Image description
সালতামামি ২০২৫

দেশের পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন ধরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আস্থাহীনতা থাকায় পুরো বছর জুড়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে একটি টাকাও বিনিয়োগ আসেনি পুঁজিবাজারে। ফলে চলতি বছরে পুঁজিবাজারে ধারাবাহিকভাবে সূচক, লেনদেন, মূলধন কমেছে। পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেক সাধারণ বিনিয়োগকারী। পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে দেখা গেছে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হস্তক্ষেপেও গতি ফিরে পায়নি পুঁজিবাজার। তবে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে পুঁজিবাজারের টেকসই উন্নয়ন, শৃঙ্খলা ফেরানো, অসদাচরণ রোধ, নজরদারির আধুনিকায়ন, সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের চেষ্টা করাসহ আইনকানুন সংশোধন এবং আধুনিকায়নের কাজ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জে কমিশন (বিএসইসি)। 

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়ছে পুঁজিবাজারে। এ অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও আস্থার সংকট তৈরি করেছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সবার প্রত্যাশা ছিল পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন মেলেনি। 

বাজার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ২০২৫ সালের ১লা জানুয়ারি ডিএসই’র প্রধান ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৫ হাজার ২১৮.১৫ পয়েন্টে। আর ১৮ই ডিসেম্বর তা অবস্থান করে ৪ হাজার ৮৩১.৪১ পয়েন্টে। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইএক্স সূচক কমেছে ৩৮৬.৭৪ পয়েন্ট বা ৭.৪১ শতাংশ। 

গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী ২০২৫ সালের ১লা জানুয়ারি ডিএসই’র বাজার মূলধন ছিল ৬ লাখ ৬৩ হাজার ৯০৫ কোটি ৩২ লাখ ১৬ হাজার টাকা। আর চলতি বছরের ১৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসই’র বাজার মূলধন বেড়ছে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭৫ হাজার ৮৬৬ কোটি ৫৮ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএসই’র বাজার মূলধন বেড়েছে ১১ হাজার ৯৬১ কোটি ২৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা বা ১.৭৬ শতাংশ।

এদিকে, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ডিএসইতে গড়ে প্রতিদিন লেনদেন হয়েছে মাত্র ৪৪০ কোটি টাকা। গত বছর এক্সচেঞ্জটিতে প্রতিদিন গড়ে ৬৩১ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে ডিএসই’র গড় লেনদেন কমেছে ১৯১ কোটি টাকা। আর সিএসইতে গত নভেম্বর পর্যন্ত চলতি বছরে প্রতিদিন গড়ে ১৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। আগের বছরে গড় লেনদেন হয়েছিল ২৯ কোটি টাকা।

আইপিওহীন বাজার: সারা বছরে বিএসইসি’র কাছে কোনো কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) আবেদনও জমা পড়েনি। শুধু আইপিও নয়, পুরো বছর জুড়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) কোনো কোম্পানিও কোয়ালিফাইড ইনভেস্টর অফারের (কিউআইও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে আগ্রহ দেখায়নি। এ ছাড়া, বছর জুড়ে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, উচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তি বিনিয়োগকারী, স্থানীয় ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বীমা কোম্পানির বিনিয়োগের সুযোগও ছিল খুবই নগণ্য। কেননা, বছরটিতে করপোরেট বন্ড ও মিউচুয়াল ফান্ডের অনুমোদন মিলেছে হাতেগোনা কয়েকটি।

সর্বসাধারণের বিনিয়োগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে পরিচিত আইপিও বন্ধ থাকায় পুরো বছর জুড়ে পুঁজিবাজারে অস্থিরতা বিরাজমান ছিল। বিনিয়োগকারীদের ধরে রাখতে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও হিসাব) রক্ষণাবেক্ষণের ফি বা মাশুল এক-তৃতীয়াংশে নামানো হলেও বাজার ছেড়ে যাওয়ার গতি থামানো যায়নি। শুধু বিনিয়োগকারী নয়, বছরটিতে পুঁজিবাজারের মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। 
অন্যদিকে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে বছর জুড়ে পুঁজিবাজারে নানা ধরনের সংস্কারের কথা বলা হলেও বস্তুতপক্ষে সংস্কার দেখা গেছে কেবল মার্জিন ঋণ বিধিমালা ও মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালা প্রণয়নে। এর মধ্যে মার্জিন ঋণ বিধিমালার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিটও করা হয়েছে। আর মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালায় মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডকে বিলুপ্ত করার মতো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যার সমালোচনাও কম নয়।

পুঁজিবাজারে সর্বশেষ পুঁজি সংগ্রহ করতে আইপিও নিয়ে হাজির হয়েছিল টেকনো ড্রাগস লিমিটেড, গত বছরের প্রথমার্ধেই কোম্পানিটি বাজার থেকে ১০০ কোটি টাকা তুলে নেয়। এরপর পুঁজিবাজারে আর কোনো কোম্পানির আইপিও অনুমোদন হয়নি। ওই বছর কেবল একটি আইপিও বাজারে এসেছিল। তবে, বছরটিতে আরও একটি কিউআইও অনুমোদন হয়েছিল। স্বল্প মূলধনের কোম্পানি ক্রাফটসম্যান ফুটওয়ার অ্যান্ড অ্যাক্সেসরিজ লিমিটেড কিউআইও প্রস্তাবের মাধ্যমে ৫ কোটি টাকা মূলধন সংগ্রহ করেছিল।

বন্ড ও ফান্ডের অনুমোদনও কমেছে
গত বছর বিএসইসি’র অনুমোদন সাপেক্ষে পুঁজিবাজার থেকে বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ১১টি প্রতিষ্ঠান ১৬ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছিল। এর মধ্যে ছয়টি ব্যাংক ও পাঁচটি উৎপাদন খাতের কোম্পানি ছিল। চলতি বছর শুধু ছয়টি ব্যাংককে ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা সংগ্রহের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া, চলতি বছর মাত্র একটি বে-মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যার অর্থ সংগ্রহের সীমা নির্ধারণ করা হয় ২৫ কোটি টাকা। গত বছর চারটি ফান্ড ইস্যুর মাধ্যমে ১২৫ কোটি টাকা উত্তোলনের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল।

নিষ্ক্রিয় ৬৬ হাজার বিনিয়োগকারী: ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে গত ১৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পুঁজিবাজারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৬৫ হাজার ৯৬২টি বিও হিসাবধারী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে সরাসরি বিও হিসাব বন্ধ হওয়ায় বাজার ছেড়েছেন ৪৩ হাজার ২৮৩ জন বিনিয়োগকারী। এ ছাড়া ২২ হাজার ৬৭৯ জন বিনিয়োগকারীর বিও হিসাব শেয়ার শূন্য হয়েছে আলোচিত সময়ে।

সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য অনুযায়ী, গত ১৮ই ডিসেম্বর শেষে পুঁজিবাজারে মোট বিও হিসাবের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৩৯ হাজার ১৬৯টি। গত বছরের ৩১শে ডিসেম্বর যা ছিল ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৪৫২টি। আর গত ১৮ই নভেম্বর শেষে শেয়ারশূন্য বিও হিসাবের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৬৫৩টি। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৯৭৪টি।
চলতি অর্থবছর থেকে বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ ফি বা মাশুল এক-তৃতীয়াংশে নামানো হয়েছে। এতদিন বিনিয়োগকারীদের থেকে প্রতি বছর বিও হিসাব রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৪৫০ টাকা হারে মাশুল নেয়া হলেও চলতি অর্থবছর থেকে তা মাত্র ১৫০ টাকা নেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, প্রতি বিও হিসাবের জন্য বিনিয়োগকারীদের রক্ষণাবেক্ষণ মাশুল ৩০০ টাকা কমানো হয়েছে। এই বিও হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ ফি কমিয়েও বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে ছেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।

পাঁচ ব্যাংক তালিকাচ্যুত: চলতি বছর পুঁজিবাজার থেকে শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংক তালিকাচ্যুত করা হয়েছে। পুঁজিবাজারের মাধ্যমে ওই পাঁচটি ব্যাংকে বিনিয়োগ করা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। 

শেয়ারের দাম সবচেয়ে কম: পুঁজিবাজারের ইতিহাসে এ বছরই কোনো শেয়ার ১ টাকার নিচে নেমেছে। এতে লেনদেন প্রক্রিয়ায় বিঘ্নও ঘটেছে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে। কেননা, প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ১ টাকার উপরের সব ধরনের ইক্যুইটি সিকিউরিটিজের ‘টিক সাইজ’ ১০ পয়সা নির্ধারিত রয়েছে। 

অন্যদিকে, সার্কিট ব্রেকারের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সীমা রয়েছে ১০ শতাংশ। ৯০ পয়সা দরের শেয়ারে ১০ শতাংশ পরিবর্তন মানে ৯ পয়সা। কিন্তু ‘টিক সাইজ’ যেহেতু ১০ পয়সা, তাই ৯ পয়সা বাড়া বা কমার সুযোগ ছিল না। তাছাড়া, ১০ পয়সা বাড়িয়ে শেয়ারদর ১ টাকা বা ১০ পয়সা কমিয়ে ৮০ পয়সা করাও সম্ভব নয়- তাহলে সার্কিট ব্রেকারের লিমিট ভাঙবে, নিয়মের লঙ্ঘন হবে। ফলে স্টক এক্সচেঞ্জ ১ টাকার নিচে লেনদেন হওয়া শেয়ারের জন্য নতুন ‘টিক সাইজ’ নির্ধারণ করেছে। এখন এক টাকার নিচে নেমে যাওয়া শেয়ারের লেনদেন ৮৯, ৮৮, ৮৭, ৮৬, ৮৫ পয়সা- এ ধরনের সূক্ষ্ম দরেও অর্ডার দেয়া যাচ্ছে।