কোনো আলোচিত ঘটনা ঘটলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব নজর গিয়ে ঠেকে এসংক্রান্ত মামলায়। রহস্য উদ্ঘাটন ও আসামি গ্রেফতারে শুরু হয় সর্বাত্মক অভিযান। কিন্তু সেই একমুখী তৎপরতা অনেক সময় সফল তো হয়ই না, বরং এর আড়ালে নীরবে ফাঁকা হয়ে পড়ে রুটিন অপরাধ দমনের মাঠ। এই সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে দাগি অপরাধীরা-যারা খুন, ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজির মতো অপরাধ সংঘটিত করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়। আলোচিত মামলার আড়ালে বেড়ে ওঠা এই অপরাধপ্রবণতা এখন জননিরাপত্তার জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অভিযোগ উঠেছে, প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নানা ধরনের অপরাধের ঘটনা ঘটছে। আলোচিত মামলার বাইরে সংঘটিত এসব অপরাধ কার্যত বিচারের বাইরে থেকে যাচ্ছে। মামলা হলেও তদন্তের গতি শ্লথ, আসামি গ্রেফতারে বিলম্ব বা আদৌ গ্রেফতার হয় না। এতে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি আগে ঘটে যাওয়া স্পর্শকাতর মামলাগুলোয় প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করে কঠিন বিচারের আওতায় আনা যেত, তবে হয়তো পরবর্তী ঘটনাগুলো ঘটত না।
জানা গেছে, ১২ ডিসেম্বর জুমার নামাজের পর ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির মাথায় গুলি করা হয়। এই ঘটনায় পুলিশসহ প্রশাসনের বিভিন্ন ইউনিট সক্রিয় হয়ে উঠে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে। শনাক্ত করা হয় গুলির মিশনে থাকা দুই শুটার ফয়সাল ও আলমগীরকে। মূল আসামি ও তাদের হোতাকে শনাক্ত করতে একাধিক থানা, ডিবি ও বিশেষ ইউনিট একযোগে কাজ করছে। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, গোপন সোর্স সক্রিয়করণ-সব মিলিয়ে এই একটি মামলাতেই বিপুল জনবল ও সময় ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু ফয়সাল ও তার সহযোগী আলমগীরকে এখনো আইনের আওতায় আনা যায়নি। এমনকি তাদের অবস্থানও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে গত এক সপ্তাহে এই মামলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সফলতা হলো-তারা শুটার ফয়সালের বাবা-মা, স্ত্রী ও বান্ধবী এবং ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের দুই মালিকসহ ১০ জনকে গ্রেফতার। এ বিষয়টিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দায়সারা অভিযান।
এই একটি মামলাকেন্দ্রিক তৎপরতার কারণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার দাগি অপরাধী ও সন্ত্রাসীরা ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে-এমন অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী ও স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা বলছেন, হাদির মামলার মতো বিশেষ স্পর্শকাতর মামলায় বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যস্ত থাকার সুযোগে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠে। রাতে ছিনতাই, পথচারীকে ছুরিকাঘাত, বাসা ও দোকানে চুরি, এমনকি প্রকাশ্য চাঁদাবাজির ঘটনাও ঘটছে। এসব ঘটনায় তাৎক্ষণিক অভিযানের নজির তুলনামূলকভাবে কম।
দক্ষিণখান থানার আশকোনার বাসিন্দা ইন্টারনেট ও জমি ব্যবসায়ী মো. শাহজাহানকে ১৫ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ৯টার দিকে তালতলা নাদ্দা পোড়া রূপালী গার্ডেন এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহতের চাচাতো ভাই নাহিদ পারভেজ জানান, শাহজাহানের কাছে দফায় দফায় চাঁদা দাবি করেছিল সন্ত্রাসীরা। এ ব্যাপারে থানায় জিডি করেও কোনো প্রতিকার মেলেনি। এ ঘটনার ৩ দিন পেরিয়ে গেলেও ধরা পড়েনি ঘাতকরা। দক্ষিণখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ঘাতকদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কাজলায় কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় নিহত হয়েছেন ফারুক (১৮) নামে এক টাইলস মিস্ত্রি। এর আগে ১১ ডিসেম্বর শ্যামবাজারে মসলা ব্যবসায়ী আব্দুর রহমানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই দিন লালবাগ চৌরাস্তায় রিয়াদ নামে এক যুবক ছুরিকাঘাতে নিহত হন। এছাড়া ১৩ ডিসেম্বর সকালে ইডেন কলেজের ছাত্রী অর্পিতা রায় গ্রামের বাড়ি রংপুর যাওয়ার পথে মতিঝিলে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। তার ভ্যানিটি ব্যাগ টান দিলে তিনি রিকশা থেকে ছিটকে পড়ে আহত হন। এছাড়াও পল্টন, এয়ারপোর্ট, কুড়িল বিশ্বরোড, বাঁশতলা, রামপুরা, মোহাম্মদপুর, বছিলা, ঢাকা উদ্যান, নবোদয় হাউজিং, রায়ের বাজার, মোহাম্মদী হাউজিং, বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের আশপাশ, যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, আসাদগেট, মিরপুর-১০ ও ১১, বিহারি ক্যাম্প, কালসী ও পশ্চিম শেওড়াপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিনই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদুল হক মনে করেন, অপরাধ দমন কখনোই সিলেকটিভ হতে পারে না। একটি মামলার কারণে যদি রুটিন অপরাধ দমনে শৈথিল্য আসে, তবে অপরাধীরা সেটিকে রাষ্ট্রের দুর্বলতা হিসাবে নেয়। নির্বাচনের আগে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে রাজনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি সাধারণ অপরাধও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এতে ভোটারদের মধ্যে ভয়, আস্থাহীনতা ও বিশৃঙ্খলা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আলোচিত বা স্পর্শকাতর কোনো ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ মনোযোগের কারণে তাদের রুটিন অপরাধ দমন অবহেলিত হয়। ফলে সমাজে চুরি, ছিনতাই, খুনের মতো অপরাধের সংখ্যা বাড়ে। বড় অপরাধের তদন্তে মনোনিবেশ করতে গিয়ে ছোট অপরাধের দিকে নজর কমে গেলে অপরাধীরা সেই সুযোগ নেয়। তাই পুলিশের উচিত সব প্রকার অপরাধকে সমান গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা। পুলিশের নজরদারি ও বিশেষ ফোর্স রাখা জরুরি, যাতে স্পর্শকাতর মামলা মোকাবিলার পাশাপাশি সমাজে সংঘটিত অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রেও পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এএইচএম শাহাদত হোসেন বলেন, সব অপরাধ ও অপরাধীকে গুরুত্ব দিয়েই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালায়। ঢাকাসহ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিনই অপরাধীরা ধরা পড়ছে। তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।