Image description

‘যতক্ষণ পর্যন্ত বুকে বা মাথায় গুলি না লাগবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব না। তবে কেউ আমাদের গুলি করে মেরে ফেললে তাদের ধরে যেন বিচার করা হয়। সেটি করতে না পারলে নতুন কেউ জন্মাবে না।’ মৃত্যুর কয়েকদিন আগে এমন উক্তি করেছিলেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি। দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হওয়ার পর জনমনে তার এ উক্তি বেশ নাড়া দিয়েছে। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া তার আরও একটি উক্তি আছে। সেটি হলো, ‘আল্লাহ যদি আমাকে নিয়ে যায়, আমার বাচ্চাটার দিকে একটু খেয়াল রাখবেন।’

হাদির আলোচিত এসব বক্তব্য এখন নেট দুনিয়ায় ঘুরছে। নানাভাবে নাড়া দিচ্ছে সাধারণ মানুষকে। শরিফ ওসমান হাদি জুলাই অভ্যুত্থানের পর থেকে ভারতীয় আধিপত্যবাদ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং একটি ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র কায়েমের জন্য জীবনটা লড়াইয়ে নিয়োজিত রাখার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি ও দুর্নীতির ব্যাপক সমালোচনা করে আসছিলেন।

শরিফ ওসমান হাদি ছিলেন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী। গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে জুমার নামাজের পর নির্বাচনি গণসংযোগের জন্য অটোরিকশাযোগে রাজধানীর বিজয় নগর এলাকায় যাওয়ার পথে দুর্বৃত্ত ফয়সাল করিম মাসুদের গুলিতে গুরুতর আহত হন। এরপর টানা সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ৯টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

বেঁচে থাকাকালে নানা বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসেন হাদি। বলেছিলেন, ‘জীবন যাবে তবু দেশপ্রেমের প্রশ্নে আপস করব না। পুরো দুনিয়া লিখে দিলেও দেশের সঙ্গে জমিনের সঙ্গে গাদ্দারি করব না।’

রাজনীতিবিদদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘বরং আমরা আসলে প্রশ্ন করা শুরু করি রাজনীতিবিদদের। যে আসবে তাকে জিজ্ঞেস করি আপনি কী করেন, যদি বলেন রাজনীতি করি। রাজনীতি তো বেতন দেয় না, তবে চলেন কীভাবে? এ প্রশ্ন সবাই শুরু করলে বাধ্য হয়ে এমপি ও মন্ত্রীদের ছোট একটি দোকান হলেও দিতে হবে।’ রাজনীতিবিদদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি এও বলেন, ‘পাঁচ বছরের ক্ষমতার মোহে বিএনপি, জামায়াত বা যে কোনো দল বাংলাদেশকে বেচে দেওয়ার চিন্তা করে- আপনারা কোন দেশে যাবেন? ভারতে যেতে পারবেন না, পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত নেই। বঙ্গোপসাগর ছাড়া কিন্তু আর কোনো গতি থাকবে না।’ সাধারণ মানুষকে সতর্ক করে হাদি বলেছিলেন, ‘আপনারা প্রতীক দেখে নয়, প্রার্থী দেখে ভোট দেবেন। একজন ভালো মানুষকে একবার ভোট দেবেন, আপনি ও আপনার পরিবার ৫ বছর ভাল থাকবে।’ রাজনীতিবিদদের নানা সমালোচনা করলেও নিজের নির্বাচনে জয় প্রত্যাশায় মরিয়া ছিলেন না ওসমান হাদি। সেটিও উঠে আসে তার দেওয়া একটি বক্তব্যে। তিনি বলেছিলেন, ‘নির্বাচন করলে জিতব এটিই প্রথম কথা নয়। তবে রাজনীতিতে তরুণদের সামনে নিতে চাই। এই রাজনীতিতে আগামী ৫০ বছরে জিততে বা নাও জিততে পারি। তবে আমরা নতুন একটি ধারা তৈরি করতে চাই। লম্বা সময় রাজনীতি করতে আসিনি, রাজনীতির গতিপথ পরিবর্তনের জন্য আসছি। আমাদের হায়াত ও জীবনে পারব কিনা জানি না। তবে নিশ্চিত এটি জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে।’

জুলাই আন্দোলনের উদ্দেশ্য হারিয়ে যাওয়া নিয়ে হাদির মনে কষ্ট ও ক্ষোভ ছিল। সেটিও প্রকাশ্যে বলতে দ্বিধা করেননি তিনি। হাদি বলেন, ‘এনসিপি তিনটি অপরাধ করেছে। প্রথমটি হচ্ছে- তারা জুলাই আন্দোলনকে কুক্ষিগত করেছে। দ্বিতীটি হচ্ছে- তারা অনেকে দুর্নীতি করেছে। আজ থেকে দশ মাস আগে সারা গায়ে যে ছেলেটির আঘাতের চিহ্ন ছিল, জুলাই আন্দোলন করতে গিয়ে সেসব ছেলে-মেয়েরা কীভাবে এ সময়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হতে পারে। রাজনীতি তো ৫ বছরের নয়, ৫০ বছরের। কষ্ট করে বসে থাকলে আগামী বাংলাদেশ হতো জুলাই যোদ্ধাদের। এনসিপির যারা দুর্নীতি করেছে, এই সরকার চলে যাওয়ার পর কেউ যাবে দুবাই; যারা ফ্ল্যাট কিনেছে। যারা মাস্টারমাইন্ড, তারা পাড়ি জমাবে বিদেশে। কিন্তু জুলাই যোদ্ধারা কোথায় যাবে। আমাদের তোমরা এই জাহান্নামে ফেলে যাবা-এর দায় ইতিহাস ও আল্লাহর কাছে দিতে হবে।’

বেঁচে থাকাকালে কথাবার্তায় একাধিকবার নিজের মৃত্যুর কথা স্মরণ করেন হাদি। তিনি বলেন, ‘রাজনীতিবিদের মৃত্যু বাসায় হতে পারে না। এটা কোনো ভালো মৃত্যু না। যিনি রাজনীতি করেন, যিনি লড়াই করেন, যিনি সংগ্রামী-তার মৃত্যুটা হবে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, রাজপথে। আমি ভিষণভাবে প্রত্যাশা করি ও ছোটবেলা থেকে স্বপ্নও দেখি এবং অনেক জায়গায় বলেছি। সেটি হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি তুমুল মিছিল হচ্ছে, সে মিছিলের সামনে আমি আছি, কোনো একটা বুলেট এসে হয়তো আমরা বুকটা বিদ্ধ করে দিয়েছে। এই মিছিলে হাসতে হাসতে শহীদ হয়ে গেছি। আমি একটি ইনসাফের হাসি নিয়ে আল্লাহর কাছে পৌঁছতে চাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘আপনাকে যদি হত্যা করা হয়, সেই শহীদের রক্তের বিনিময় যদি বাংলাদেশ গড়ে যেতে পারেন। আগামী এক হাজার বছর বাংলাদেশের মানুষ নামাজে প্রার্থনায় আপনার জন্য শুধু দোয়া করবে।’

দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে হাদি বলেছিলেন , ‘আমরা হয়তো মরে যাব। শহীদ হয়ে আল্লাহর কাছে পৌঁছে যাব। আর যতক্ষণ বেঁচে থাকি ততক্ষণ তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব। নতুন ও ইনসাফের বাংলাদেশের জন্য নিজের জীবনকে জাহান্নাম বানাইয়া বাংলাদেশে নতুন একটি জান্নাত আনবোই আনবো’।

শরিফ ওসমান হাদি ভালো রাজনীতিবিদদের প্রতি ইনসাফের কথাও বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি হাসনাতের রাজনীতি করি না। কিন্তু হাসনাত বিএনপি-জামায়াত যারাই জুলাইয়ের যোদ্ধা-তারা সবাই আমার ভাই। এছাড়া আওয়ামী লীগের যারা গণহত্যা, গুম, খুন করেনি সে দার্শনিকভাবে আওয়ামী লীগ। আমি সেটিও বলি, তার সঙ্গে কোনো অন্যায় করা যাবে না, ইনসাফ আচরণ করতে হবে।’

বেঁচে থাকার সময় তার আলোচিত ও মর্মস্পর্শী অনেক বক্তব্য রয়েছে। নিজের শিশু সন্তানকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে হাদি বলেছিলেন, ‘মাঝেমধ্যে মন খারাপ হয়। আমার তিন মাসের একটি বাচ্চা আছে। তাকে ৩০ মিনিট কোলে নিতে পারি নাই। সম্প্রতি আমার এক বড় ভাই জোর করে বাচ্চাকে কিছু উপহার দিয়েছে। আমার খুব বলতে ইচ্ছে করেছিল আল্লাহ যদি আমাকে নিয়ে যায় বাচ্চাটার দিকে খেয়াল রাখবেন। তবে কথাটা বলতে পারি নাই।’