Image description
আইসিডিডিআর,বি’র গবেষণা

গ্রামে বসবাসকারী নারী এবং শহরে বাস করা পুরুষরা বাল্যবিবাহে এগিয়ে। গ্রামের ৪৩ শতাংশ এবং শহরের বস্তির ৬৫ শতাংশ নারী ১৮ বছরে পা দেওয়ার আগেই বিয়ে করেছেন। অন্যদিকে গ্রামের পুরুষদের মধ্যে ১৫ শতাংশ এবং শহরের ৩৭ শতাংশ পুরুষ ২১ বছরে পা রাখার আগেই বিয়ে করেছেন। বিয়ের প্রথম বছরেই প্রায় তিন-চতুর্থাংশ (৭৩ শতাংশ) নারী গর্ভধারণ করছেন। এছাড়া বিয়ের পর গ্রামে ৬০ এবং শহরে ৬৬ শতাংশ নারীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর বিয়ের ছয় মাসের মধ্যেই প্রতি পাঁচজনে চারজন নারী স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হচ্ছেন। ‘বাংলাদেশের নির্বাচিত গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলে নববিবাহিত দম্পতিদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার সংক্রান্ত প্রেক্ষাপট ও চাহিদা নিরূপণ’ শীর্ষক গবেষণায় এমন চিত্র উঠে এসেছে।

‘গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা’র অর্থায়নে পরিচালিত এ ধরনের গবেষণাটি বাংলাদেশে প্রথম দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা। যেখানে গ্রাম ও শহরের নির্ধারিত এলাকার নবদম্পতিদের বিয়ের পরবর্তী জীবন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। গবেষণাটির নেতৃত্ব দেন আইসিডিডিআর,বি’র মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী ও অ্যাডসার্চের থিম লিড ড. ফৌজিয়া আখতার হুদা। বুধবার আইসিডিডিআর,বি’র সাসাকাওয়া মিলনায়তনে অ্যাডসার্চ আয়োজিত সেমিনারে গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়। সেমিনারে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আইসিডিডিআর,বি’র চারটি হেলথ অ্যান্ড ডেমোগ্রাফিক সার্ভিলেন্স সিস্টেম এলাকায় এ মিশ্র পদ্ধতির গবেষণাটি পরিচালিত হয়। গবেষণায় কক্সবাজার জেলার চকরিয়া ও চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলা এবং শহরের বস্তিগুলোর মধ্যে ঢাকার মিরপুর ও কড়াইল বস্তিতে বসবাসরত মোট ৬৬৬ নববিবাহিত দম্পতি অংশ নেয়।

গবেষণার অংশগ্রহণের জন্য যাদের প্রথম বিয়ে, বিয়ের সময়কাল ছিল ছয় মাসের কম এবং যাদের পূর্বের কোনো গর্ভধারণের ইতিহাস ছিল না-এমন দম্পতিদেরই বেছে নেওয়া হয়েছিল। প্রতি চার মাস অন্তর দম্পতিদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়, অর্থাৎ দুই বছরে মোট ছয় দফা তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষণায় বিয়ের পরের পরিবর্তন, সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা, দাম্পত্য সহিংসতা এবং বৈবাহিক জীবনে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা হয়।

গবেষণায় অল্প বয়সে বিয়ের প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। নারীদের মধ্যে গ্রামে ৪৩ শতাংশ এবং শহরের বস্তিতে ৬৫ শতাংশ নারী ১৮ বছরের আগেই বিয়ে করেছেন। অথচ অনেক নারী, বিশেষ করে শহরের বস্তিতে বসবাসকারী নারীরা কিছুটা দেরিতে সন্তান নিতে চেয়েছিলেন। প্রায় অর্ধেক নারীর গর্ভধারণই ছিল অনিচ্ছাকৃত বা সময়ের আগেই। গবেষণায় অংশ নেওয়া পুরুষদের মধ্যে গ্রামে ১৫ শতাংশ এবং শহরে ৩৭ শতাংশ পুরুষ ২১ বছরের আগেই বিয়ে করেছেন। কম বয়সে বিয়ে করা নারীদের বেশির ভাগেরই বিয়ে পারিবারিকভাবে ঠিক করা হয়েছিল গ্রামে ৮৫ শতাংশ এবং শহরে ৫৩ শতাংশ। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী নারী বিয়ের পরপরই গ্রামে ৬০ শতাংশ এবং শহরে ৬৬ শতাংশ পড়াশোনা বন্ধ করেছেন। এর পেছনে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির আপত্তি, মা-বাবার সিদ্ধান্ত, বিয়ের পর বাসস্থান পরিবর্তন, সামাজিক রীতি এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা কাজ করেছে। আয়মূলক কাজের ক্ষেত্রেও একই ধরনের বাধা দেখা গেছে, যেখানে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির নিয়ন্ত্রণ নারীদের কাজের সুযোগকে প্রভাবিত করেছে।

গবেষণায় ৪৭ শতাংশ অনিচ্ছাকৃত বা সময়ের আগে গর্ভধারণের তথ্য পাওয়া গেছে। গ্রামের অংশগ্রহণকারীদের তুলনায় শহরের এই হার তিনগুণের বেশি। গবেষণার দেখা যায়, মোট ৭৩ শতাংশ নারী গর্ভধারণ করেছেন, বেশির ভাগই বিয়ের প্রথম বছরের মধ্যেই। শহরের ৬৮ শতাংশ নারী অন্তত দুই বছর অপেক্ষা করতে চাইলেও ৬৭ শতাংশ নারী ওই সময়ের মধ্যেই গর্ভবতী হয়ে পড়েন। গর্ভনিরোধক ব্যবহারে শুরুতে গ্রাম ও শহরের মধ্যে পার্থক্য ছিল শহরে ব্যবহার বেশি, গ্রামে কম। তবে বিয়ের প্রায় ১৮ মাস পর উভয় এলাকায় ব্যবহার প্রায় একই পর্যায়ে আসে। এটি নবদম্পতিদের মধ্যে দ্রুত সন্তান নেওয়ার প্রবণতাকে নির্দেশ করে।

গবেষণায় দাম্পত্য সহিংসতার প্রাথমিক অভিজ্ঞতাও উঠে এসেছে। বিয়ের প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই ৭৯ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় পাঁচজনের চারজন নারী স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের কথা প্রকাশ করেন। দুই বছরে ৫২ শতাংশ নারী আর্থিক সহিংসতা, ২৩ শতাংশ মানসিক সহিংসতা, ১৫ শতাংশ শারীরিক সহিংসতা এবং ১৪ শতাংশ যৌন সহিংসতার শিকার হন। মাত্র ৪ শতাংশ নারী জানান, এই সময়ে তারা কোনো ধরনের সহিংসতার মধ্যে পড়েননি। দাম্পত্য সন্তুষ্টির মাত্রাও সময়ের সঙ্গে বদলেছে। গবেষণার শুরুতে পুরুষ নারীর তুলনায় বেশি সন্তুষ্টির কথা জানান। সময়ের সঙ্গে উভয়ের সন্তুষ্টি কমেছে এবং একপর্যায়ে স্থিতিশীল হয়েছে। তবে পুরুষের ক্ষেত্রে এই পতন তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল।

সেমিনারে আইসিডিডিআর,বি’র বিজ্ঞানী ও এই প্রধান গবেষক ড. ফৌজিয়া আখতার হুদা, সহকারী বিজ্ঞানী তারানা-ই-ফেরদৌস এবং রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর সৈয়দ হাসান ইমতিয়াজ যৌথভাবে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন। স্বাগত বক্তব্য দেন অ্যাডসার্চের প্রকল্প সমন্বয়কারী ও সহযোগী বিজ্ঞানী আনিসুদ্দিন আহমেদ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন অ্যাডসার্চের প্রকল্প পরিচালক ও সিনিয়র সায়েন্টিস্ট (ইমেরিটাস) ড. শামস এল আরেফিন।

আইসিডিডিআর,বি’র বিজ্ঞানী ড. আহমেদ এহসানূর রহমানের সঞ্চালনায় সেমিনারে একটি প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় অংশ নেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. রফিকুল ইসলাম তালুকদার, হেলথ সেক্টর ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাডভাইজার ডা. শাহ আলী আকবর আশরাফী, ওজিএসবির সাবেক সভাপতি ডা. ফারহানা দেওয়ান, ইউএনএফপি বাংলাদেশের টেকনিক্যাল অফিসার ডা. রোকসানা ইয়াসমিন প্রমুখ।