Image description
 

পতিত আওয়ামী সরকারের দুর্নীতির ভয়াল থাবা পড়েছিল ইসলামিক ফাউন্ডেশনে (ইফা)। মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে চরম অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ আর জালিয়াতির আখড়ায় পরিণত হয়েছিল সরকারি ধর্মীয় এ প্রতিষ্ঠানটি। মৌলিক কাজ বাদ দিয়ে আওয়ামী বন্দনায় ব্যস্ত রাখা হয়েছিল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এমনকি আওয়ামী সরকারের বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যু বাস্তবায়নেও দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করা হতো ইফার কর্মীদের। গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে চরম জালিয়াতি ও দুর্নীতি হয়েছে।

 

সূত্র বলছে, সাবেক ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজালের (মৃত) নেতৃত্বেই তার দীর্ঘ ১১ বছর মেয়াদে সবচেয়ে বেশি অপকর্ম হয়েছে। একই সঙ্গে বিগত ১৫ বছরে দায়িত্ব পাওয়া বোর্ড অব গভর্নরসের গভর্নররা এবং আওয়ামীপন্থি হিসেবে দাবিদার বেশ কিছু কর্মকর্তা দাপটের সঙ্গে অনিয়ম-দুর্নীতি চালিয়ে গেছেন প্রতিষ্ঠানটিতে। এতে একদিকে যেমন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটি চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে সরকারের শত শত কোটি টাকা নষ্ট হয়েছে। একচেটিয়া দুর্নীতি-অনিয়ম হলেও কেউ কোনো কথা বলার সাহস পেতেন না এতদিন। তবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ থেকে পলায়ন ও তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আলোচনায় উঠে এসেছে এসব দুর্নীতি। ইফার সর্বশেষ বোর্ড সভায়ও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা এবং এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

 

এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক (ডিজি) আ. ছালাম খান আমার দেশকে বলেন, বিগত ১৫ বছরে যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে তা অনুসন্ধানে একজন সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে কমিটি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্য চূড়ান্ত হলেও সাবেক বিচারপতি এখনো পাওয়া যায়নি। ওই কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে এবং সে অনুযায়ী জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে তার আগ পর্যন্ত দুর্নীতিবাজ ও আওয়ামীপন্থি হিসেবে চিহ্নিতদের বিভিন্ন স্থানে বদলি করা হয়েছে।

 

অডিটে ইফার দুর্নীতির খণ্ডচিত্র

২০০৯ থেকে ২০১৮ অর্থবছরের এক অডিট রিপোর্টে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে ১০ বছরে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা নয়ছয় করা হয় বলে তথ্য উঠে আসে। এর মধ্যে সরকারের সরাসরি ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ৬৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩৭ টাকা এবং বিধিবহির্ভূতভাবে খরচ করা হয়েছে ৫১৮ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার ৭৯৮ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির ১৩৪ খাতে এসব অনিয়ম করা হয়েছে। সিভিল অডিট অধিদপ্তরের বিশেষ নিরীক্ষা দলের ২০০৯-২০১৮ অর্থবছরের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে আসে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

এদিকে বিশেষ অডিট টিমের অনুসন্ধানে ইফার বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্যউপাত্ত উঠে আসার বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তড়িঘড়ি করে কয়েক দফায় মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষা প্রকল্পের অব্যয়িত ৭৪ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়া হয়।

 

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের ব্যবহার

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জনবলের বড় অংশ ছিল মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষক। ইমাম-মোয়াজ্জিন সংশ্লিষ্ট এসব শিক্ষকদের অনেকটা দলীয়ভাবে ব্যবহার করে পতিত আওয়ামী সরকার। দেশের আলেম-ওলামা ও ইসলামের বিরুদ্ধে নানা কর্মকাণ্ডে হাসিনার সরকার যখন সমালোচনার মুখে পড়ত, তখন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিতর্কিত ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজালের নির্দেশে গণশিক্ষার শিক্ষকদের ঢাকায় এনে সরকারের পক্ষে সমাবেশ করা হতো। এতে চরম বির্বত ও বিতর্কের মুখে পড়তেন ইমাম-মোয়াজ্জিনরা। অবশ্য আওয়ামীপন্থি নিশ্চিত করে বহু শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় সে সময়। তারা এসব কাজে বেশি তৎপর থাকতেন।

সবশেষ ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের আগেও ছাত্র-জনতার আন্দোলনবিরোধী কাজে লাগানো হয় গণশিক্ষার শিক্ষকদের। ওই আন্দোলনকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ আখ্যা দিয়ে গণশিক্ষার শিক্ষকদের মাধ্যমে ৪ আগস্ট আগারগাঁওয়ে চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে মানববন্ধন করা হয়। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব আ. হামিদ জমাদ্দার এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক ডিজি ড. বশিরুল আলমের নির্দেশে ওই কর্মসূচি আয়োজন করা হয় বলে জানা যায়। গণশিক্ষা প্রকল্পের পরিচালক এ এস এম শফিউল আলম তালুকদার এই মানববন্ধনে নেতৃত্ব দেন।

 

শেখ মুজিবের ম্যুরাল বানানোর উদ্যোগ

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আগারগাঁও প্রধান কার্যালয়ে শেখ মুজিবের ম্যুরাল বানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বোর্ড অব গভর্নরসের সভায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ধর্মীয় একটি প্রতিষ্ঠানে ম্যুরাল বানানোর এ উদ্যোগে সংশ্লিষ্টরা বিস্ময় প্রকাশ করেন। তবে হাসিনা সরকারের পতনের পর এ উদ্যোগ ভেস্তে যায়।

 

ইসলামিক প্রতিষ্ঠান হয়ে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হয়েও একের পর এক অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড চলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে। মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্পের শিক্ষার্থী, ইমাম-মুয়াজ্জিন ও অভিভাবকদের নিয়ে আগারগাঁওয়ে ফাউন্ডেশন ভবনে ২০১০ সালের ১৭ মার্চ শেখ মুজিবের জন্মদিনের এক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়া। এ সময় ওই শিল্পীর সঙ্গে করমর্দনও করেন ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজাল। কাঙ্গালিনী সুফিয়ার একতারা ও নাচ-গানে বিব্রত হন উপস্থিত ইমামরা। এ ছাড়া একই বছর ১২, ১৩ ও ১৪ এপ্রিল ইফার ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ে জাতীয় শিশু-কিশোরদের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে হামদ ও নাতের বিচারক হিসেবে আঁখি আলমগীরসহ এমন শিল্পীদের আনা হয়, যাদের অনেকেই ইসলামি সংগীত করেন না। এ নিয়ে অনেকেই তখন প্রশ্ন তোলেন। একই বছর ২৭ নভেম্বর আগারগাঁওয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিদর্শনে আসে একটি মার্কিন প্রতিনিধিদল। তাদের সম্মানে আয়োজন করা হয় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। একপর্যায়ে ডিজির অনুরোধে ইমামদের সামনে মার্কিন তরুণ-তরুণীরা পরিবেশন করেন অশ্লীল ব্যালে নৃত্য।

 

যদিও পরে ইসলামিক ফাউন্ডেশন জানায়, ব্যালে ড্যান্স নয় ৩৫ সেকেন্ডের ‘সুয়িং ড্যান্স’ ছিল ওটা। মার্কিন তরুণীদের সঙ্গে হ্যান্ডশেকও করেন সামীম আফজাল। এসব অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ এবং ডিজির পদত্যাগ দাবি করলেও আওয়ামী সরকার উল্টো তার মেয়াদ আরো বাড়িয়ে দেয়।

 

মৌলিক গবেষণা ও প্রকাশনা কার্যক্রমে স্থবিরতা

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকাশনা ইসলামি বিশ্বকোষ। ব্যাপক চাহিদা সত্ত্বেও আওয়ামী সরকারের ১৫ বছরে ইসলামি বিশ্বকোষের নতুন একটি খণ্ডও প্রকাশ করা হয়নি। কিছু পুনর্মুদ্রণ করলেও তা ছিল যৎসামান্য ও অপ্রতুল। একইভাবে গত ১৫ বছরে কোনো মৌলিক গবেষণামূলক পুস্তক প্রকাশ করা হয়নি। অনুবাদ সাহিত্যকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কোনো বই অনুবাদ করা হয়নি।

 

একদিকে মৌলিক গবেষণামূলক বই প্রকাশ বন্ধ, অন্যদিকে অপ্রয়োজনে নিজের নামে ২৫টির বেশি বই প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটির লাখ লাখ টাকা অপচয় করেন তৎকালীন ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজাল। আরো অবাক করা বিষয় হলো, অন্যকে দিয়ে বই লিখিয়ে নিজের নামে প্রকাশ করেন সামীম আফজাল।

 

সূত্র জানায়, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা বিভাগ থেকে পত্রিকা ও সাময়িকীসহ এ পর্যন্ত চার হাজার ৫৯৬টি টাইটেলের বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ও সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে লেখা ৬৩টি বই আছে। শুধু মুজিব সম্পর্কিত বই আছে ৩৪টি। বাকিগুলো মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সম্পর্কিত। এসব বই ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে সাবেক ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজাল, পরিচালক মহিউদ্দিন মজুমদার, বোর্ড অব গভর্নরসের গভর্নর উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, কর্মকর্তা ডা. শাহাদাত হোসেনসহ আওয়ামীপন্থি বিভিন্ন লেখকের বই রয়েছে।

 

এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক ও প্রশাসন বিভাগের উপসচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোহাম্মদ তৌহিদুল আনোয়ার আমার দেশকে জানান, বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খুব শিগগিরই শেখ মুজিবের নামসংশ্লিষ্ট ৬৩টি বই পুড়িয়ে ধ্বংস করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

 

ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি লক্ষ্যচ্যুত

উদ্দেশ্যমূলকভাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমিকে লক্ষ্যচ্যুত করা হয়েছিল। দেশের মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের ইসলামের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানদানের পাশাপাশি পরিবারকল্যাণ, কৃষি ও বনায়ন, প্রাণিসম্পদ পালন ও মৎস্য চাষ, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও প্রাথমিক চিকিৎসা, বৃক্ষরোপণ, বিজ্ঞান, তথ্য ও প্রযুক্তি, পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচিতি, বেসিক কম্পিউটার ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের উপার্জনক্ষম এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখার মতো উপযুক্ত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। আটটি স্থানে ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির সেন্টার রয়েছে। গত ১৫ বছরে ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির সিলেবাস পরিবর্তন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চার নামে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মতবাদ প্রচার, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের নামে বিভিন্ন ইসলামি দল ও ব্যক্তিত্বের প্রতি বিষোদগার করে ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমিকে লক্ষ্যচ্যুত করা হয়েছে।

 

মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পে অনিয়ম

আর্থসামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও শিক্ষা বিস্তারের কাজে মসজিদের ইমামদের সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে খালেদা জিয়ার সরকার ১৯৯৩ সালে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম ইনোভেটিভ উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে প্রাক-প্রাথমিক এবং ঝরেপড়া (ড্রপ আউট) কিশোর-কিশোরী ও অক্ষরজ্ঞানহীন বয়স্কদের জন্য গণশিক্ষা ও কোরআন শিক্ষা দেওয়া হয়। এ প্রকল্পে মসজিদের ইমামরা মসজিদ কেন্দ্রে শিশু ও বয়স্ক শিক্ষার্থীদের বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি, আরবি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদান করছেন।

 

কিন্তু গত ১৫ বছর মূল শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করে এই প্রকল্পের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ঢাকাসহ সারাদেশে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের মিটিং-মিছিলে ব্যবহার করা হয়েছে। শুধু ঢাকা শহরে যুব মহিলা লীগের ২০০০ কর্মীর নামে গণশিক্ষা কেন্দ্র বরাদ্দ দেওয়া হয়, যারা কোনোরকম পাঠদান না করে প্রতি মাসে বেতন নিয়ে থাকেন। সারাদেশে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ শিক্ষককে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যারা পাঠদান না করে আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিং করতেন। এ প্রকল্পের ফিল্ড অফিসার, ফিল্ড সুপারভাইজার, মাস্টার ট্রেইনার, মডেল ও সাধারণ কেয়ারটেকার এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়োগ-বদলিতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি ছিল একেবারে সাধারণ ঘটনা। একাধিকবার বায়োডাটা যাচাইয়ের নামে হয়রানি করা হতো কর্মীদের।

 

দুর্নীতি ও অনিয়মে ছাপাখানায় লোকসান

২০০৮ সাল পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ছাপাখানা একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল এবং দেশের সেরা ১০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম ছিল। ডিজি হিসেবে সামীম আফজাল দায়িত্ব নেওয়ার পর অযোগ্য, অদক্ষ কর্মী নিয়োগ এবং দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে ছাপাখানাটি আজ লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সাবেক ডিজির হাজার হাজার বই মুদ্রণ করে বিনা মূল্যে বিতরণ, আওয়ামী লীগের পোস্টার-লিফলেট ছাপানো, হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে বিভিন্ন বই মুদ্রণ করে বিনা মূল্যে বিতরণ ইত্যাদি কাজ প্রেসের মাধ্যমে করা হয়েছে। এ ছাড়া অকেজো প্রেস মেশিন কেনা, কম্পিউটার ও অন্যান্য মালামাল কেনা-মেরামতে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি ও ক্ষতির কারণে এ প্রতিষ্ঠান দিনে দিনে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

 

মসজিদ পাঠাগারে দলীয় মতাদর্শের বই ও কমিশন বাণিজ্য

বাংলাদেশের মসজিদগুলোকে মসজিদে নববীর আদর্শে গড়ে তোলার লক্ষ্যে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে ‘মসজিদ পাঠাগার সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করেন। গত ১৫ বছরে এ পাঠাগারে দলীয় মতাদর্শের এমন বই সরবরাহ করা হয়েছে, যা প্রকল্পের মূললক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করেছে। নিম্নমানের বই কিনে লাখ লাখ টাকা কমিশন হাতিয়ে নিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।

 

বায়তুল মোকাররমে দোকান বরাদ্দ ও হস্তান্তরে দুর্নীতি-অনিয়ম

বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে দোকান বরাদ্দ ও দোকান হস্তান্তরের ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সাবেক ডিজি সামীম আফজালের আত্মীয়স্বজন, বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য মিছবাহুর রহমান চৌধুরী ও গোলাম মাওলা নকশবন্দির আত্মীয়স্বজনের নামে স্বল্পমূল্যে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সাবেক পরিচালক হারুনুর রশীদ, আবু তাহের, শফিকুল ইসলাম ও বর্তমান পরিচালক জালাল আহমদ ও মহীউদ্দিন মজুমদারের আত্মীয়স্বজনের নামে স্বল্পমূল্যে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়। বায়তুল মোকাররম মার্কেটে দোকান বরাদ্দের নামে শতকোটি টাকা লোপাট, বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, অর্থ লোপাট, দলবাজি, নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মহীউদ্দিন মজুমদারসহ অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তে সম্প্রতি তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

 

বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম নিয়োগে অনিয়ম-জালিয়াতি

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ও চাকরির বয়স না থাকা এবং কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম ও ভাষাশিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। শিক্ষাগত, অভিজ্ঞতা ও জন্মগত ভুয়া সনদ দিয়েও কেউ কেউ চাকরি নেন। পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে নম্বর জালিয়াতির ঘটনাও ঘটেছে।

 

৪৭ কর্মকর্তা নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি

লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় রেজাউল করিমের চেয়ে ৭ নম্বর কম পেয়েছেন সাদিয়া শারমিন। রেজাউলের মোট নম্বর ৭১ ও সাদিয়ার ৬৪ দশমিক ১৩ নম্বর। অথচ নম্বরপত্রে রেজাউল করিমের মোট নম্বর ৭১-এর স্থলে ৬১ দেখিয়ে গবেষণা কর্মকর্তা পদে চাকরি দেওয়া হয়েছে সাদিয়া শারমিনকে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন ও পলায়নের পর ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় রেজাউল ইসলামিক ফাউন্ডেশনে আবেদন করেন। এ বিষয়ে তিনি আমার দেশকে বলেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনার সময়ে তিনি এ বিষয়ে বারবার লিখিত অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি। বর্তমানে তিনি তার চাকরি পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

 

এ ধরনের জালিয়াতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে ২০১২ সালের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রথম শ্রেণির ৪৭ জন কর্মকর্তা নিয়োগে। ওই নিয়োগের সুপারিশপত্রে সই করেননি কমিটির সদস্য সচিব, জনপ্রশাসন, অর্থ ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রতিনিধি। লিখিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করানো এবং সর্বনিম্ন নম্বর পাওয়াদের সর্বোচ্চ নম্বর দেওয়া হয়েছে। নিয়োগে মুখ্য হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগের পরিচয়। দেওয়া হয়েছে প্যানেল থেকে নিয়োগ। নিয়োগ কমিটির সদস্য হিসেবে চাচা-ভাতিজাকে আর মামা-ভাগনেকে নিয়োগ দিয়েছে। শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা থেকেই আটজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

 

নিয়োগ কমিটির প্রভাবশালী দুই সদস্য উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ও সামীম আফজালের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী টানা এক যুগের বেশি সময় ইসলামিক ফাউন্ডেশন বোর্ডের সদস্য ছিলেন। বিতর্কিত ও সমালোচিত ডিজি সামীম আফজাল টানা ১১ বছর ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি ছিলেন। তিনি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে দুর্নীতির দায় নিয়ে চলে যান। তাদের মাধ্যমেই ঘটেছে যতসব অপকর্ম ও অনিয়ম। প্রতিষ্ঠানটিতে যত ধরনের নিয়োগ হয়েছে, ততই অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে।

 

সিলেকশন কমিটির একটি কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত কমপক্ষে আটজনকে মৌখিক পরীক্ষায় ২৮ নম্বরে ২৮ দেওয়া হয়েছে। লিখিত পরীক্ষায় ৬০ নম্বরের মধ্যে তাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে-৩৩, ৩৩, ৩৫, ৩৪, ৩৪, ৩২, ৩০ ও ৩১। একইপদে মৌখিক পরীক্ষায় ২৮ নম্বরের মধ্যে কমপক্ষে ১২ জনকে ২৭ নম্বরের বেশি দেওয়া হয়েছে। লিখিত পরীক্ষায় ৬০ নম্বরের মধ্যে তাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমেÑ ৪৫, ৪৩, ৪৬, ৪২, ৪১, ৪০, ৪১, ৩৪, ৩৪, ৩৫, ৩৬ ও ৩১।

 

লিখিত পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়া যোগ্য অনেক প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় নম্বর কম দিয়ে যেমন নিয়োগ বঞ্চিত করা হয়েছে, তেমনি মৌখিক পরীক্ষায় অস্বাভাবিকভাবে নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে আত্মীয়স্বজন ও দলীয় ক্যাডারদের চাকরি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সহকারী পরিচালক পদের মেধাতালিকায় ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৯ম স্থান এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ২য় ও ৫ম স্থান অর্জনের পরও তাদের অনুকূলে নিয়োগপত্র ইস্যু করা হয়নি। এ পাঁচজনকে ডাকযোগে নিয়োগপত্র না পাঠিয়ে প্যানেল থেকে পাঁচজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যদিও প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে প্যানেল থেকে চাকরি দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই বলে ফাউন্ডেশন সূত্র জানিয়েছে।

 

সূত্র জানায়, ভুক্তভোগী দু’জনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রথম শ্রেণির ৪৭ জন কর্মকর্তা নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে ১২ জানুয়ারি ও ৩ মার্চ ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন ব্যবস্থাপক শাহ আলম ও প্রোগ্রাম অফিসার মশিউর রহমান ভুইয়ার নিয়োগ বিধিবহির্ভূত হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। এ বিষয়ে আদালতে রিট হয়েছে এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তদন্তকাজ চলছে বলে ইফার ডিজি আ. ছালাম খান জানিয়েছেন।

 

জাল সনদে চাকরি করছেন অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী

ইসলামিক ফাউন্ডেশনে জাল সনদ, ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদপত্র, জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরি করছেন অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা। যাদের প্রায় সবাই সাবেক ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজালের সময় নিয়োগপ্রাপ্ত। এদের অধিকাংশই তার ভাতিজা, ভাগনেসহ আত্মীয়স্বজন বলে জানা গেছে।

 

বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই ফারমার্স ব্যাংকে এফডিআর

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরসের অনুমোদন ছাড়াই ফারমার্স ব্যাংকের কুমিল্লা শাখায় ২৯ কোটি ৮২ লাখ ৬২ হাজার ৪০০ টাকা স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রাখা হয়, যা সম্পূর্ণরূপে বিধিবহির্ভূত। ২০১৯ সালের ২২ জুন অনুষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন বোর্ড অব গভর্নরসের ২০৪তম সভায় ওই ব্যাংকের গচ্ছিত টাকা সাতদিনের মধ্যে উদ্ধার করে রাষ্ট্রায়ত্ত যে কোনো ব্যাংকে জমা রাখার সিদ্ধান্ত হলেও তা আদৌ বাস্তবায়ন হয়নি।

 

অন্যান্য দুর্নীতি

ইসলামিক ফাউন্ডেশনে পবিত্র কোরআনুল করিম মুদ্রণ ও ক্রয়ে ৫২ কোটি ৫৫ লাখ টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী কর্মসূচি পালন না করে তিন কোটি ১৬ লাখ টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। আর্থিক ক্ষমতা বহির্ভূতভাবে ৪৫ কোটি ১৩ লাখ ৭৭ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। কোনো ধরনের আইন, বিধিবিধান ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে শত শত কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটিতে। এতে সরকারের শত শত কোটি টাকা ক্ষতি হয়। পুস্তক মুদ্রণ ও বাঁধাই না করে তিন কোটি ২৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা লোপাট করা হয়। পুস্তক প্রকাশনার অর্থ বিধিবহির্ভূতভাবে ওয়ার্কশপ খাতে ব্যয় করা হয়।

 

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ডের গভর্নর মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাল আল মাদানী বলেন, ফাউন্ডেশনে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে। এখানে ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড করতে দেওয়া হবে না। সাবেক গভর্নর উবায়দুল মুকতাদিরের সময়ে যেসব নিয়োগ হয়েছিল, জাল সনদধারী এবং যারা দুর্নীতিতে জড়িত তাদের স্ট্যান্ড রিলিজ দেওয়া হচ্ছে। হেড অফিসে ব্যাপক রদবদল করা হচ্ছে। বঞ্চিতদের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। সার্বিক দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠন করা হচ্ছে। বর্তমান ধর্ম উপদেষ্টা ও মহাপরিচালক এক্ষেত্রে আন্তরিকভাবে কাজ করছেন।