ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ সমমনা ৮ দলের জোট ঘিরে চলছে নানা মেরূকরণ। এই আট দলের আসন সমঝোতা চূড়ান্ত হওয়ার আগেই নতুন করে আরও ৪ দল এই জোটে যুক্ত হতে যাচ্ছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপিসহ এই চারদলের বিষয়ে আজ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এ ছাড়া আরও দুই একটি দল এই জোটে যুক্ত হতে পারে এমন আলোচনাও আছে। ওদিকে জামায়াতের নেতৃত্বে জোটে যাওয়া নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টিতে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। দলের এই সিদ্ধান্তে নাখোশ সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা দল ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন বলে জানিয়েছেন। এ ছাড়া জামায়াতের সঙ্গে জোট করার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে গতকাল দলের ৩০ নেতা আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে চিঠি দিয়েছেন।
আট দলীয় জোট সূত্র জানায়, এনসিপি, এবি পার্টি, এলডিপি ও লেবার পার্টি নির্বাচনী জোটে যুক্ত হতে যাচ্ছে। এতে আসন সমঝোতায় কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে আট দলের লিয়াজোঁ কমিটি দফায় দফায় বৈঠক করে দ্রুত সমাধানের দিকে এগুচ্ছে বলে সূত্র জানায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আসন সমঝোতা চূড়ান্ত করতে গতকাল ৮ দলের লিয়াজোঁ কমিটির সর্বশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে ৮০ ভাগ আসন বণ্টনে লিয়াজোঁ কমিটি ঐকমত্যে পৌঁছেছে। অবশিষ্ট ২০ ভাগ আসনের বিষয়ে শীর্ষ নেতারা চূড়ান্ত করবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামীকালের মধ্যে এটা চূড়ান্ত হবে বলে সূত্র জানায়। এদিকে লিয়াজোঁ কমিটির অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের
মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দিন আহমদ জানান, কোনো কারণে ২৯শে ডিসেম্বরের মধ্যে আসন সমঝোতা চূড়ান্ত না হলেও সমস্যা নেই। মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষদিন পর্যন্ত আসন সমঝোতার সুযোগ থাকবে।
তিনি বলেন, জোটের বৃহৎ স্বার্থে আমরা যেকোনো প্রার্থী যেকোনো সময় ছাড় দিতে রাজি।
ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন বলেন, ৮ দলের লিয়াজোঁ কমিটির আলোচনা বেশ সন্তোষজনক। আমরা সবাই দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠার চেষ্টা করছি। সেক্ষেত্রে আসন সংখ্যা নিয়ে বিরোধ নেই বললেই চলে। তিনি বলেন, এনসিপি’র সঙ্গে আসন সমঝোতার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেটা হলে আট দলের পরিধি আরও বাড়বে।
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির লক্ষ্যে গণভোটসহ পাঁচ দফা দাবিতে সাম্প্রতিককালে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করে আসছে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ সমমনা ৮ দল। এর মধ্যেই নির্বাচনী জোটের কলেবর বাড়ানোর দিকেও মনোযোগী হয়েছে জামায়াতের নেতৃত্বাধীন এই জোট। এ পর্যায়ে তারুণ্যনির্ভর দল এনসিপি এই জোটের সঙ্গী হতে যাচ্ছে। খুব শিগগিরই বর্ধিত পরিসরে এই জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
ইসলামী আন্দোলনের সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ুম বলেন, মূলধারার সব ইসলামী দল আমাদের সঙ্গে আছে। নামকাওয়াস্তে ১/২টি ইসলামী দল এদিকে ওদিক উঁকি দিলেও ৮ দলীয় জোটই বড় হবে।
সূত্র মতে, আসন্ন নির্বাচনে ইসলামী দলগুলোর ভোট এক বাক্সে নেয়ার আওয়াজ ওঠে ৫ই আগস্টের পট পরিবর্তনের পর থেকে। এক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকায় নামেন ইসলামী আন্দোলনের আমীর মুফতি সৈয়দ রেজাউল করীম (পীর চরমোনাই)। তাকে সমর্থন জোগান জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। তাৎক্ষণিক এই দুই নেতার সম্মিলিত উদ্যোগ অনেকটা সফলও হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
গত জুলাই মাসে রাজধানীর সোহরওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলন ও জামায়াতে ইসলামীর দুই দুইটি মহাসমাবেশে যার প্রতিফলন ঘটে। ওই দুই দলের ব্যানারে মহাসমাবেশ দুইটি অনুষ্ঠিত হলেও এনসিপিসহ ইসলামী এবং সমমনা অন্তত ১০টি দলের শীর্ষ নেতারা এতে বক্তব্য রাখেন। এ সময় ওইসব দলের বক্তারা আগামী নির্বাচনে সব ইসলামী এবং সমমনা দলের ভোট এক বাক্সে দেয়ার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু জুলাই সনদে স্বাক্ষর নিয়ে সম্প্রতি জামায়াতের সঙ্গে তীব্র বিরোধে জড়ায় এনসিপি।
যদিও শেষ পর্যন্ত জামায়াত ও এনসিপি’র মধ্যে আসন সমঝোতা ও জোট গঠনের আলোচনা অনেকটাই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। দল দু’টির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আজই জোট ও আসন সমঝোতার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে। জামায়াত ৩০টির মতো আসন এনসিপিকে দেয়ার ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছে বলেও এনসিপি’র দলীয় সূত্র জানিয়েছে। এদিকে, এনসিপি’র জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে গণতান্ত্রিক সংস্কার জোটে। বড় দুই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে শরিকদের মধ্যে এই মতভেদ দেখা দিয়েছে। নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন ২৯ই ডিসেম্বর। গত বুধবার রাতে দুই দফা এবং বৃহস্পতিবার এক দফা বৈঠক করেছে জামায়াত ও এনসিপি’র শীর্ষ নেতারা।
এনসিপি’র দলীয় সূত্র বলছে, এনসিপি ৫০টির বেশি আসন দাবি করলেও জামায়াত প্রাথমিকভাবে ৩০টির মতো আসনে ছাড় দেয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট ইতিবাচক।
তবে জামায়াতের সঙ্গে জোটের প্রশ্নে এনসিপি’র ভেতরেই বিভক্তি তৈরি হয়েছে। দলটির কয়েকজন নেতা প্রকাশ্যে বিরোধিতাও করছেন। সমপ্রতি দলের যুগ্ম সদস্য সচিব মীর আরশাদুল হক পদত্যাগ করেছেন। সাবেক দুই ছাত্র উপদেষ্টা ও তাদের সমর্থকরা বিএনপি’র সঙ্গে জোটের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এদিকে, এনসিপি’র অনেক নারী নেত্রীই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটে যেতে আগ্রহী নয় বলেও গুঞ্জন চাউর হয়েছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও লেখালেখি হচ্ছে। এসব বিষয়ে নিয়ে দলটির মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্য সচিব মুশফিক উস সালেহীন মানবজমিনকে বলেন, আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে। আজ আসন সমঝোতার বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে।
গণতান্ত্রিক সংস্কার জোটে ফাটল: এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন মিলে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। গত শুক্রবার সকালে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন দলটির নেতারা।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কাইয়ূম বলেছেন, গণতান্ত্রিক সংস্কার জোটের দুই দল এনসিপি ও এবি পার্টি বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতার আলোচনা করছে বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে খবর ছড়িয়েছে। যদিও এসব বিষয়ে জোটের আরেক শরিক রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। খবরটি সত্যি হয়ে থাকলে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন আর এই জোটে থাকবে না।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি অভিযোগ করে বলেন, এনসিপি ও এবি পার্টি জোটের আকাঙ্ক্ষা মানছে না। এনসিপি জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা করতে গেছে এ কথা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চাউর হওয়ার পর আমাদের দল, দলের বাইরের লোকজন, শুভানুধ্যায়ী, যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র ও অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি হিসেবে মনে করেন, তাদের মধ্যে একধরনের কনফিউশন (সংশয়) সৃষ্টি হয়েছে যে, জোটের অংশীদার হয়ে আমরা জামায়াতের কাছে চলে যাচ্ছি।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট এই জোট আরও অনেক বড় হবে। অন্যরাও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হবেন।
জোটের বিষয়ে মঞ্জু বলেন, আমাদের জোটের মুখপাত্রের দায়িত্ব নাহিদ ইসলামের ওপরই আছে। তিনি বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে কথা বলেছেন। এখনো চূড়ান্তভাবে আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। নাহিদের আলোচনার প্রেক্ষিতেই আমরা হয়তো কম্বাইন্ড সিদ্ধান্ত নেবো, নাহলে এই ব্যাপারে আমরা একটি পজিশন নেবো।