Image description
দুই ইস্যুতে বাড়ছে টানাপোড়েন

সাম্প্রতিক সময়ের দুটি ইস্যুতে টানাপোড়েনের মুখে পড়েছে ঢাকা-দিল্লির কূটনৈতিক সম্পর্ক। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ভারতের সম্ভাব্য সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি সামনে আসার পর থেকেই ফুঁসে উঠে দেশের মানুষ। এর রেশ না কাটতেই গত শুক্রবার ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করার ঘটনায় জড়িত অন্যতম আসামি ফয়সাল ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এ খবর নিশ্চিত হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও বেসামাল হয়ে উঠেছে। এখন অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে হাদির ওপর হামলার নেপথ্যেও আওয়ামী ফ্যাসিস্ট-চক্র ছাড়াও পরোক্ষভাবে ভারতের ইন্ধন থাকতে পারে। কারণ, হাদি প্রকাশ্যে দেশটির নানা আগ্রাসন নীতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সোচ্চার ছিলেন।

এদিকে এ ঘটনায় ইনকিলাব মঞ্চ ছাড়াও জুলাই যোদ্ধাদের বিভিন্ন সভা-সমাবেশ থেকে ভারতকে উদ্দেশ করে নানারকম তির্যক বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। ভারতও বিষয়টিকে ভালোভাবে নিচ্ছে না। এর মধ্যে বুধবার বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে ‘জুলাই ঐক্য’ মোর্চা মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন কর্মসূচি পালন করে। এমন পরিস্থিতিতে সংগত কারণে ঢাকা-দিল্লির কূনৈতিক সম্পর্ক বেশ খানিকটা উত্তাপের মধ্য দিয়ে পার করছে। তবে দুই পক্ষ কৌশলী না হলে তিক্ততার সম্পর্ক আরও বাড়তে পারে। যুগান্তরকে এমনটি জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন বিশ্লেষক।

ইতোমধ্যে হাদির ওপর হামলাকারী পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়াসহ সাম্প্রতিক বিষয়ে ঢাকার উদ্বেগ ও ক্ষোভ জানাতে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে ১৪ ডিসেম্বর তলব করা হয়। এর তিন দিনের মাথায় ১৭ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহকে ডেকে পাঠান ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (বিএম) বি শ্যাম। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক হুমকি এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের দেওয়া উসকানিমূলক ভারতবিরোধী বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতেই তাকে তলব করে ভারত।

এদিকে ঢাকা-দিল্লির বিদ্যমান এ সংকটকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা তার কনসার্ন বিষয়গুলো জানানোর জন্য ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করার পর একধরনের দেখানো পালটাপলটি হিসাবে ভারত বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করেছে। এখানে একটি দৃশ্যমানতার বিষয়ও আছে। দ্বিতীয়ত, কিছু বিষয় দুই পক্ষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ, যা দুই দেশের জন্যই অভ্যন্তরীণভাবে গুরুত্বপূর্ণ। হাদির হত্যাকারী ভারতে পালিয়ে গেছে-এমন তথ্য নিশ্চিত হলে অপরাধীকে ফেরাতে ঢাকা অবশ্যই নয়াদিল্লিকে অনুরোধ জানাবে। যদিও ভারত তাদের দিক থেকে এ বিষয়টি নাকচ করেছে এবং ভারতে থেকে বাংলাদেশবিরোধী কোনো কিছু করা হচ্ছে না-এমন বক্তব্য দিয়েছে। তবে দুই পক্ষ থেকেই এমন কিছু বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, যা দুই দেশকেই স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাত করছে। এ কারণেই টানাপোড়েন দেখছি। কূটনৈতিক এমন তৎপরতা চোখে পড়ছে। তিনি বলেন, দুইদিক থেকেই সংযমের প্রয়োজন। সত্যিই সংবেদনশীল বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করার দরকার আছে। সামনে আমাদের নির্বাচন আছে। তাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ অংশীদারদের যেমন সহযোগিতা প্রয়োজন, ঠিক একইভাবে প্রতিবেশী ও অন্যান্য অংশীদার যারা আছেন, তাদেরও সহযোগিতা প্রয়োজন।

এদিকে বুধবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের কিছু বক্তব্য এসেছে-সেখানে আমাদের কিছু নসিহত করা হয়েছে। যে নসিহত করা হয়েছে, সেটা আমাদের দরকার আছে বলে মনে করি না। বাংলাদেশে নির্বাচন কেমন হবে সেটা নিয়ে আমাদের প্রতিবেশীদের উপদেশ চাই না। এই সরকার প্রথম দিন থেকে স্পষ্টভাবে বলে আসছে, নির্বাচন হবে অত্যন্ত উচ্চমানের, মানুষ যেন গিয়ে ভোট দিতে পারে-সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই; যে পরিবেশ গত ১৫ বছর ছিল না।

দুদেশের দূতদের তলব-পালটা তলব নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমরা তাদের হাইকমিশনারকে ডেকেছি। আমরা যা কিছু বলেছি, তা থেকে কিছু তারা গ্রহণ করেনি। সে বিষয়ে তাদের কিছু দ্বিমত আছে। একই ভাবে আমাদের হাইকমিশনারকেও ডেকেছে। এটা খুব অপ্রত্যাশিত নয়। সাধারণত, এটা ঘটে। তিনি আরও বলেন, আমরা জানি আগে শেখ হাসিনা ভারতে বসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বক্তব্য দিতেন। এখন প্রতিনিয়ত মূলধারার গণমাধ্যমেও তার বক্তব্য আসছে এবং সেই বক্তব্যে প্রচুর উসকানি আছে। যিনি একটা আদালত থেকে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছেন, আমাদের পাশের দেশে বসে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। সেই ক্ষেত্রে আমরা বক্তব্য বন্ধ বা তাকে ফেরত চাইব, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

সার্বিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাকি সময়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন নাও হতে পারে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এক্ষেত্রে সঠিক ধারণা পাওয়া যাবে বলে আশা করি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, দেশে অপরাধ করে যদি কেউ এভাবে সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যেতে পারে, তাহলে এ ধরনের ঘটনা আরও হবে। সীমান্ত সুরক্ষিত না হলেই সমস্যা হবে। আমরা ভারতের কাছে অনুরোধ করতে পারি, অপরাধী হিসাবে যে ব্যক্তির তথ্য দেওয়া হচ্ছে তাকে ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হাতে পেলে যেন ঢাকার কাছে ফেরত দেয়। নয়াদিল্লির কাছে এমন অনুরোধ ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রেখেছে। তিনি আশঙ্কা করে বলেন, সীমান্ত আমাদের যেভাবে সুরক্ষা করা দরকার সেখানে অনেক সময় ঘাটতি দেখা যায়। এ বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। যাতে করে কোনো সন্ত্রাসী বা অপরাধী সীমান্ত পার হয়ে চলে যেতে না পারে। এক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, কিন্তু আমি মনে করি, সীমান্ত সুরক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।