Image description
মেয়াদ শেষ হচ্ছে, সংশোধিত প্রস্তাব অনুমোদন হয়নি মেয়াদ বাড়াতে চায় মন্ত্রণালয় অন্তর্বর্তী মেয়াদ না বাড়লে কাজ থমকে যাওয়ার আশঙ্কা বেতন-ভাতা পরিশোধে আইনি জটিলতার শঙ্কা

প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে মাত্র এক দিন বাকি। সংশোধিত প্রস্তাব এখনো অনুমোদন হয়নি। ফলে থমকে যেতে বসেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প। ফলে এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে রীতিমতো অচল হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে বিশাল এ প্রকল্প।

সময়মতো সংশোধিত প্রস্তাবের অনুমোদন না হওয়ায় প্রকল্পের কাজ চালু রাখা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ এবং প্রয়োজনীয় অপারেশনাল ব্যয় নির্বাহ নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তায় পড়েছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন (বিএইসি) এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ব্যয় ও মেয়াদ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানোর প্রস্তাব আসায় পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সংশোধিত ডিপিপি নিয়ে একাধিক গুরুতর আপত্তি ও প্রশ্ন তুলেছে। এসব আপত্তির নিষ্পত্তি না হওয়ায় ডিসেম্বরের আগে সংশোধিত প্রস্তাব অনুমোদনের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। এর ফলে প্রকল্পের আইনগত মেয়াদ শেষ হলেও মাঠ পর্যায়ের কাজ, কমিশনিং কার্যক্রম এবং বিদেশি ঠিকাদারের সঙ্গে চলমান চুক্তি কিভাবে পরিচালিত হবে—তা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে।

এই বাস্তবতায় কাজ চালু রাখতে আপাতত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে চায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে একনেক অনুমোদিত মূল ডিপিপি অনুযায়ী রূপপুর প্রকল্পের মেয়াদ ছিল জুলাই ২০১৬ থেকে ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত। এই মেয়াদেই প্রকল্পের সব ব্যয় নির্বাহ, জনবল নিয়োগ ও বেতন-ভাতা পরিশোধের আইনি ভিত্তি নির্ধারিত। কিন্তু সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদন না হলে ডিসেম্বরের পর প্রকল্প দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় পরিশোধে বৈধতা থাকবে না বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

প্রকল্প পরিচালক সভায় জানান, প্রায় ৯ বছরের বাস্তবায়নকালে নতুন নতুন প্রয়োজন সামনে এসেছে। ইউনিট-১-এর কমিশনিং কার্যক্রম শুরু হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ পরিচালনার জন্য সেবা চুক্তি, খুচরা যন্ত্রাংশ এবং বিশেষায়িত প্রযুক্তিগত সহায়তা দরকার হচ্ছে। পাশাপাশি আন্ত সরকার চুক্তির শর্ত অনুযায়ী রাশিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিদেশি জনবলের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এসব খাতে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

আরেকটি বড় কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয় ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন।

প্রকল্পের শুরুতে প্রতি ডলার ৮০ টাকা ধরে ব্যয় হিসাব করা হলেও বর্তমানে বিনিময় হার অনেক বেড়েছে। ফলে ডলারে অপরিবর্তিত ঋণ টাকার অঙ্কে বিশাল অঙ্কে দাঁড়িয়েছে। সংশোধিত প্রস্তাবে জানানো হয়, চুক্তিমূল্যের অগ্রিম পরিশোধ, আমদানি শুল্ক ও মূল্য সংযোজন করসহ বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ শেষ হয়ে যাওয়ায় ৩৪টি খাতে ৩৪টি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো, ৪০টি খাতে কমানো এবং ১০টি নতুন খাত যুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

তবে এসব ব্যয় বৃদ্ধির যুক্তি মানতে নারাজ আইএমইডির প্রতিনিধিরা। সভায় তাঁরা বলেন, গত ৯ বছরে যে হারে ব্যয় হয়েছে, তার তুলনায় বাকি মাত্র আড়াই থেকে তিন বছরের জন্য অনেক খাতে অস্বাভাবিকভাবে বেশি অর্থ চাওয়া হয়েছে। উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, পরিবহন ভাড়া খাতে মূল প্রকল্পে ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও জুন ২০২৫ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অথচ অবশিষ্ট সময়ের জন্য ৪২ কোটি টাকার বেশি চাওয়া হয়েছে। একই ধরনের অসামঞ্জস্য জ্বালানি তেল, যানবাহন, নিরাপত্তা সেবা, সফটওয়্যার, বীমা, পোশাক, রাসায়নিক দ্রব্য ও খুচরা যন্ত্রাংশসহ একাধিক খাতে দেখা গেছে।

কমিটির সদস্যরা আরো বলেন, কিছু খাতে এখনো কোনো ব্যয় না হলেও সংশোধিত প্রস্তাবে কয়েক গুণ বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আবাসিক ভবনের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে বড় অঙ্কের অর্থ চাওয়ার ক্ষেত্রেও বিস্তারিত হিসাব ও যুক্তি উপস্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়।

সভায় রাশিয়া থেকে নেওয়া ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়। প্রায় এক দশক পার হলেও সহায়ক ঋণ চুক্তি এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে জানানো হয়। প্রকল্প শেষে বিদ্যুৎ বিক্রি শুরু হলে কিভাবে ঋণ পরিশোধ হবে, কবে কিস্তি শুরু হবে এবং আর্থিক সক্ষমতা কিভাবে নিশ্চিত করা হবে—এসব বিষয় সংশোধিত ডিপিপিতে স্পষ্টভাবে তুলে ধরার নির্দেশ দেয় পিইসি।

একই সঙ্গে জনবল কাঠামো, বেতন-ভাতা অর্থ বিভাগের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে এবং আর্থিক বিশ্লেষণে নির্ধারিত ছাড়মূল্য ছাড়া বিকল্প কোনো হিসাব না রাখতে বলা হয়। সম্ভাব্য পারমাণবিক দুর্ঘটনা মোকাবেলায় পরিবেশগত ঝুঁকি প্রশমন, জরুরি সাড়া ব্যবস্থাপনা এবং প্রকল্প শেষে রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার টেকসই পরিকল্পনা যুক্ত করার ওপরও জোর দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন আল রশিদ বলেন, এত বড় ও ব্যয়বহুল প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাব কখনো তড়িঘড়ি অনুমোদন দেওয়া হয় না। সব আর্থিক ও কারিগরি দিক খুঁটিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দেরিতে প্রস্তাব দেওয়ার কারণে যদি জটিলতা তৈরি হয়, তার দায় প্রকল্প কর্তৃপক্ষকেই নিতে হবে।

পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ডিপিপির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে নতুন করে বরাদ্দ ছাড় বা বেতন-ভাতা পরিশোধ করা যায় না। সংশোধিত প্রস্তাব অনুমোদন না থাকলে প্রকল্প কার্যত প্রশাসনিক শূন্যতায় পড়ে যাবে। তাঁর মতে, এত বড় প্রকল্পে কয়েক মাসের এই অনিশ্চয়তা বাস্তবায়ন ও কমিশনিং কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

সংশোধিত প্রস্তাবে রূপপুর প্রকল্পের মোট ব্যয় প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে এক লাখ ৩৯ হাজার ২৭৪ কোটি টাকায় নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মূল অনুমোদিত ব্যয়ের তুলনায় প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি। একই সঙ্গে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৮ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। কিন্তু ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিকতা, বিভিন্ন খাতে অস্বাভাবিক বরাদ্দ বৃদ্ধি, ডলারের বিনিময় হার সঠিকভাবে প্রতিফলন না হওয়া এবং ঋণ পরিশোধ পরিকল্পনার অস্পষ্টতার কারণে পিইসি এখনো সবুজসংকেত দেয়নি।

এই অনিশ্চয়তার সরাসরি প্রভাব পড়ছে জনবল ব্যবস্থাপনায়। বর্তমানে প্রকল্প দপ্তরে দেশি-বিদেশি বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন। রাশিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের বিশেষজ্ঞ ও বিদেশি কর্মীরাও প্রকল্প এলাকায় নিয়োজিত। সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদন না হলে ডিসেম্বরের পর তাঁদের বেতন-ভাতা, আবাসন, নিরাপত্তা ও অন্যান্য সুবিধা কিভাবে দেওয়া হবে—তা নিয়ে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা চাই না প্রকল্পের কাজ থেমে যাক। কিন্তু আইনি ও আর্থিক কাঠামো ছাড়া বেতন-ভাতা দেওয়া বা নতুন ব্যয় করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সে কারণে অন্তত বাস্তবায়ন মেয়াদ বাড়ানোর একটি অন্তর্বর্তী অনুমোদন জরুরি।’

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, পিইসি সভায় এমন একটি বিকল্পের কথা আলোচিত হয়েছে। পুরো সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদনে সময় লাগলে, শুধু প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর একটি পৃথক প্রস্তাব অনুমোদনের সুযোগ রয়েছে, যাতে চলমান কাজ ও জনবল ব্যবস্থাপনা অব্যাহত রাখা যায়। তবে এ ক্ষেত্রেও অর্থ মন্ত্রণালয় ও একনেকের সম্মতি প্রয়োজন হবে।

এর মধ্যে প্রকল্পের বিদ্যুৎ উৎপাদনসূচি নিয়েও অনিশ্চয়তা কাটেনি। ইউনিট-১ থেকে চলতি বছরের ডিসেম্বরে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর কথা থাকলেও তা সম্ভব হচ্ছে না। ইউনিট-২-এর ক্ষেত্রেও সময়সূচি পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আইএমইডির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্প দপ্তর এখনো ইউনিট-১ ও ২-এর চূড়ান্ত উৎপাদনসূচি ও অসমাপ্ত কাজের পূর্ণাঙ্গ তালিকা দিতে পারেনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদনে বিলম্ব শুধু প্রশাসনিক সমস্যা নয়, এর আর্থিক প্রভাবও গুরুতর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রকল্প যত দেরি হবে, ততই সুদ ও পরিচালন ব্যয় বাড়বে। বেতন-ভাতা অনিশ্চয়তা তৈরি হলে দক্ষ জনবল ধরে রাখাও কঠিন হবে, যা কমিশনিং প্রক্রিয়াকে আরো ঝুঁকির মুখে ফেলবে।