যে কোনো সরকারি সেবা নিত দেশের অতি ধনীরা সবচেয়ে বেশি ঘুষ দেন, আর ঘুষ প্রদানে শীর্ষে রয়েছেন নোয়াখালীর মানুষ। সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ- এই প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে নিতে গিয়ে অন্তত ৬৩ দশমিক ২৯ শতাংশ নাগরিক দুর্নীতির শিকার হয়েছেন।
এ ছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ৫৭ দশমিক ১৬ শতাংশ এবং পাসপোর্ট অফিস ৫৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ। বিবিএসের সিটিজেন পারসেপশন সার্ভের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে।
বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিবিএস অডিটোরিয়ামে এক প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার। অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব এস এম শাকিল আখতার, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বিবিএস ডিজি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ৬-২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সময়ে দেশব্যাপী ‘সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে (সিপিএস)’ পরিচালনা করে।
৬৪ জেলার এক হাজার ৯২০টি প্রাইমারি স্যাম্পলিং ইউনিট (পিএসইউ) থেকে ৪৫ হাজার ৮৮৮টি খানার ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী মোট ৮৪ হাজার ৮০৭ জন উত্তরদাতার (পুরুষ : ৩৯ হাজার ৮৯৪, নারী : ৪৪ হাজার ৯১৩) সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলছে, দুর্নীতির তালিকায় বিআরটিএ সবচেয়ে এগিয়ে, এর পরেই রয়েছে আইন-প্রয়োগকারী সংস্থা (৫৭.৯৬ শতাংশ) এবং পাসপোর্ট অফিস (৫৭.৪৫ শতাংশ)। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশ নাগরিক গত ১২ মাসে কোনো না কোনো সরকারি সেবা নিতে গিয়ে সরাসরি ঘুষ দিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন।
সার্ভে বলছে, ঘুষ দেওয়ার মধ্যে পুরুষদের দেওয়ার হার (৩৮.৬২শতাংশ), নারীদের ২২ দশমিক ৭১ শতাংশ। প্রায় ৯৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ জনগণ ঘুষ হিসেবে ‘টাকা’ দেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।
সিটিজেন পারসেপশন জরিপের তথ্য বলছে, প্রায় ১৮ দশমকি ৪৮ শতাংশ জনগণ ঘুষ হিসেবে ‘টাকা’ দেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। নোয়াখালী জেলার ৫৭ শতাংশ মানুষ ঘুষ দেন, কুমিল্লার ৫৩ শতাংশ এবং ফরিদপুরের ৫১ শতাংশ মানুষ ঘুষ দেন। সবচেয়ে কম ঘুষ দেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ- এ জেলার মাত্র ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ মানুষ ঘুষ দেন। এছাড়া মাগুরারি ১৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ মানুষ সরকারি সেবা নিতে ঘুষ দেন। জরিপে দেখা যায়, দেশের ৮৪ দশমিক ৮১ শতাংশ নাগরিক সন্ধ্যার পর নিজ বাসার আশপাশের এলাকায় একা চলাফেরা করতে নিরাপদবোধ করেন। এ নিরাপত্তাবোধ পুরুষদের (৮৯.৫৩ শতাংশ) তুলনায় নারীদের (৮০.৬৭ শতাংশ) বেশ কম। সন্ধ্যার পর নিজ বাড়িতে নিরাপত্তাবোধের হার তুলনামূলকভাবে বেশি (৯২.৫৪ শতাংশ)।
সুশাসনের বিষয়ে, মাত্র ২৭ দশমিক ২৪ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, তারা সরকারি সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারেন। রাজনৈতিক প্রভাবের ক্ষেত্রে এই হার আরও কমে ২১ দশমিক ৯৯ শতাংশে নেমে আসে। জাতীয়ভাবে, প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২৪.৬২ শতাংশ) জনগণ মনে করেন, দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সাড়াপ্রবণ। এ বিষয়ে পল্লী (২৪.৪৭ শতাংশ) ও শহরের (২৪.৯১ শতাংশ) জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় কোনো পার্থক্য নেই।
গত ১২ মাসে সরকারি সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, জাতীয়ভাবে ৪৭ দশমিক ১২ শতাংশ জনগণ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছেন। এছাড়া ৪০ দশমিক ৯৩ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তাদের অন্তত একটি সন্তান সরকারি বিদ্যালয়ে (প্রাথমিক/ মাধ্যমিক) পড়াশোনা করেছে। তদুপরি, ৭৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ জনগণ অন্যানা সরকারি সেবা (পরিচয়পত্র/নাগরিক নিবন্ধন) গ্রহণের অন্তত একটি প্রচেষ্টা করেছেন।
এ সেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে ৫টি মাত্রার ভিত্তিতে দেখা যায়, স্বাস্থ্যসেবায় সামগ্রিক সন্তুষ্টির হার ৭২ দশমিক ৬৯ শতাংশ, প্রাথমিক শিক্ষায় ৮১ দশমিক ৫৬ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ৭৮ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং অন্যান্য সরকারি সেবায় (পরিচয়পত্র/নাগরিক নিবন্ধন) ৬৬ দশমিক ৯১ শতাংশ সন্তুষ্টি হার রিপোর্ট করা হয়েছে।
জাতীয়ভাবে, প্রায় ১৬ দশমিক ১৬ শতাংশ জনগণ গত দুবছরে কোনো বিবাদ বা বিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশ (৮৩.৬০ শতাংশ) জনগণ বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আনুষ্ঠানিক (যেমন : আদালত) অথবা অনানুষ্ঠানিক (যেমন : কমিউনিটি নেতা) কোনো না কোনো ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার পেয়েছেন। এর মধ্যে ৪১ দশমিক ৩৪ শতাংশ আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এবং ৬৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেবা পেয়েছেন।
ফলাফল অনুযায়ী দেশের ১৯ দশমিক ৩১ শতাংশ জনগণ কোনো না কোনো ধরনের বৈষম্যের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। বৈষম্যের প্রধান ভিত্তি ছিল আর্থ-সামাজিক অবস্থা (৬.৮২ শতাংশ) এবং লিঙ্গ (৪.৪৭ শতাংশ)। বৈষম্যের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে নিজের পরিবারের মধ্যে (৪৯.৭২ শতাংশ), গণপরিবহন/উন্মুক্ত স্থানে (৩৪.৮২ শতাংশ) এবং কর্মস্থলে (২৪.৮৫ শতাংশ)। মাত্র ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ ভুক্তভোগী এসব ঘটনার বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট করেছেন।