
দেশে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে দুই দশক ধরে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা কাজ করলেও সম্প্রতি তারা তাদের সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে। এতে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির গবেষণা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের একার পক্ষে যক্ষ্মা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। কারণ জনসচেতনতা ছাড়া কোনো রোগ নির্মূল করা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে গবেষণা না হলে রোগের গতিবিধি জানাও সম্ভব নয়। এতে যক্ষ্মার নতুন ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীনে ২০২৪ সালে বাংলাদেশে তিন লাখ ১৩ হাজার ৬২৪ জন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে চিকিৎসার আওতায় আছে ৮৩ শতাংশ, বাকি প্রায় ১৭ শতাংশ রোগী চিকিৎসার বাইরে। এ ছাড়া প্রতি লাখে মৃত্যু হচ্ছে ২৫ জনের।
চিকিৎসকরা বলছেন, যক্ষ্মা সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে, তার হাঁচি-কাশি বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। কথা থেকেও বাতাসে যক্ষ্মার জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে পারে। একজন মানুষের কফ ছায়াহীন জায়গায় ফেললে বহুদিন জীবাণু বেঁচে থাকে। অপরিচ্ছন্ন, বদ্ধ, আলো-বাতাসহীন ঘরে এটি বেশি ছড়ায়।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক. ডা. বে-নজীর আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘উন্নয়ন সংস্থা তাদের সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ায় শঙ্কার মধ্যে রয়েছি আমরা। সচেতনতার অভাবে একসঙ্গে তিনটি সমস্যা বাড়বে—এক. দেরিতে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বাড়বে; দুই. ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বাড়বে; তিন. দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে যক্ষ্মা নির্মূলে যে অর্জন, সেটুকু হারিয়ে যাবে।’
এমন পরিস্থিতির মধ্যে দেশে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। ১৮৮২ সালের ২৪ মার্চ রবার্ট কচ যক্ষ্মা রোগের জীবাণু আবিষ্কার করেন। এর ১০০ বছর পর ১৯৮২ সাল থেকে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিবছর এই দিনে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য, ‘প্রতিশ্রুতি, বিনিয়োগ ও সেবাদান দ্বারা, সম্ভব হবে যক্ষ্মামুক্ত বাংলাদেশ গড়া’।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক বিজ্ঞানী বলেন, ইউএসএআইডির অর্থায়নে আইসিডিডিআরবির সাত থেকে আইটি প্রকল্প চলমান ছিল। এগুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে যক্ষ্মার সক্রিয় রোগী সন্ধান, স্ক্রিনিং ও সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ করা হতো।
ইউএসএআইডির সহায়তায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকেও যক্ষ্মা নিয়ে গবেষণা প্রকল্প ছিল। গত জানুয়ারিতে সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। সংস্থাটির যক্ষ্মা কর্মসূচির লিড টেকনিক্যাল ডা. ফারহানা নিশাত সেহেলী বলেন, গত জানুয়ারি থেকে ইউএসএআইডির অর্থায়নে চলমান গবেষণা প্রকল্পটি বন্ধ রয়েছে। দুই মাসে তেমন কোনো প্রভাব লক্ষ করা যায়নি। এসব কর্মকাণ্ড দীর্ঘমেয়াদি বন্ধ থাকলে প্রভাব পড়বেই।
আইইডিসিআর বলছে, বিশ্বের যক্ষ্মাপ্রবণ ৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সাত নম্বরে। একই সঙ্গে ৫০ শতাংশ মানুষের মধ্যে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ২.১৬ শতাংশ। বর্তমানে প্রতি লাখে নতুন করে ২২১ জন ব্যক্তি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, বিভাগভিত্তিক হিসাবে ঢাকায় ৮৫ হাজার ৬০৮ জন, চট্টগ্রামে ৬০ হাজার ৩০৯ জন, রাজশাহীতে ৩৫ হাজার ৮১৯ জন, রংপুরে ৩৪ হাজার ৮৩৩ জন, খুলনায় ৩৪ হাজার ১৪ জন, বরিশালে ১৯ হাজার ৬০০ জন, সিলেটে ২২ হাজার ২২ জন, ময়মনসিংহে ২১ হাজার ৪১৯ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশে যক্ষ্মা রোগে মৃত্যুহার ছিল প্রতি লাখে ৫৪ জন। ২০২৩ সালে এসে এই হার দাঁড়িয়েছে প্রতি লাখে ২৬ জনে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, গত বছর এক হাজার ৭৯৯ জন ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা হয়। এর আগের বছর এই সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৭২৯। দিন দিন ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্যবিদরা। তাঁরা বলছেন, যেসব যক্ষ্মা রোগীর শরীরে ওষুধ কাজ করে না, তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। গত তিন দশকে দেশে অন্তত ৩৫ লাখ যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ব্যবস্থাপক ডা. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, ‘যক্ষ্মায় মৃত্যুহার কমে এসেছে। ২০১৫ সালে প্রতি লাখে ৪৫ জন রোগীর মৃত্যু হলেও বর্তমানে তা ২৫ জনে নেমে এসেছে। দেশে শিশু যক্ষ্মা রোগী শনাক্তের হার কম। বর্তমানে রোগ নিরীক্ষার কিছু সুবিধা বাড়ার কারণে তা ৫ শতাংশের বেশি দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ মোট রোগীর ৫ শতাংশ শিশু। এর আগে গত বছর এই হার ছিল ৪.৪ শতাংশ। আমরা শিশু রোগী শনাক্তের জন্য আরো কাজ করছি। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে।’