Image description
উদ্দেশ্য নির্বাচন বানচাল করা

টার্গেট কিলিংয়ের মাধ্যমে জনমনে ভীতি প্রতিষ্ঠিত করতে চায় কুচক্রী মহল। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনা এ ষড়যন্ত্রের প্রথম ধাপ। দেশি-বিদেশি অপশক্তির তত্ত্বাবধানে এ ধরনের পরিকল্পিত সন্ত্রাসী হামলার ছক কষেছেন জুলাই বিপ্লবে পতন হওয়া ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের মাস্টারমাইন্ডরা। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আগাম প্রস্তুতি থাকার কথা। কিন্তু হাদির ওপর গুলি এবং হামলাকারীরা নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাওয়ায় জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এভাবে যদি হামলা হতে থাকে এবং সন্ত্রাসীরা নির্বিঘ্নে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যেতে পারে, তাহলে সবার মধ্যে ‘ভীতি’ এস্টাবলিশড হয়ে যাবে। আর দেশবিরোধী চক্রের এ উদ্দেশ্য সফল হয়ে গেলে আসন্ন নির্বাচন বানচাল হওয়ার নানান প্রেক্ষাপট তৈরি হতে পারে। একই সঙ্গে সরকার ও দেশ নানারকম ভূরাজনৈতিক সংকটে পড়ে যাবে। যুগান্তরের কাছে এমন মন্তব্য করেছেন কয়েকজন বিশ্লেষক।

সাবেক আইজিপি মো. নুরুল হুদা যুগান্তরকে বলেন, প্রতিবারই নির্বাচনের আগে টার্গেট কিলিং বাড়ে। তবে এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে চোখ-কান খোলা রেখে কাজ করতে হবে। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অপরাধী গ্রেফতার করতে হবে। নতুবা প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে। আর এতে তারা নিজেদের মিশন সাকসেস করার সুযোগ পাবে। তিনি বলেন, নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে দুর্বৃত্তরা টার্গেট কিলিংয়ের মাধ্যমে জনমনে ভীতি তৈরির অপচেষ্টা করছে। তাদের তৎপরতা অব্যাহত থাকলে মানুষ ভোট দিতে যাওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলবে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ও পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক যুগান্তরকে বলেন, গণ-অভুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত দল এবং তাদের দোসররা নির্বাচন বানচালের টার্গেট করবে, এটাই স্বাভাবিক। এর মধ্যে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলোর মধ্যেও ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু এ প্রতিযোগিতা এখন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর ফলে নির্বাচনি মাঠের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, এসব বিষয় মাথায় রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সক্রিয় হতে হবে। এ কাজে ব্যর্থ হলে হাদির ওপর হামলার মতো ঘটনা থামবে না।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদুল হক মনে করেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক করতে হলে আগে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাবে। তিনি বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগের বড় ‘এলিমেন্ট’ হলো অবৈধ অস্ত্রের বিস্তার এবং একে ঘিরে তৈরি হওয়া ভয়ের পরিবেশ। এছাড়া লুট হওয়া অস্ত্রের ৩০ শতাংশ অপরাধীদের হাতে রয়েছে। ড. মো. তৌহিদুল বলেন, এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার জুলাই-ঐক্য। জুলাইয়ের পক্ষে থাকা সব শক্তিকে সত্যিকারার্থে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তা না হলে নির্বাচন বানচাল করতে কুচক্রী মহল যেভাবে জনমনে ভীতি এস্টাবলিশড করতে চায়, সেটি থামানো যাবে না।

সংকট নিরসনে কয়েকজন বিশ্লেষক বলেন, এ মুহূর্তে দরকার সত্যিকারের জুলাই-ঐক্য এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান চালানো। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান শুরু করা দরকার ছিল।

এছাড়া গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা বৃদ্ধিসহ তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে তার দায় গোয়েন্দা সংস্থাকেও নিতে হবে। যদি তারা আগাম তথ্য না দিয়ে থাকেন, তাহলে তাদের জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে।

১২ ডিসেম্বর ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ-সদস্য প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদিকে গুলি, এর আগে ৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম-৮ আসনের বিএনপির প্রার্থী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহকে গুলি, ১৭ নভেম্বর মিরপুরের পল্লবীতে থানা যুবদলের সদস্য সচিব গোলাম কিবরিয়াকে গুলি করে হত্যাসহ সাম্প্রতিক কয়েক মাসের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, হামলার ঘটনাগুলো একই সুতাই গাঁথা। সব টার্গেট কিলিংয়ের মিশন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে টার্গেট করা হচ্ছে। যারা রাজনৈতিক সংগঠক, মাঠপর্যায়ের নেতা, আসন্ন নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী কিংবা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি। দিনের আলোয়, জনসমক্ষে, ব্যস্ত সড়ক কিংবা জনবহুল এলাকায় গুলি করে হত্যা বা হত্যাচেষ্টার ঘটনা ঘটছে। এর ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে।

সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, মানুষ যত নির্বাচনমুখী হচ্ছে, ততই মানুষকে ভয় দেখাতে এই ধরনের আক্রমণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষ যখন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন দেখছে, সেই সময়ে আবার নতুন করে দেশের শত্রুরা হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠেছে। হাদির ওপর হামলার ঘটনা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।

অপরাধ ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টার্গেট কিলিং মূলত একটি ‘মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র’। একজন প্রার্থী বা নেতাকে প্রকাশ্যে হত্যাচেষ্টা কিংবা হত্যা করা হলে এর প্রভাব পড়বে পুরো এলাকায়। রাজনৈতিক কর্মীরা প্রকাশ্যে মাঠে নামতে ভয় পাবেন, সভা-সমাবেশ স্থবির হয়ে পড়বে। ফলে নির্বাচনি প্রচারণা বাধাগ্রস্ত হবে। ভোটারদের মধ্যেও তৈরি হবে নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা। এরকম পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে চাইবেন না সাধারণ ভোটাররা। তারা বলেন, এছাড়া টার্গেট কিলিংয়ের মূল লক্ষ্য-নির্বাচনি মাঠ ফাঁকা করা। আর যেখানে ভয় কাজ করে, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা টিকে থাকতে পারে না। টার্গেট কিলিংয়ের উদ্দেশ্য কেবল একজন ব্যক্তিকে সরিয়ে দেওয়া নয়; বরং সমাজের সর্বস্তরে নিরাপত্তার শঙ্কার বড় বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। এভাবে জনমনে ভীতি এস্টাবলিশড করতে পারলে লাভবান হবে দেশবিরোধী অপশক্তি। এ অবস্থায় সবচেয়ে বড় প্রয়োজন অপশক্তির বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্তিশালী চিরুনি অভিযান শুরু করা। পাশাপাশি দেশকে সত্যিকারের জুলাই-ঐক্যের পথে নিয়ে যাওয়া।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি মিডিয়া এএইচএম শাহাদত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশের পক্ষ থেকে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। টহল, চেকপোস্ট, গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান জোরদার করা হয়েছে। তিনি জানান, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী শনিবার থেকে অপারেশন ‘ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ শুরু করেছে। অভিযানে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত ২৪৪৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে ১২টি অস্ত্র।