নির্বাচন কমিশন আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে। যদিও আগে থেকেই সম্ভাব্য প্রার্থীরা গণসংযোগ করছেন। সম্প্রতি বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এরশাদউল্লাহ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় বেশির ভাগ প্রার্থীর মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। নিরাপত্তা ইস্যুতে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন থেকে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মাসুদুজ্জামান মাসুদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
তবে প্রার্থীদের নিরাপত্তা শঙ্কা কাটাতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে যেসব প্রার্থী নিরাপত্তা শঙ্কায় আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেতে চান, তাঁদের জন্য দ্রুত লাইসেন্সের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। এ জন্য গত সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নীতিমালাও জারি করা হয়েছে। নীতিমালা জারির পর গতকাল পর্যন্ত প্রায় ২০ প্রার্থী আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদন করেছেন।
অন্যদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে প্রার্থীদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সভা-সমাবেশে যাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে জানিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর প্রার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী এরই মধ্যে নির্দেশ দিয়েছেন।
চাঁদপুর-১ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ও সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিরাপত্তা নিয়ে আমি শুধু একা নই, প্রত্যেক প্রার্থীই শঙ্কিত। আসন্ন নির্বাচন বানচালে দুই ধরনের ষড়যন্ত্র আছে। সেটা হচ্ছে ডিপস্টেট ষড়যন্ত্র ও এক্সটারনাল ষড়যন্ত্র।
ময়মনসিংহ-১ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিরাপত্তার শঙ্কা তো আছেই, এর পরও আমাদের কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। এর পরও আমাদের বলা হয়েছে, যখন সভা-সমাবেশ হয়, তখন যেন আগে থেকেই তাদের জানাই। তবে আমাদের ভয় পেয়ে বসে থাকলে হবে না। ভয় পেলে তো মুক্তিযুদ্ধ হতো না, এরশাদের পতন হতো না, হাসিনার পতন হতো না।’
চট্টগ্রাম-২ আসনের জামায়াতের প্রার্থী অধ্যক্ষ মুহাম্মদ নুরুল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নির্বাচনী বিধিমালা অনুযায়ী মানুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করছি। তবে একটা উদ্বেগ কাজ করছে। জনসংযোগের কাজের ফাঁকে যারা দুষ্কৃতকারী আছে, তারা সুযোগ নিতেও পারে। তবে প্রশাসন আমাদের খোঁজ-খবর রাখছে।’
গত ১১ ডিসেম্বর ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদিকে পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। মাথায় গুলিবিদ্ধ হাদি বর্তমানে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন। তাঁর ওপর প্রকাশ্যে হামলার ওই ঘটনায় সম্ভাব্য প্রার্থীদের পাশাপাশি জুলাই যোদ্ধা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা দেশের বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানান। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে নির্বাচনে ভোটার অংশগ্রহণ কম হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
চট্টগ্রাম-৮ আসন থেকে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এরশাদউল্লাহর গণসংযোগের সময় গত ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের চালিতাতলীতে গুলির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এরশাদউল্লাহসহ মোট তিনজন গুলিবিদ্ধ হন। এতে চট্টগ্রামসহ সারা দেশের প্রার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর-বন্দর) আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী মাসুদুজ্জামান মাসুদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘পারিবারিক ও নিরাপত্তাসহ একাধিক কারণে আমি এই নির্বাচন থেকে সরে যাচ্ছি। আমার সিকিউরিটি কনসার্ন হচ্ছে আমার পরিবার। আমার পরিবারের সঙ্গে এই জায়গায় নেগোসিয়েশন করতে পারছি না। তবে বিষয়টি এমন না যে সরকার নিরাপত্তা দিতে পারছে না, সেই কারণে সরে যাচ্ছি।’
অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বিএনপির মনোনীত প্রার্থী মাসুদুজ্জামান মাসুদের নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার বিষয়ে গতকাল নারায়ণগঞ্জে বলেছেন, ‘কে নির্বাচন করবে আর কে করবে না, সে কী জন্য করবে না, কেন করবে না, এটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটা নিয়ে আমাদের বলার কিছু নেই।’
তিনি আরো বলেন, ‘নিরাপত্তা একটা বড় বিষয়। এখানে যারা আসছে তারা বলতে পারত নিরাপত্তা সংকট আছে, আমরা কেউ আসব না। এটার ক্ষেত্রে বলা যায়, এটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। সে নির্বাচন কেন করবে না, এটা সাংবাদিকরা অনুসন্ধান করলে বেরিয়ে আসবে।’
গতকাল এক অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম বলেন, ‘নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরও জনগণের মধ্যে সংশয় রয়ে গেছে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আদৌ হবে কি না। আগে থেকেই নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট বার্তা না দেওয়া এবং উপদেষ্টা পরিষদের বিভ্রান্তিকর বক্তব্য জনগণের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। ফ্যাসিবাদের দোসরদের তোষণ করে কখনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তারা নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে।’
কিশোরগঞ্জের ডিসি মোহাম্মদ আসলাম মোল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের এখানে এখনো কোনো সমস্যার মুখোমুখি হইনি। আমাদের নিরাপত্তা কমিটি রয়েছে। কিন্তু কমিটির কাছে এখন পর্যন্ত কেউ নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেনি।’
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) এস এন মো. নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, যেসব প্রার্থীর নিরাপত্তাঝুঁকি বেশি, তাঁরা সার্বক্ষণিক গানম্যান পাবেন। এ ক্ষেত্রে জুলাই যোদ্ধা ও অতিঝুঁকিতে থাকা প্রার্থীরা অগ্রাধিকার পাবেন। গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর মূল্যায়নে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচিত হলে প্রার্থীরা নিজেরা সশস্ত্র দেহরক্ষী রাখতে পারবেন, না পারলে পুলিশের পক্ষ থেকে দেহরক্ষী দেওয়া হবে।
পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, প্রার্থীদের ঝুঁকি বিবেচনায় প্রার্থী ও জুলাই যোদ্ধাদের নিরাপত্তা তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে নিশ্চিত করা হবে। এগুলো হলো অতিঝুঁকিতে, মাঝারি ঝুঁকিতে ও কম ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তি। ঝুঁকিতে থাকা প্রত্যেক প্রার্থী ও জুলাই যোদ্ধার সঙ্গে আলোচনা করে, যেভাবে তাঁরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন, সেই অনুযায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, ‘নির্বাচন সামনে রেখে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো উন্নতি না হলে ভোটারদের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। প্রার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা সরকারের দায়িত্ব।’
নিরাপত্তা নিয়ে চট্টগ্রামে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। প্রার্থীদের কেউ কেউ বলছেন, নিরাপত্তা নিয়ে কোনো ধরনের শঙ্কা নেই, আবার কেউ কেউ নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
চট্টগ্রাম-১০ আসনে এনসিপির প্রার্থী সাগুফতা বুশরা মিশমা বলেন, ‘যারা বাংলাদেশপন্থী তাদের একটা শঙ্কা থাকতে পারে। যারা বাংলাদেশপন্থী না বা যারা সুস্থ ধারার রাজনীতি চায় না, তারা নানাভাবে হামলা করতেই পারে। সেটা মেনে নিয়েই নির্বাচনী এলাকায় কাজ করছি। যেখানে নির্বাচনী কাজে যাচ্ছি, পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে।’
চট্টগ্রাম-১৫ আসনে গণ অধিকার পরিষদের প্রার্থী মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, ‘হাদির ঘটনার পর মানুষের মধ্যে একটা আতঙ্ক আছেই। নিরাপত্তার বিষয়ে একটা শঙ্কা তো তৈরি হচ্ছেই। তবে আমার ব্যক্তিগতভাবে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সমস্যা হয়নি।’
চট্টগ্রাম-১৫ আসনে বিএনপির প্রার্থী নাজমুল মোস্তফা আমিন বলেন, ‘আমরা আমাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। হাদিকে গুলি করা একটা ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে, নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়া বা নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য। তবে আমরা আমাদের প্রচারণা ভালোভাবেই চালিয়ে যাচ্ছি।’
রংপুরে ছয়টি আসনের প্রার্থীরা নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত গ্রাম থেকে মহল্লায় নিজস্ব নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে ছুটছেন তাঁরা। প্রার্থীরা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি তুললেও বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেননি কেউ।
রংপুর-১ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মোকাররম হোসেন সুজন বলেন, ‘শুনছি প্রার্থী নিধন চলবে। সেই হিসেবে তো আতঙ্কে আছি। এর পরও আল্লাহ ভরসা। আমি মাঠে আছি, লোকজন নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছি।’
রংপুর-৪ আসনের বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এমদাদুল হক ভরসা বলেন, ‘শঙ্কা তো আছেই। এর পরও ভোটারদের কাছে যাওয়াটা আমাদের দায়িত্ব। নিরাপত্তা জোরদার করা হলে সবাই স্বস্তি পেত।’
খুলনায় নির্বাচনী কাজে ঘরে-বাইরে ব্যস্ত সময় পার করছেন আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীরা। নির্বাচনী বিধি-নিষেধের কারণে তফসিল ঘোষণার পর দলীয় কর্মসূচির মাধ্যমে কৌশলী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন প্রার্থীরা।
খুলনা-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী রকিবুল ইসলাম বকুল বলেন, ‘একটি অশুভ চক্র এখনো নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। আমরা আশঙ্কামুক্ত হতে চাই। সরকারের কাছে দাবি, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করুন, যাতে মানুষ নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে।’
খুলনা-২ আসনে জামায়াতের প্রার্থী অ্যাডভোকেট মো. জাহাঙ্গীর হোসাইন হেলাল বলেন, ‘খুলনাবাসী আতঙ্কিত। সেখানে আমাদের ভালো বলার সুযোগ নেই। কোথায় কখন কী ঘটছে, বলা যাচ্ছে না। আমরা এ অবস্থা দেখতে চাই না। পরিস্থিতির উন্নতিতে সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।’
খুলনা-২ আসনের গণসংহতি আন্দোলনের প্রার্থী মনির চৌধুরী সোহেল বলেন, ‘খুলনার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। আমরা আর এটিকে খুনের নগরী হিসেবে দেখতে চাই না। এ নিয়ে সব সময়ই দাবি জানিয়ে আসছি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মানুষ আবার বিক্ষুব্ধ হবে।’
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক চট্টগ্রাম, রংপুর ও খুলনা)