জুলাই যোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টার পর শুটার ফয়সাল করিম মাসুদ এখন অবস্থান করছেন ভারতের মহারাষ্ট্রে। বাংলাদেশি সিমকার্ড পরিবর্তন করে ব্যবহার করছে ভারতীয় রিলায়েন্স জিও কোম্পানির সিমকার্ড। তবে অধিকাংশ সময় মোবাইল ফোন বন্ধ রাখা হচ্ছে। এর আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে চতুর ফয়সাল নানা নাটকীয়তার আশ্রয় নেয়। মোবাইল ফোনে ভিপিএন (ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) ব্যবহার করে কখনো অবস্থান দেখান সিঙ্গাপুর আবার কখনো থাইল্যান্ড। কখনো আবার দেখায় পুরান ঢাকায়।
এদিকে ফয়সাল তার ফোনসেটটি পরিবর্তন না করায় ফোনের আইএমই নম্বর ধরে গোয়েন্দারা প্রযুক্তির সাহায্যে শুটার ফয়সালের বর্তমান অবস্থান নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে সে ভারতের মহারাষ্ট্রে অবস্থান করছে। সঙ্গে আছে অন্যতম সহযোগী মোটরসাইকেলচালক আলমগীর শেখ।
এদিকে ওসমান হাদি হত্যাচেষ্টার নেপথ্যে কারা অর্থ বিনিয়োগ করেছে তার অনুসন্ধান করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ফয়সালের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের লেনদেনের সূত্র ধরে অর্থদাতাদের খোঁজা হচ্ছে। হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত অস্ত্রও উদ্ধার হয়েছে। সেটি চার হাতবদল হয়ে যায় নরসিংদীর লেকে। মঙ্গলবার সেখান থেকে মোট তিনটি অস্ত্র উদ্ধার করেছে র্যাব। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, ওসমান হত্যাচেষ্টায় এখন পর্যন্ত মোট ১০ জন গ্রেফতার হয়েছে। তাদের মধ্যে ফয়সালের বাবা হুমায়ুন কবির ও মা মোসা. হাসি বেগম বুধবার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের জবানবন্দিতে ঘটনার বিষয়ে পরিষ্কার একটি ধারণা পেয়েছে তদন্তসংশ্লিষ্টরা। জানতে চাইলে হাদি হত্যাচেষ্টা মামলার তদারকি কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. মাহবুবুল আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের কাছে এই মুহূর্তে চারজন রিমান্ডে আছে। এছাড়া ফয়সালের মা-বাবা বুধবার ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ায় তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার দুই সাক্ষীর জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে।’
তিনি আরও জানান, নুরুজ্জামান নামে আরেকজনকে বুধবার গ্রেফতার দেখিয়ে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া সীমান্ত থেকে আনা দুজনকে বৃহস্পতিবার আদালতে পাঠানো হবে বলে তিনি জানান।
হাদি হত্যাচেষ্টায় এখন পর্যন্ত গ্রেফতারকৃতরা হলেন ফয়সালের স্ত্রী সাহেদা পারভীন সামিয়া, শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ শিপু, ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মারিয়া আক্তার লিমা, হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের কথিত মালিক আবদুল হান্নান, সীমান্ত এলাকায় মানব পাচারে জড়িত সন্দেহে সঞ্জয় চিসিম ও সিবিরন দিও এবং ফয়সালের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও মোটরসাইকেলের মূল মালিক মো. কবির, ফয়সালের বাবা হুমায়ুন কবির ও মা মোসা. হাসি বেগম এবং গাড়ি ভাড়া করে দেওয়া রেন্ট-এ-কারের মালিক নুরুজ্জামান।
ব্যাংকে কত টাকা আছে : তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছেন, তদন্তের একটি বড় অনুষঙ্গ এখন ফয়সালের ব্যাংক হিসাব। তার ব্যাংক হিসাবে কত টাকা আছে এবং কত টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। দেশ ও বিদেশ থেকে কারা কত টাকা দিয়েছে। এসব প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর জানা যেতে পারে আজ। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট ইতোমধ্যে ফয়সালের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত তথ্য জানতে চেয়ে বিএফআইইউ-তে চিঠি দিয়েছে। এ বিষয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। ইতোমধ্যে ফয়সালের সবকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) মুহাম্মদ বাছির উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ-কে আমরা বিষয়টি জানিয়েছি। এখনো রিপোর্ট দেয়নি।
চার হাতবদল হয়ে অস্ত্র যায় নরসিংদীর লেকে : ওসমান হাদি হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত অস্ত্রসহ মোট তিনটি অস্ত্র উদ্ধার করেছে র্যাব। মঙ্গলবার নরসিংদীর একটি লেক থেকে অস্ত্রগুলো উদ্ধার হয়। তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, শুক্রবার দুপুরে ওসমান হাদিকে শুট করার পর ফয়সাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে তার বোনের বাসায় একটি কালো ব্যাগে অস্ত্র লুকিয়ে রাখে। ব্যাগটি শ্যালক ওয়াহিদ আহমেদ শিপুর কাছে দিয়ে দিতে ওইদিন মাগরিবের নামাজের পর ফয়সাল তার বাবা হুমায়ুন কবিরকে ফোন করেন। যথারীতি শিপু আগারগাঁওয়ের বিএনপি বস্তি থেকে ফয়সালের বোনের বাসায় গিয়ে ব্যাগটি নিয়ে গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে যায়। এরপর ফয়সালের নির্দেশনা অনুযায়ী স্থানীয় এক যুবকের কাছে ব্যাগটি দেয়। ওই যুবকের নামও ফয়সাল। এরপর গুরুত্বপূর্ণ এই আলামত গায়েব করে দিতে ব্যাগটি লেকে ফেলে দেওয়া হয়।
এদিকে এসব তথ্য জানার পর র্যাব মঙ্গলবার রাতে অস্ত্রের ব্যাগটি উদ্ধার করে। ব্যাগের মধ্যে দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন, একটি খেলনা পিস্তল ও ৪১ রাউন্ড গুলি ছিল। নরসিংদী সদর উপজেলার তরুয়া এলাকার মোল্লার বাড়ির সামনে তরুয়ার বিলে পানির মধ্য থেকে ব্যাগটি উদ্ধার করা হয়।
এর আগে মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের কর্নেল গলিতে ফয়সালের বোনের বাসার নিচ থেকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রের ২টি ম্যাগাজিন ও ১১ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে র্যাব।
ফোনে ভিপিএন ব্যবহার : ফয়সাল ভারতে আত্মগোপনে থাকলেও তার মোবাইল ফোনে ভিপিএন ব্যবহার করে একেক সময় একেক স্থানে অবস্থান দেখিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিভ্রান্ত করেছে। তদন্ত সূত্র বলছে, ১৪ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় ফয়সাল তার অবস্থান দেখায় সিঙ্গাপুরে। এর ঘণ্টাখানেক পর অবস্থান দেখায় পুরান ঢাকায়। মূলত ভিপিএন ওপেন করার সময় ব্যবহারকারী চাইলে তার ইচ্ছেমতো লোকেশন নির্ধারণ করে দিতে পারেন।
মোটরসাইকেলের ভুয়া নম্বর প্লেট ম্যানহোলে : ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল, হেলমেট ও ভুয়া নম্বর প্লেট উদ্ধার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। পশ্চিম আগারগাঁও বনলতা আবাসিক এলাকার একটি বাড়ির নিচতলার পার্কিং থেকে মোটরসাইকেল ও হেলমেট উদ্ধার করা হয়। ভুয়া নম্বর প্লেট পরিত্যক্ত অবস্থায় ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। মোটরসাইকেলটির প্রথম মালিক আব্দুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। পরে শহিদুল, রাসেল, ওবায়দুর, আনোয়ারুল এবং আনোয়ারুলের থেকে ওবায়দুর হয়ে শুভ নামের এক ব্যক্তির কাছে যায় মোটরসাইকেলটি। সর্বশেষ ফয়সালের সহযোগী মো. কবিরের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে মাইনুদ্দিন ইসলামের নামে মোটরসাইকেলটি কেনা হয়।
হামলায় ব্যবহার হওয়া হোন্ডা কোম্পানির হরনেট সিরিজের মোটরসাইকেলটির আসল নম্বর ঢাকা মেট্রো-ল ৫৪-৬৩৭৫। বিআরটিএর সার্ভার থেকে নেওয়া মালিকানার তথ্যের ভিত্তিতে মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে আব্দুল হান্নানকে গ্রেফতার করে র্যাব। হান্নান আদালতকে জানান, মোটরসাইকেলটি তিনি দুই মাস আগে মিরপুরের একটি শোরুমে বিক্রি করে দেন। কিন্তু নাম পরিবর্তন করা হয়নি। হান্নানের কথার সত্যতা যাচাই করতে গেলে বড় ধরনের গরমিল সামনে আসে। ঢাকা মেট্রো ল ৫৪-৬৩৭৫ এর বিআরটির রেজিস্ট্রেশন তথ্য বলছে, সেখানে মালিকের নাম আব্দুল হান্নান থাকলেও ভিন্নতা ব্র্যান্ড এবং মডেলে। হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি ছিল হোন্ডা হরনেট সিরিজের আর বিআরটিএর রেজিস্ট্রেশন তথ্য বলছে ঢাকা মেট্রো ল ৫৪-৬৩৭৫ নম্বরের মোটরসাইকেলটি সুজুকি জিক্সার। তদন্তে উঠে এসেছে ওসমান হাদির ওপর হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের নম্বর ঢাকা মেট্রো ল ৫৪-৬৩৭৬। নম্বরের শেষে ৬-এর জায়গায় ৫ লেখায় এই বিপত্তি ঘটে। হান্নানের পরিবারের অভিযোগ, প্রথম থেকেই তারা বলে এসেছেন এ ঘটনায় হান্নানের কোনো সম্পৃক্তা নেই। কিন্তু তাদের কোনো কথাই শোনেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মো. শফিকুল ইসলাম গণামধ্যমকে বলেন, মামলায় সম্পৃক্ততা পাওয়া না গেলে হান্নানকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।
ময়মনসিংহ ব্যুরো অফিসের স্টাফ রিপোর্টার অমিত রায় জানান, ওসমান হাদি হত্যাচেষ্টায় সরাসরি জড়িত ফয়সাল ও আলমগীর ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত ব্যবহার করে ভারত পালিয় গেছেন এমন তথ্য দিচ্ছেন স্থানীয়রা। সূত্র বলছে, হামলাকারীরা ঘটনার দিন শুক্রবার রাতেই একাধিক সড়ক-মহাসড়ক ব্যবহার করে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের ভুটিয়াপাড়া সীমান্ত ব্যবহার করে স্থানীয় কিলার ও মানবপাচারকারী ফিলিপ স্নালের সহযোগিতায় ভারতে পালিয়ে গেছেন তারা। ফিলিপ স্নালের বাড়ি হালুয়াঘাট উপজেলার ভুটিয়াপাড়া সীমান্তে। তার বাড়ি থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে সীমান্তের কাঁটাতারের বেষ্টনীঘেঁষা কালভার্টের দুটি সুড়ঙ্গ দিয়েই শুটার ফয়সাল ও আলমগীর পালিয়েছে বলে ধারণা করছে একাধিক স্থানীয় সূত্র।
উল্লেখ্য, শুক্রবার বেলা ২টা ২০ মিনিটে ঢাকার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট এলাকায় ওসমান হাদিকে গুলি করা হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে সিটিস্ক্যান এবং অস্ত্রোপচারের পর উন্নত চিকিৎসার জন্য ওইদিন রাতেই তাকে স্থানান্তর করা হয় এভারকেয়ার হাসপাতালে। সেখান থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে নেওয়া হয়েছে সিঙ্গাপুরে।