুততার সঙ্গে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যেটা তারা (বৈষম্যবিরোধী) চাচ্ছে যে, নির্বাচন বিলম্বিত করা। এজন্য তারা একটার পর একটা ইস্যু নিয়ে আসছে। কাউকে কাউকে টার্গেট করছে। যাতে নিজেদের মধ্যকার ঐক্যটা ভেঙে যায় এবং অন্য শক্তি আবার এখানে ফিরে আসুক। এটাই চাওয়া হচ্ছে। না হলে একটার পর একটা ইস্যু কেন ওঠানো হচ্ছে? তিনি বলেন, হঠাৎ করেই কেন সেনাবাহিনীর প্রধানকে নিয়ে কথা উঠল? যে আলাপ তাদের সঙ্গে অনেক আগে হয়েছে, সেটা এখন হঠাৎ কেন বলে ফেলল? এগুলো তো আমাদের সন্দেহ জাগাচ্ছে যে, অন্য কোনো শক্তি এখানে কাজ করছে কি না?’

অধ্যাপক শামছুল আলম বলেন, ‘অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আমরা গণঅভ্যুত্থানের চেতনা থেকে সরে যাচ্ছি। সেজন্য প্রয়োজনে সংস্কারের কাজও চলবে নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নেওয়া দরকার এখন। ইউনূস সরকারের উচিত দ্রুততার সঙ্গে আসন্ন ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন দেওয়া। না হলে তিনি যে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী, তার যে আলাদা একটা পজিটিভ ইমেজ আছে, সেটা কিন্তু আস্তে আস্তে জনগণের কাছে ম্রিয়মাণ হয়ে যাবে। অতএব মূল বিষয় হলো, দ্রুততার সঙ্গে নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।’

তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্ররা ভোটার ও প্রার্থী হওয়ার বয়স কমানো নিয়ে নতুন ইস্যু সামনে এনেছে, যা নির্বাচন পেছানোর আরেকটি ইস্যু। এটা তো হতে পারে না। আমরা তো গণঅভ্যুত্থানে তাদের গ্রহণযোগ্যতা দেখেছি। অতীতে গণঅভ্যুত্থানে যেসব ছাত্র নেতৃত্ব দিয়েছে, তারা কিন্তু নতুন দল গঠন করেনি। কিন্তু ইদানীং দেখছি আমাদের এখানে চার-পাঁচটি দল হয়ে গেছে। তাহলে মানুষের মনে অবিশ্বাস ঢুকবে।’

ভোটার ও প্রার্থীর বয়স কমানো প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু জুলাই আন্দোলনে স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরাই বেশিরভাগ মাঠে ছিল, এখন ভোটারের বয়স কমালে তারা তাদের (এনসিপি) ভোট দেবে ভাবছে। আমি বলব, এসব ইস্যু না বানিয়ে দলমত নির্বিশেষে জাতীয় নির্বাচনটা হয়ে যাক। নচেৎ স্থিতিশীলতা আসবে না।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার কালবেলাকে বলেন, সম্প্রতি রাজনীতিবিদদের কতগুলো বক্তব্য ঘিরে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সন্দেহ নেই। আমরা আশা করব, দেশের স্বার্থে সবাই যার যার অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল বক্তব্য দিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাবেন এবং এতে জটিল পরিস্থিতির অবসানও ঘটবে।

সংস্কারের জন্য নির্বাচন বিলম্বিত করার সুযোগ নেই মন্তব্য করে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বলেন, কেউ কেউ সংস্কার এবং নির্বাচনকে প্রতিপক্ষ হিসেবে মনে করছেন। আসলে এ দুটি বিষয় একে অপরের সম্পূরক। সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়া দুটোই একসঙ্গে হতে পারে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই সদস্য আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলে কিছু সংস্কার আগে এবং বাকী সংস্কার নির্বাচনের পরেও হতে পারে। আমরা আশা করি তারা এ বিষয়ে ঐকমত্যে আসতে পারবেন এবং সেটিই হবে দেশ ও দেশের জনগণের জন্য মঙ্গলজনক।