Image description

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে  ‘ভূতুড়ে কাণ্ড’ শুরু হয়েছে। সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে অবলীলায় নিজের হাতে দল বা সংগঠন ছেড়ে বড় দলে যোগ দিয়েছেন পরিচিতি কয়েকজন রাজনীতিক। একাধিক মুক্তিযোদ্ধা ফুল হাতে সহাস্য যোগ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা জামায়াতে ইসলামীতে। ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে, ততই নানা চিত্র উঠে আসছে প্রতিদিন। সর্বশেষ, আলোচনায় এসেছে, বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামের সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে যাচ্ছে এনসিপি। এই পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচনে কার সঙ্গে কার ভোট হচ্ছে, এ নিয়ে রীতিমতো আলোচনা শুরু হয়েছে।

গত কয়েকদিনে রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ না থাকায় অনেকটাই ‘একপক্ষীয় ভোট’ হওয়ার পরিস্থিতি রয়েছে। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার যথাসম্ভব ভোটারের অংশগ্রহণ বাড়াতে প্রচেষ্টা শুরু করেছে। নির্বাচনি কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা। এক্ষেত্রে বর্তমানে নির্বাচনমুখী দলগুলোর মধ্যে দুটো প্রধান পক্ষ তৈরি হয়েছে। তৃতীয় একটি পক্ষ রয়েছে, যারা এখনও শক্তি প্রদর্শন করতে পারেনি। এই দলগুলোর মধ্যে জাতীয় পার্টির দুই অংশ, বাম-প্রগতিশীল, সুন্নী-ইসলামি-মাজারপন্থি দল রয়েছে।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ধারা, কে কোন দল ছাড়লেন

বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, নির্বাচনমুখী দুটি ধারা তৈরি হয়েছে। একটি বিএনপির নেতৃত্বে, অন্যটি জামায়াতকে কেন্দ্র করে। বিএনপির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক নাগরিক বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টি, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন।

গত শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) সংবাদ সম্মেলন করে একক নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে জেএসডি। ফলে, আদৌ গণতন্ত্র মঞ্চ সক্রিয় কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বিএনপির সমর্থন নিয়ে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সাইফুল হক, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি ও গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর। এর বাইরে বাকি যেসব দল বিএনপির সঙ্গে বিগত কয়েক বছর ধরে যুগপৎ আন্দোলনে সক্রিয় ছিলো, তাদের মধ্যে এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বিএনপিতে যোগ দিয়ে ধানের শীষ প্রতীক নিয়েছেন। তিনি ২৪ ডিসেম্বর রাতে মির্জা ফখরুলের কাছ থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন।

বর্তমান আরপিও অনুযায়ী জোটের প্রার্থী হলে প্রত্যেককে নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করার শর্ত থাকায় বিভিন্ন দলের নেতাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করতে নিজ দল ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দিয়ে ধানের শীষ প্রতীক গ্রহণ করেছেন।

এদের মধ্যে প্রথমদিকে বাংলাদেশ এলপিডির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম তার প্রতিষ্ঠিত দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দিয়ে লক্ষ্মীপুর-১ থেকে নির্বাচন করছেন। যদিও বাংলাদেশ এলপিডির একটি অংশ সক্রিয় রয়েছে। জাতীয় দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে যোগ দিয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে নির্বাচন করছেন সৈয়দ এহসানুল হুদা। তার পদত্যাগের পর ১২ দলীয় জোটও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।

নির্বাচন করতে পারছেন না মোস্তফা জামাল হায়দার

১২ দলীয় জোটের প্রধান সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জামাল হায়দারকে পিরোজপুর-১ আসনে সমর্থন দিয়েছে বিএনপি। যদিও শনিবার সন্ধ্যায় বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি জানান, অসুস্থতাজনিত কারণে নির্বাচন করছেন না।

মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ‘আমার মনে হয় আমি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবো না। কারণ, আমার শরীর ভালো নেই। আমি মহাসচিবকে জানিয়েছি, তারা যেন নির্বাচনে তাদের প্রার্থীও রাখে। আমি কোন পর্যন্ত যেতে পারবো জানি না। শরীরটা সায় দিচ্ছে না।’ তার দলের মহাসচিব আহসান হাবিব লিংকনও নির্বাচন করার অবস্থায় নেই বলে জানান জাতীয় পার্টির এই চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল।

এদিকে, শনিবার দুপুরে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সালাহ উদ্দিন আহমদের হাতে ফুল দিয়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক মো রাশেদ খান। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঝিনাইদহ-৪ (সদর ও কালীগঞ্জ) আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।

২৪ ডিসেম্বর গুলশানে সংবাদ সম্মেলনে কর্নেল (অব.) অলি আহমদের দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ বিএনপিতে যোগ দেন। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি কুমিল্লা–৭ আসনে বিএনপির প্রার্থী হচ্ছেন। এ আসনে তিনি আগেও সংসদ সদস্য ছিলেন। বিএনপির সরকারে প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন তিনি। তার পদত্যাগের পর এলডিপি জানায়, তারা একক নির্বাচন করবে। যদিও কারও দাবি, এলডিপি জামায়াত-জোটে যেতে চাইছে।

নড়াইল–২ আসনে প্রার্থী হবেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ। এনপিপি নিবন্ধিত না হওয়ায় তিনি বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করবেন।

আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ২৭২টি আসনে দলীয় সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে বিএনপি। অন্য ২৮টি থেকে সমঝোতার মাধ্যমে শরিকদের দেওয়া হয়েছে। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশকে ৫টি আসন ছেড়ে দিয়েছে বিএনপি। আসন পাঁচটি হলো সিলেট-৫, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২, নীলফামারী-১ ও নারায়ণগঞ্জ-৪ যশোর-৫ । দলটি তাদের প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেবে বলে জানিয়েছেন মহাসচিব মাওলানা মুঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী।

ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৬৮টি বা তার বেশি রাজনৈতিক দল ও জোট বিএনপির সঙ্গে বিগত ২০২২ সাল থেকে সক্রিয় ছিল। এদের মধ্যে সমর্থন ও দলে নেওয়ার মধ্য দিয়ে মাত্র ১২ টি আসনেই ছাড় দিলো বিএনপি। শনিবার রাতে এই প্রতিবেদন লেখার সময় আরও কোনও দলকে বিএনপি আসন ছাড় দেবে কিনা, এ নিয়ে শেষ কথা বলার সময় আসেনি বলে জানান স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।

এনসিপি-জামায়াত জোট ‘ঠেকাতে তৎপরতা

বিএনপি ও তার সঙ্গীদের বাইরে জামায়াতকে কেন্দ্র করে একটি বড় নির্বাচনি জোট গঠনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এই প্রক্রিয়াটি আরও কিছুদিন চলবে বলে জানা গেছে এনসিপি ও জামায়াতের সূত্রে। জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিসহ আটটি দলের একটি জোট রয়েছে। এই জোটকে পাশে রেখেই এনসিপি-জামায়াতের নির্বাচনি পরিকল্পনা চলছে। এনসিপিও এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জোটবদ্ধ।

এনসিপির একজন কেন্দ্রীয় সংগঠক বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, নির্বাচনি জোট এনসিপি করছেই। জামায়াতের সঙ্গেই খানিকটা চূড়ান্ত। যদিও এই জোট না হওয়ার জন্য দলের ভেতরে বাইরে প্রচণ্ড চাপ রয়েছে। এমনকি বিএনপির একটি পক্ষ থেকেও চাপ রয়েছে বলে জানান তিনি।

মিডিয়াতে কথা বলায় দলের নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে পরিচয় উদ্ধৃত হতে অনিচ্ছুক এনসিপিসূত্রটি উল্লেখ করেছে, প্রস্তাবে নাহিদ ইসলামকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করা হবে এই জোট থেকে। তবে এসব কিছু চূড়ান্ত কিছু করার সময় আসেনি। তিনি জানান, এনসিপির নেতারা বিগত ২০১৮ সাল থেকে আন্দোলনে যুক্ত থেকে অনেকটাই ক্লান্ত। তারা দল গোছাতে চান। সংগঠন দাঁড় করিয়ে নির্বাচনের পক্ষে। এ কারণে আপাতত আগামী নির্বাচনে বড় কোনও দলের সঙ্গে করার পক্ষে এনসিপি।

জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির জোট নিয়ে আলোচনার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, “এনসিপির দৃশ্যমান যে পলিসি, রাজনৈতিক অবস্থান যেটুকু প্রকাশ পেয়েছে; মহান মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে, সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এ ধরনের মেরূকরণ হলে বড় ধরনের ডিপার্চার হবে। এটাকে কৌশলের কথা বলে এনসিপির ভবিষ্যৎ ও সম্ভাবনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। রাজনৈতিক ঝুঁকি মধ্যে পড়বে। তাদের দরকার হবে যারা লিবারেল রাজনীতি করছে তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে পারলে ভালো, না হলে প্রয়োজনে বিএনপির সঙ্গে তাদের আলাপ হতে পারে।”

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে ফোন করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। জামায়াতের নায়েবে আমির ডা সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহেরকেও পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে, জামায়াতসহ আট দলের যে বিদ্যমান জোট রয়েছে, সেটিতেও অস্থিরতা শুরু হয়েছে। জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ইতোমধ্যে কঠোর অবস্থানে গেছে। এনসিপির কাছাকাছি আসার কারণে দলটির প্রধান মাওলানা মামুনুল হক অনেকটাই দূরত্ব সৃষ্টি করছেন বলে ইতোমধ্যে স্পষ্ট।

ভোটের মাঠে নামতেই পারছে না ১৪ দলীয় জোটের শরিকেরা

জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিতে খবর নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচন করার আগ্রহ থাকলেও ভোটের মাঠে নামতে পারছেনা ১৪ দলীয় জোটের শরিকেরা।

শনিবার সন্ধ্যায় জোটের একটি দলের নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, "আমাদের দলের অন্য কেউ সম্ভবত এখনও মনোনয়ন তুলতে যায়নি। যারা আগে ভোট করতে চাইতেন, তাদের একজন চাদরে মুখ ঢেকে দেখা করলেন।"

নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে রবিবার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, বলে জানান জাসদের একজন নেতা।

ওয়ার্কার্স পার্টির একজন নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তারা এখনও অনিশ্চিত।

সাম্যবাদী দলের নেতা সামিউল হক বাংলা ট্রিবিউনকে কয়েকদিন আগে বলেছিলেন, "এখনও নির্বাচনের বিষয় নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।"

১৪ দলীয় জোটের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বামদের একটি জোট সক্রিয়। সিপিবি, বাসদসহ বেশ কয়েকটি দলের সমন্বয়ে গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছে, এ ব্যানারে তারা নির্বাচন করবে।

জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কথা জানিয়েছে। প্রার্থী ঘোষণা করেছে জাতীয় পার্টি আনিসুল ইসলাম মাহমুদের অংশটিও। শনিবার শীর্ষনেতারা মনোনয়ন ফরম উত্তোলন করেছেন।

তবে জাতীয় পার্টি জিএম কাদের অংশের মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম পাটোয়ারী জানিয়েছেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না হলে তারা নির্বাচন থেকে বেরিয়ে যাবেন।

জাপার একজন সিনিয়র নেতা জানান, জিএম কাদেরের জাপার আনিসুল, হাওলাদার অংশের সঙ্গে মিলতে অনীহা রয়েছে।

এর বাইরে সুন্নি, মাজার, খানকাভিত্তিক দলগুলো একটি বৃহত্তর জোটের চেষ্টা চালাচ্ছে। সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দিন আল হাসানীর নেতৃত্বে এ জোট হতে পারে। সম্ভাব্য এ জোটে থাকবে প্রগতিশীল ইসলামী জোট।

জানতে চাইলে প্রগতিশীল ইসলামী জোটের চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য এম এ আউয়াল বলেন, “আওয়ামী লীগের সময় বিএনপিকে বাদ দিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব হয়নি। এখনও সেই একই পরিস্থিতি। ১৪ দলসহ আরও যারা আছে তাদের অংশগ্রহণ কোথায় নির্বাচনে? দের নির্বাচনের আনার জন্য সরকারও তৎপরতা করেনি। সংলাপে ডাকা হয়নি। তাহলে দেশের এই অংশটিকে কীভাবে নির্বাচনে যুক্ত করবে সরকার?”

সূত্র জানায়, নতুন এই জোট ২০০ আসনে প্রার্থী খুঁজছে।

এ বিষয়ে এম এ আউয়াল বলেন, “প্রগতিশীল ইসলামী জোটসহ আরও একাধিক জোটসহ বৃহত্তর জোটের প্রক্রিয়া চলমান আছে। আমরা জোটবদ্ধ নির্বাচন করবো।"