অন্তর্বর্তী সরকারের দেড় বছরেও দেশের সার্বিক অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। তবে অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে। লুটপাটে লাগাম পড়েছে, রোধ হয়েছে অর্থনীতির নিম্নমুখী যাত্রা। ঘুচে গেছে ডলার সংকট, টাকার মানে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করেছে, তবে তা এখনো ঝুঁকির পর্যায়েই রয়েছে। কিন্তু অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রধান উপকরণ আস্থার সংকট কাটেনি। কমেনি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা। কমছে না ঋণের সুদহার।
বেসরকারি খাতে মন্দা কোনোভাবেই কাটছে না। ফলে বাড়ছে না বিনিয়োগ। কর্মসংস্থানের গতিও একেবারেই মন্থর। করোনার সংক্রমণের সময় ২০২০ সাল থেকেই অর্থনীতিতে বড় ধরনের মন্দা শুরু হয়। গত ৫ বছর ধরেই কম-বেশি আকারে চলছে ওই মন্দা। টানা মন্দার কারণে দেশের সার্বিক অর্থনীতি দুষ্টচক্রের কবলে পড়ে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের দেড় বছরে বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে অর্থনীতির বৈদেশিক খাতে স্বস্তি ফিরে এসেছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ খাতে অস্বস্তি রয়েই গেছে। এ অস্বস্তি ক্রমেই প্রকট আকার ধারণ করছে। সরকারের নেওয়া বহুমুখী পদক্ষেপে দেশ থেকে টাকা পাচার অনেক কমেছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বেড়েছে। এতে বাজারে ডলারের প্রবাহ কমেছে। অন্যদিকে আমদানি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বকেয়া বৈদেশিক ঋণের বড় অংশই ইতোমধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে। ফলে বাজারে ডলারের চাপ কমে গেছে। এতে ডলারের প্রবাহ বাড়ায় টাকার মানে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার মান শক্তিশালী হওয়ার পর্যায়ে চলে এসেছে। কিন্তু রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য ডলারের দাম কমানো হচ্ছে না। ডলারের প্রবাহ বাড়ার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে চড়া সুদে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের প্রবণতাও কমেছে। তবে এখন পর্যন্ত সরকার যেসব ঋণ গ্রহণ করেছে সেগুলোর সবই স্বল্প সুদের ঋণ।
ডলারের দাম বিগত সরকারের সময়ে সর্বোচ্চ ১৩২ টাকায় উঠেছিল। এখন প্রতি ডলারের দাম ১২২ টাকার মধ্যে নেমে এসেছে। গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ, চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত বেড়েছে ১৭ শতাংশের বেশি। রপ্তানি আয় গত অর্থবছরে বেড়েছে পৌনে ৮ শতাংশ, চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত রপ্তানি আয় বেড়েছে দশমিক ৬২ শতাংশ। বিগত সরকারের সময় দুই খাতেই প্রবৃদ্ধি ছিল নেতিবাচক ধারায়। হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্সের অর্থ আসায় বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছিল। রপ্তানি আয়ের অর্থও দেশে আসছিল না, পাচার হয়ে যাচ্ছিল।
আওয়ামী লীগের সময়ে আমদানির নামে ব্যাপকভাবে টাকা পাচার হচ্ছিল। বর্তমানে সেটি বহুলাংশে কমেছে। ওই সময়ে ডলার সংকটের কারণে আমদানি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। জানুয়ারি থেকে আমদানি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। তারপরও আমদানি বাড়ছে বটে, কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। গত অর্থবছরে আমদানি বেড়েছিল পৌনে ২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেড়েছে সাড়ে ১০ শতাংশের বেশি। ডলার সংকটের কারণে ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আমদানি কমেছে। বিগত সরকারের সময়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ১৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। এখন তা বেড়ে ২৮ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি অবস্থান করেছে।
বিগত সরকার ডলার সংকটের কারণে ব্যাপক হারে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ স্থগিত করেছিল। সেইসব ঋণসহ চলতি ঋণ শোধ করা হচ্ছে নিয়মিত। ফলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপও কমে গেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রপ্তানি খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বৈশ্বিক ও দেশীয় পরিস্থিতিতে এ খাতে নানামুখী সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে টানা ৪ মাস রপ্তানি আয় কমছে। তবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে ৫ মাসে গড়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ শতাংশের কম। রপ্তানি খাতের কাঁচামাল আমদানি কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। এতে আগামীতে রপ্তানি আয় আরও কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে আশার কথা শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে। এর প্রভাবে আগামীতে সার্বিকভাবে শিল্প খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
তবে অভ্যন্তরীণ খাতে অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা এখনো মন্থর। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে করোনার আগে থেকে অর্থনীতিতে মন্দা চলছিল। ২০২০ সালে করোনার সময়ে সেটি আরও প্রকট হয়। ২০২০ সালে বৈশ্বিক মন্দার ঢেউ বাংলাদেশে লাগলে অর্থনীতিতে সংকট আরও ঘনীভূত হয়। ২০২৪ সালের আগস্টে সরকার পতনের আগ পর্যন্ত ওই সংকটের থাবা অব্যাহত ছিল। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ব্যাপক পদক্ষেপ নেয়। এর প্রভাবে অর্থনীতিতে নতুন করে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে। টাকার পাচার বহুলাংশে কমেছে। লুটপাট বন্ধ হয়েছে। ব্যাংকে আমানতের প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। তারল্য সংকট কমছে। কিন্তু পতিত সরকারের লুটপাটের তথ্য যত বেরুচ্ছে, খেলাপি ঋণ তত বাড়ছে। খেলাপির কারণে ব্যাংক খাতের সব সূচকে ধস নেমেছে। তারল্য ব্যবস্থায় চাপ বেড়েছে। এর মধ্যেও ব্যাংকগুলোকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য নীতি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। তারল্য সংকট ও নীতিমালার কড়াকড়ির কারণে এবং উদ্যোক্তাদের চাহিদা না থাকায় ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ বাড়াতে পারছে না।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলেও ছিল অনিশ্চয়তা। এ কারণে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দেড় বছরেও রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটেনি, উলটো আরও বেড়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও বিদ্যমান। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেও এখনো যথেষ্ট অনিশ্চয়তা রয়েছে। এসব কারণে উদ্যোক্তারা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। তারা শুধু চলমান ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখার চেষ্টা করছেন, এতেও অনেকে সফল হতে পারছেন না। নতুন কোনো ব্যবসায় হাত দিচ্ছেন না। ফলে বিনিয়োগ যেমন হচ্ছে না, তেমনি কর্মসংস্থানের গতিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গত অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ সর্বনিম্নে নেমেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে ঋণ প্রবাহ কমেছে। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে এসে কিছুটা বেড়েছে। জুলাই-অক্টোবরে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে মাত্র দশমিক ৬৭ শতাংশ। যা সাম্প্রতিক সময়ে সর্বনিম্ন। গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯১ শতাংশ।
এদিকে বিদেশি বিনিয়োগও থমকে আছে। পুঁজি হিসাবে বিনিয়োগ আসার গতি খুবই কম। এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ ও অর্জিত মুনাফা পুনরায় বিনিয়োগ করে সার্বিক বিনিয়োগের তথ্য বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরের চিত্র একই। বেসরকারি খাতে দেশীয় উদ্যোক্তাদের নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। তারা এখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত টানা ৪ বছর ধরে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এতে বাজারে টাকার প্রবাহ কমেছে, বেড়েছে সুদের হার। তারপরও মূল্যস্ফীতির হার প্রত্যাশিত মাত্রায় কমেনি। সাম্প্রতিক সময়ে এ হার উঠানামার মধ্যে আছে। তবে এখনো তা ৮ শতাংশের উপরে রয়েছে। এতে দীর্ঘ সময় ধরে ভোক্তার ভোগান্তিও বেড়েছে। আলোচ্য ৪ বছরে যেমন কর্মসংস্থান বাড়েনি, তেমনি কর্মরত কর্মীদের বেতন-ভাতাও তেমন বাড়েনি। উলটো অনেক কর্মী বেকার হয়েছে। ফলে মানুষের আয় কমেছে। বিপরীতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। বাধ্য হয়ে সঞ্চয় ভেঙেছে। এখন সঞ্চয় ভাঙর মতো অবস্থায়ও নেই স্বল্প আয়ের মানুষ। তারা এখন ঋণগ্রস্ত।
গত বছরের জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছিল। গত নভেম্বরে তা ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে সামান্য বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এ হার আরও বাড়তে পারে।
এদিকে ঋণের সুদের হার আলোচ্য সময়ে ৮-৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১২-১৮ শতাংশে উঠেছে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি যেমন কমেছে, তেমনি কর্মসংস্থানের গতিও কমেছে। কৃষি ও শিল্প উৎপাদনও নিম্নমুখী।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নজিরবিহীন লুটপাটের কারণে ব্যাংক খাত ‘রক্তশূন্য’ হয়ে পড়েছিল। বর্তমানে লুটপাট বন্ধ হয়েছে। তবে আগের লুটপাটের ক্ষত এখন যতই দৃশ্যমান হচ্ছে, ব্যাংক খাত ততই দুর্বল হয়ে পড়ছে। লুটপাটের সব ঋণ খেলাপি হচ্ছে। আওয়ামী লীগের শেষ সময়ে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। তা এখন বেড়ে ৬ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। সোয়া এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা।
আইএমএফের নীতি হচ্ছে-সরকারকে স্থিতিশীল রাখা। এজন্য ভোক্তার ওপরে করের বোঝা চাপানোর সুপারিশ করতে তারা পিছ-পা হয় না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বরাবরই তারা তাই করে আসছে। সংস্থাটি মনে করে, সরকার স্থিতিশীল থাকলে অর্থনীতিকেও স্থিতিশীল রাখা যাবে। এ সরকার আইএমএফের সুপারিশ মেনে বেশকিছু খাতে করের বোঝা চাপিয়েছে। তারপরও রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাড়ানো সম্ভব হয়নি। রাজস্ব আয় না বাড়লে সরকারের ব্যয় কমেনি; বরং আরও বেড়েছে। ফলে সরকারকে উন্নয়ন না করেও আর্থিক সংকট মেটাতে ঋণ দিতে হচ্ছে বেশি করে।
ব্যাংক খাতসহ সার্বিক অর্থনীতিতে ব্যাপক সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে। এসব পদক্ষেপের কিছুটা সুফল ইতোমধ্যে আসতে শুরু করেছে। সংস্কার আরও এগিয়ে গেলে সুফল আরও দৃশ্যমান হবে বলে আশাবাদী কেন্দ্রীয় ব্যাংক।