বৈষয়িক সুবিধা বা অর্থনৈতিক লাভের ওপর ভিত্তিতে চলা এখনকার বিশ্বব্যবস্থায় বিপ্লব যেখানে আলোচনায়ই নেই, সেখানে একজন বিপ্লবীকে নিয়ে আলোচনা অবান্তর। কিন্তু ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর মাত্র কিছুদিনের জন্য বিপ্লবের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি। যিনি মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে লাশ হয়ে দেশে ফিরলেন। এ যেন দেশের কাঁধে একজন বিপ্লবীর লাশ। লাল-সবুজের পতাকা মোড়ানো কফিনে হাদির লাশ শুক্রবার সন্ধ্যা ৫টা ৪৯ মিনিটে ঢাকায় এসে পৌঁছায়। বিমানবন্দরের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে ফ্রিজার গাড়িতে করে তাকে নেওয়া হয় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালের হিমঘরে। রাতে সেখানেই রাখা হয়। আজ (শনিবার) দুপুর ২টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার এই তরুণ নেতার জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হবে।
এদিকে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সম্মুখসারির যোদ্ধা শহীদ ওসমান হাদির মৃত্যুতে কাঁদছে পুরো দেশ। বৃহস্পতিবার রাতে মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই রাস্তায় নেমে আসেন তার সহযোদ্ধাসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। বিভিন্ন স্থানে উত্তেজনাও ছড়িয়ে পড়ে। ঘটে ভাঙচুরের ঘটনাও। হাদির খুনিদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে শুক্রবার সারা দিনও চলে নানা কর্মসূচি। এছাড়া এদিন বাদ জুমা হাদির জন্য ঢাকাসহ সারা দেশের মসজিদে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত করা হয়। অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়েও অনুষ্ঠিত হয় প্রার্থনা। শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ পুরো দেশ। আজ (শনিবার) একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে।
সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর পর শহীদ ওসমান হাদির মরদেহ বহনকারী ফ্লাইট (ইএ-৫৮৫) বাংলাদেশ সময় শুক্রবার দুপুর ২টা ৩ মিনিটে চাঙ্গি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হয়। মরদেহের সঙ্গে দেশে ফেরেন হাদির বড় ভাই আবু বকর। সন্ধ্যা ৫টা ৪৯ মিনিটে তার মরদেহ বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটি হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোবারক হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
শুক্রবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে বিমানবন্দরের ৮ নম্বর হ্যাঙ্গার গেট দিয়ে জাতীয় পতাকায় মোড়ানো কফিনটি লাশবাহী গাড়িতে তোলা হয়। কফিন গ্রহণ করতে উপস্থিত ছিলেন হাদির বোনজামাই আমিরুল ইসলাম, ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আবদুল্লাহ আল জাবেরসহ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এ সময় শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান, দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, দক্ষিণাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েমসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে হাদির মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার প্রেক্ষিতে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ, বিজিবি, এপিবিএন ও আনসার সদস্য। বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেট দিয়ে কফিনবাহী গাড়ি বের হওয়ার সময় সেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষ জড়ো হন। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ফ্রিজার গাড়িতে মরদেহ নেওয়া হয় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের হিমঘরে। রাত পৌনে ৭টার দিকে সেখানে পৌঁছায় গাড়িবহর। তার সহযোদ্ধারা সেখানে জড়ো হয়েছিলেন আগেই।
হাদির মরদেহ পৌঁছানের আগেই জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এজন্য মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, হাদির মরদেহ এখানে রাখার কথা জানানোর পর আমরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করেছি।
কোনো গোষ্ঠী অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে যেন সহিংসতা সৃষ্টি করতে না পারে : ইনকিলাব মঞ্চ জানায়, হাদির মরদেহ জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের হিমাগারে সংরক্ষণ করা হবে। সেখানে মরদেহ রেখে সংগঠনের নেতাকর্মীরা শাহবাগে অবস্থান নেবেন। সংগঠনটি আরও জানায়, পরিবারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শহীদ ওসমান হাদিকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে দাফন করা হবে এবং মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে বাদ জোহর জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এ কারণে শুক্রবারের পরিবর্তে শনিবার মিছিলসহ হাদির মরদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে নেওয়া হবে।
ইনকিলাব মঞ্চের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মরদেহ দেখার কোনো সুযোগ থাকবে না। একই সঙ্গে ছাত্র-জনতাকে শৃঙ্খলার সঙ্গে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, যেন কোনো গোষ্ঠী অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত বা সহিংসতা সৃষ্টি করতে না পারে।
সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জানাজা : এদিকে আজ (শনিবার) দুপুর ২টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় শহীদ ওসমান হাদির জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, জানাজায় অংশগ্রহণে আগ্রহীদের কোনো প্রকার ব্যাগ বা ভারী বস্তু বহন না করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। একই সঙ্গে এ সময় সংসদ ভবন ও এর আশপাশের এলাকায় ড্রোন ওড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এদিকে জানাজায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অংশ নেবেন বলে প্রেস উইং সূত্রে জানা গেছে।
হাদিকে হত্যায় জাতিসংঘের উদ্বেগ : ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক। পাশাপাশি হাদির হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত ও স্বচ্ছ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, গত সপ্তাহে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাদির মৃত্যু তাকে গভীরভাবে বিচলিত করেছে। দেশবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে তুর্ক বলেন, সবাইকে সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা শুধু বিভাজনকে আরও গভীর করবে এবং সবার অধিকারকে ক্ষুণ্ন করবে।
মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, হাদির মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত, নিরপেক্ষ, পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্ত পরিচালনা করতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ভলকার তুর্ক বলেন, এমন একটি পরিবেশ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি, যেখানে সব নাগরিক নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণভাবে জনজীবনে অংশ নিতে পারবেন এবং ভিন্নমত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, এই সংকটময় সময়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। একই সঙ্গে আরও অস্থিরতা যেন না ছড়ায়, তা প্রতিরোধ করতে হবে। জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান জানান, মানবাধিকার সুরক্ষা ও সহিংসতা প্রতিরোধে অন্তর্বর্তী সরকার ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করতে তার দপ্তর প্রস্তুত রয়েছে।
ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের শোক : ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদি নিহতের ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছে ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন দূতাবাস। শুক্রবার নিজেদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা আলাদা শোকবার্তা প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের শোকবার্তায় বলা হয়, ‘যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তরুণ নেতা শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছে এবং তার পরিবার, বন্ধু ও সমর্থকদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছে।’
যুক্তরাজ্য হাইকমিশনের বার্তায় বলা হয়, ‘তরুণ নেতা শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। কঠিন এই সময়ে তার পরিবার, বন্ধু আর সমর্থকদের প্রতি আমরা আন্তরিক সমবেদনা জানাই।’
ইইউ দূতাবাস তাদের শোকবার্তায় বলেছে, ‘শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে মর্মাহত এবং আমরা তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও শোকাহত সবার প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।’
ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার হাড়ড়িখালী গ্রামের মুন্সি বাড়ির মরহুম মাওলানা আব্দুল হাদির ছোট ছেলে শরিফ ওসমান হাদি। নলছিটি ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় কিছুদিন পড়াশোনার পর ঝালকাঠির ঐতিহ্যবাহী নেছারাবাদ কামিল মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। শিক্ষক বাবার সন্তান হাদি নেছারাবাদ কামিল মাদ্রাসায় পড়াশোনা শেষ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে তিনি বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন।
২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতনের আন্দোলন এবং ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদির কর্মকাণ্ড দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। তার প্রতিষ্ঠিত ইনকিলাব মঞ্চের বিভিন্ন কর্মসূচি তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। পাশাপাশি মাঠে, ময়দানে ও টিভি টকশোতে আগুনঝরা বক্তব্য দিয়ে জনতার কাছে তিনি বড় মাপের একজন তরুণ বিপ্লবী হয়ে ওঠেন। হাদির বক্তব্য শুনে তরুণদের মধ্যে অনেকে তার অনুসারীতে পরিণত হন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ওসমান হাদি জাতীয় নাগরিক কমিটিতে যোগ দিলেও নতুন দল এনসিপিতে যোগ দেননি। নিজেকে ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে নতুন করে আলোচনায় আসেন হাদি। ভিন্ন আঙ্গিকে তার নির্বাচনি প্রচারণা জনগণের নজর কাড়ে।
১২ ডিসেম্বর দুপুরে জুমার নামাজের পর নির্বাচনি গণসংযোগের জন্য অটোরিকশায় রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় যাওয়ার সময় ওসমান হাদি দুর্বৃত্তদের গুলিতে গুরুতর আহত হন। তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে অস্ত্রোপচার করার পর রাতেই তাকে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সোমবার দুপুরে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে হাদিকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাতে সেখান থেকে তার মৃত্যুর খবর আসে। তার মতো একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার জুলাই যোদ্ধার মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে পুরো জাতি।