বৃটিশ ভারতের সবচেয়ে বড় মুসলিম জমিদারি ঢাকার নওয়াব পরিবারের প্রভাব শুধু ঢাকাই নয়, পুরো পূর্ববাংলায় বিস্তার করেছিল। তবে চতুর্থ নবাব সলিমুল্লাহর সময়ে আইনি জটিলতায় প্রভাবশালী ওই ভূ-সম্পত্তি ও ওয়াক্ফ সম্পত্তি কোর্ট অফ ওয়ার্ডসের অধীনে চলে যায়। যা কোর্ট অব ওয়ার্ডসের উত্তরসূরি বাংলাদেশ ভূমি সংস্কার বোর্ড দেখাশুনা করছে। আর সরকারের এমনই এক শত কোটি টাকার জমি বিক্রি করে দিয়েছেন যুবলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেন তালুকদার ওরফে শুটার সাদ্দাম। দুই হাউজিং কোম্পানির সঙ্গে করা জমি বিক্রির ওই চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘উভয়পক্ষ আল্লাহর নামে শপথ করিলাম যে, কোনো ক্রমেই এই দখল হস্তান্তরনামা চুক্তি দলিলের তথ্য প্রকাশ করিবো না ও গোপন রাখিবো।’
ভূমি মন্ত্রণালয়ের ভূমি সংস্কার বোর্ডে মোতাহার হোসেন, মো. কামাল উদ্দিন, মো. কামাল মাস্টার, আব্দুল হালিম, মো. সালহী খান শহীদ, মতিউর, মো. ছালাম, মো. আল-আমিন, অচিন্ত কুমার রায়, সিদ্দিকুর রহমান, কবির হোসেন, খোরশেদ আলম, রাবেয়া পারভীন, কারছাল বেগম, আরিফ, আফজাল হোসেন, মাসুদ পারভেজ, মায়া আক্তার, সুফিয়া বেগম, সালেহা বেগম, হাসান, মোস্তাফিজুর রহমান, আনোয়ার দেওয়ান, দেলোয়ার হোসেন, মোস্তাক, নাজীর উদ্দিন, মহসিন, আছমাউল হুনা, জাহানারা বেগম, মোহম্মদ আলী, মাসুদ খান, ফাতেমা আক্তার, হানুফা বেগম, মো, রফিকুল ইসলামসহ ৪৪ জনের স্বাক্ষর করা এক আবেদনে দেখা যায়, ঢাকা আশুলিয়ার আউকপাড়া মৌজার ৪ ও ১৬ নম্বর সি.এস খতিয়ানের ১, ২, ৭, ১৫, ৭/৪৪, ১৯/৪৬, ২০/৪৭, ২৪/৪৮ ও ৩৪/৪৯ নম্বর সি.এস দাগে কোর্ট অফ ওয়ার্ডসের ঢাকা নওয়াব এস্টেটের মোট ২০ একর জমি রয়েছে। যেই জমিটি বেহাত হতে পারে বলে ভূমি সংস্কার বোর্ডে আবেদন করেছেন ওই ৪৪ জন বাসিন্দা। আবেদনে তারা উল্লেখ করেছেন- বাংলা ১৪১৪ সালে ন্যাশনাল প্লাজা বহুমুখী সমবায় সমিতি লিঃ-এর অনুকূলে ওই জমিটি লিজ দেয়া হয়। কিন্তু সমিতির নামে জমি নিয়ে শ্রমিক লীগের সহ-সভাপতি মো. আইয়ুব আলী শিকদার প্লট আকারে ভাগ ভাগ করে জমিটি বিক্রি করে দিতে শুরু করেন। বিষয়টি জানার পর ভূমি সংস্কার বোর্ড বাংলা ১৪১৫ সালে ওই জমি স্থানীয় ১১৯ জন ভূমিহীন ও নিম্নআয়ের মানুষের কাছে ১৪৩০ সাল (বাংলা) পর্যন্ত পুনরায় লিজ দেয়। তবে এরপরই বেপরোয়া হয়ে ওঠে আইয়ুব আলী শিকদার।
স্থানীয় যুবলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেন তালুকদার ওরফে শুটার সাদ্দামের সঙ্গে মিলে জমি দখলে ওঠেপড়ে লাগে। নিজস্ব বাহিনী দিয়ে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নতুন বরাদ্দ পাওয়াদের উচ্ছেদ করে ওই জমি বিক্রির উদ্দেশ্যে সাইনবোর্ড লাগায়। এমনকি ২ কোটি ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে উদয়ন হাউজিং ও স্বাধীন বাংলা হাউজিংয়ের কাছে দখল হস্তান্তর করেন। আর ওই জমিতে সর্বসাধারণের প্রবেশ ঠেকাতে অবৈধভাবে ৪টি গেট নির্মাণের জন্য ওই দুই আবাসন কোম্পানি থেকে অতিরিক্ত আরও ১৮ লাখ টাকা নেয়। ২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা নিয়ে দখল হস্তান্তরের ওই চুক্তি করা হয় ১শ’ টাকার তিনটি স্ট্যাম্পে। মানবজমিনের হাতে আসা ওই স্ট্যাম্প পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সেখানে প্রথম পক্ষ দলিলদাতা হিসেবে উল্লেখ রয়েছে- মো. সাদ্দাম হোসেন তালুকদার, পিতা- রফিকুল ইসলাম তালুকদার, সাং-আউকপাড়া, থানা আশুলিয়া ন্যাশনাল প্লাজা বহুমুখী সমবায় সমিতির প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। আর দ্বিতীয় পক্ষ দলিল গ্রহীতা ও দখল গ্রহীতা হিসেবে উদয়ন হাউজিং ও স্বাধীন বাংলা হাউজিংয়ের পক্ষে ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সাং উদয়ন হাউজিং প্রকল্প, আউকপাড়া উল্লেখ করা হয়েছে। এরপরই উল্লেখ করা হয়েছে- ‘উভয়পক্ষই আল্লাহর নামে শপথ করিলাম যে, কোনো ক্রমেই উভয়পক্ষ এই দখল হস্তান্তরনামা চুক্তি দলিলের তথ্য প্রকাশ করিবো না ও গোপন রাখিবো।’ ‘উক্ত সম্পত্তি দখল ও মালিকানা ফিরে পাওয়ার জন্য বর্তমান দখলীয় পক্ষ পথম পক্ষের নিতট হইতে দখল পজিশন বুঝিয়া নেয়া ও দেয়ার জন্য উভয়ে একমত হইলাম।’ স্ট্যাম্পের দুই নম্বর পাতার ৩ নম্বর প্যারায় উল্লেখ করা হয়েছে- ‘ সম্পত্তির যেকোনো এক পাশ থেকে প্রথম পক্ষকে ৫ শতাংশের মোট ৩০টি প্লট দেয়া হবে।’ এরপর আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সম্পত্তিতে মেইন রোড থেকে ভেতরে ঢোকার যে রাস্তা আছে- সেই রাস্তার মুখে আরসিসি পিলার দিয়ে বড় লোহার গেট নির্মাণ করে দিবে প্রথম পক্ষ। গেট নির্মাণ বাবদ ১৮ লাখ টাকা দেয়া হবে প্রথম পক্ষকে। ৮ লাখ টাকা নগদ ও বাকি টাকা ৫ লাখ করে দুই কিস্তিতে দেয়া হয়। আর এই পুরো পজিশন বুঝিয়ে দিতে প্রথম পক্ষকে ৩ মাস সময় বেঁধে দেয়া হয়। আর যেদিন ওই জমির পজিশন বুঝিয়ে দেয়া হবে সেদিনই ২ কোটি ২০ লাখ টাকার পে-অর্ডার বুঝিয়ে দেয়া হবে বলেও চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই পজিশন বুঝিয়ে দেয়ার পর জমি থেকে প্রথম পক্ষের সকল সাইনবোর্ড নিজেরাই সরিয়ে নিবেন। একই সঙ্গে পরবর্তী সময়ে সরকারি অফিস কিংবা অন্য কারো দ্বারা প্রথম পক্ষ যদি হুমকিতে পরে তাহলে দ্বিতীয় পক্ষ সার্বিক সহযোগিতা করবে এবং দ্বিতীয় পক্ষ সকল দ্বায়-দায়িত্ব গ্রহণ করবে বলেও স্ট্যাম্পে মোটা দাগে উল্লেখ করা হয়েছে। চলতি বছরের ২০শে মে সম্পাদন হওয়া ওই স্ট্যাম্পে প্রথম পক্ষের হয়ে স্বাক্ষরও করেছেন সাদ্দাম হোসেন ও দুই পক্ষের হয়ে সাক্ষী হয়ে স্বাক্ষর করেছেন দীন ইসলাম, মুকুল ইসলাম ও মনির।
বিষয়টি নিয়ে মো. ফিরোজ নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, যা প্রতিবছর নবায়নযোগ্য শর্তে অস্থায়ী কৃষি প্রকল্পের আওতায় বাংলা ১৪১১ সলের ১লা মাঘ ন্যাশনাল প্লাজা বহুমুখী সমবায় সমিতি লিঃ-এর কাছে আউকপাড়া মৌজার ওই জমি লিজ দেয়া হয়। কিন্তু তারা সমিতির নামে জমি লিজ নিয়ে শর্ত ভঙ্গ করে আবদুল মোমেন চৌধুরীর সঙ্গে ১শ টাকা ও ৫০ টাকার নন জুডিশিয়াল ২টি স্ট্যাম্পে ১ কোটি ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ১৫ একর জমির সাব-লিজ চুক্তি করে। এ ছাড়াও নূর হোসেন চার্লীসহ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে জমি বিক্রি করেছেন আইয়ুব আলী শিকদার ও শুটার সাদ্দাম। এসব অভিযোগে ওই জমি পুনরায় ৩টি সংস্থা/সমিতির মধ্যে লিজ দিয়ে সরজমিন বুঝিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু ওই আইয়ুব আলী গংরা জমির সীমানা প্রাচীর ভেঙে অবৈধভাবে জোর করে দখল করে নেন। এস্টেটের ম্যানেজারের স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া চুক্তিপত্র তৈরি করে সুপ্রিম কোর্টে রিট পিটিশন (নং-৭৭১/২০০৮) করে। এরপর বেপরোয়া হয়ে ওঠে তারা। যুবলীগ নেতা সাদ্দামের বাহিনীকে নিয়ে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ওই জমি থেকে সাধারণ বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করে পুরো জমিই দখলে নিতে শুরু করে। পুরো জমিতে তাদের নামে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেয়। এরই একপর্যায়ে ভূমিদস্যু দুই আবাসন কোম্পানির কাছে নামে মাত্র টাকায় সরকারি জমি বিক্রি করে দেয় তারা। আর সরকারি সম্পত্তি বিক্রির ওই টাকা দিয়ে ‘সাদ্দাম এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন সাদ্দাম। এই ভুক্তভোগী বলেন, এই যুবলীগ নেতা এলাকায় শুটার সাদ্দাম নামে পরিচিত। তার আলাদা কিশোর গ্যাং রয়েছে। তাদের ভয়ে কেউ কথা বলতে সাহস করে না। ৫ই আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের এমপি ড. এনামসহ সকলের সঙ্গেই তাকে দেখা যেত। তার নামে হত্যা মামলাসহ আশুলিয়া থানাতেই অন্তত ১২টি ফৌজদারি মামলা রয়েছে। আর শ্রমিক লীগ নেতা আইয়ুব আলী ওরফে কিলার শিকদারের নামে ৭টি মামলা রয়েছে। এ ছাড়াও তাদের দু’জনের বিরুদ্ধেই অপহরণ, চাঁদাবাজি, জবর-দখলসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে। মো. আলাউদ্দিন নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, ঢাকা নওয়াব এস্টেটে এই শুধু আইয়ুব আলী ও শুটার সাদ্দামই জড়িত নয়। তাদের সঙ্গে কান কাটা রফিক, দালাল রাসেল, দস্যু অপু, দালাল জুয়েল, জামাই সেলিম, চাচা মনির, বাবা শাওন, শ্যামা, গুটি রাকিব, বদ আলম কসাই শাহীন, আকাশসহ অনেকেই জড়িত। এদের সকলের নামেই একাধিক মামলা রয়েছে। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তারা সকলে মিলেই এই সরকারি জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে কথা বললেই নির্যাতনের শিকার হতে হয়, এলাকা ছাড়তে হয়।
তবে সরকারি সম্পত্তি বেদখল ও প্রশাসনের নীরবতার বিষয়ে জানতে মানবজমিন রাজধানীর তেজগাঁও ভূমি সংস্কার বোর্ডে গেলে এ বিষয়ে কথা বলতে কেউই রাজি হননি। উপরন্ত মানবজমিনের অনুসন্ধান টের পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন বরাবর একটি চিঠি প্রেরণ করেছে ভূমি সংস্কার বোর্ড। সেই চিঠিতেও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে-‘ আইয়ুব আলী সিকদার অবৈধভাবে ঢাকা নওয়াব এস্টেটের জমিতে গেট নির্মাণ ও জমি দখল করেছেন। এটি সম্পূর্ণ অবৈধ। কোর্ট অব ওয়ার্ডস, ঢাকা নওয়াব এস্টেটের মালিকানাধীন ২০ একর জমিতে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড স্থাপন অবৈধ এবং অপসারণযোগ্য। অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা কামনা করা হলো।’
তবে বিষয়টি নিয়ে আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুবেল হাওলাদার মানবজমিনকে বলেন, আমি সদ্য এখানে বদলি হয়ে এসেছি। আগের ওসি আমাকে এমন কোনো চিঠি বুঝিয়ে দিয়ে যাননি। আমি এই বিষয়ে অবশ্যই খোঁজ নিবো।
বিষয়টি নিয়ে অভিযুক্ত যুবলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেন তালুকদারের এলাকায় গিয়ে একাধিকবার খোঁজ করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার কল করলেও তা বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।