জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে শঙ্কা প্রকাশ করা হলে জনমনে আতঙ্ক আরও বাড়বে বলে মনে করছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিভিন্ন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ে এমন কোনো বক্তব্য দেওয়া এই মুহূর্তে উচিত নয়। মানুষ দেখতে চায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান তৎপরতা। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এ নিয়ে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। এই ভাষণের একটি অংশের প্রতিক্রিয়ায় বুধবার বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের নেতারা এসব কথা বলেন। তবে দলগুলো এ-ও বলেছে, প্রধান উপদেষ্টা পরিষ্কার করেছেন যে, পরাজিত শক্তি ফ্যাসিবাদী ও সন্ত্রাসীদের (ফ্যাসিস্ট টেরোরিস্ট) অপচেষ্টা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ করে দেওয়া হবে। এছাড়া পুরো বক্তব্য ছিল সময়োপযোগী। বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে নিয়ে ভাষণে যা বলেছেন, তা সবার হৃদয় স্পর্শ করেছে।
মঙ্গলবার মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের একটি অংশে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, গণতান্ত্রিক উত্তরণের (নির্বাচন) পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। কেউ ভয় দেখিয়ে, সন্ত্রাস বা রক্ত ঝরিয়ে এই যাত্রা থামাতে পারবে না। নির্বাচন ঠেকাতে পরাজিত শক্তির কঠিনতর পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আছে। এক্ষেত্রে পরিষ্কারভাবে বলছি, পরাজিত শক্তি ফ্যাসিবাদী ও সন্ত্রাসীদের (ফ্যাসিস্ট টেরোরিস্ট) এই অপচেষ্টা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ করে দেওয়া হবে।
ড. ইউনূস বলেন, পরাজিত শক্তির লক্ষ্য হলো নির্বাচন ঠেকানো। বন্ধুরা যতদিন তাদের সঙ্গে আছে, ততদিন তারা এই স্বপ্ন দেখবে। নির্বাচন হয়ে গেলে বন্ধুরা তাদের প্রতি সমর্থন জোগাতে বেকায়দায় পড়বে। সেজন্যই তো তাদের এত তাড়াহুড়া। তারা নির্বাচনের আগেই তাদের ফিরে আসা নিশ্চিত করতে চায়। চোরাগোপ্তা খুন করার উদ্যোগ তার একটা রূপ।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল যুগান্তরকে বলেন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সবাই একটা বিশ্লেষণ এবং চিন্তিত অবস্থায় আছে। তার মধ্যে নতুন করে যদি আতঙ্ক যুক্ত হয়, এ রকম বক্তব্যে কোনো দায়িত্বশীল জায়গা থেকে আসা উচিত নয়। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে। আশা করি, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সব দিকে এখন বিশেষ নজর দিতে হবে, কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম যুগান্তরকে বলেন, প্রশাসনের ভূমিকায় জনগণ সন্তুষ্ট নয়। ওসমান হাদির ঘটনায় জনগণ কী বার্তা পাচ্ছে তা সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টাও তার ভাষণে পরাজিত শক্তির পরিকল্পনা সম্পর্কে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। কিন্তু মাঠ প্রশাসনের ভূমিকায় মানুষ সন্তুষ্ট নয়।
তিনি আরও বলেন, ওসমান হাদির ঘটনা প্রমাণ করে যে, গোয়েন্দা তথ্যের যথেষ্ট ঘাটতি আছে; অথবা তথ্য জানার পরও পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে নির্বাচন নিয়ে তো শঙ্কা থেকেই যাবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন প্রয়োজন।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহমদ বুধবার দলের নিয়মিত বৈঠকে বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধানের কাছে মানুষ আশার বাণী শোনার চেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা দেখতে চায়। কিন্তু তিনি কার্যকর ব্যবস্থার চেয়ে আশার বাণী বেশি শোনান। গতকালের বক্তব্যেও তিনি একই ধারা অনুসরণ করেছেন। অথচ তফসিল ঘোষণার পর সারা দেশ যেখানে আনন্দমুখর হওয়ার কথা সেখানে দেশ থমকে আছে। হাদির ঘটনার পরে জনতা আশ্বস্ত হওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা দেখতে পায়নি।
গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন নিয়ে নানা শঙ্কার কথা বলে আসছেন। বিদেশের মাটিতে বসে পতিত স্বৈরাচার নির্বাচন বানচাল করতে চায়-তার এ অভিযোগ সত্যি। কিন্তু দেশের মাটিতে বসেও একটি পরাজিত অপশক্তি নির্বাচন বানচাল করতে চায়-এ বিষয়ে তিনি কখনো কথা বলেন না। তিনি সরকারপ্রধান। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব তার। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা নিজেই যদি এত শঙ্কা বা সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকেন-তাহলে সাধারণ মানুষ কার কাছে যাবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্য সচিব ও সংগঠনটির মিডিয়া সেলের প্রধান মুশফিক উস সালেহীন যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্য ছাড়াও নির্বাচন বানচালের জন্য একটি গোষ্ঠী সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে-এমন বক্তব্য আমরাও বলে আসছি। তিনি (ড. মুহাম্মদ ইউনূস) ঠিক বলেছেন, নির্বাচনকে ঠেকাতে পরাজিত শক্তি উঠেপড়ে লেগেছে। আওয়ামী লীগ অর্থাৎ একটা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দেশের বাইরে থেকে ঘোষণা দিয়েই তারা নির্বাচন বানচাল করতে চাচ্ছে। সেটা করার জন্য নানারকম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাসীরা হুমকি দিচ্ছে এবং সেই হুমকিগুলোর বিভিন্ন রেকর্ডও আমরা অনলাইনে শুনতে পাচ্ছি।
তিনি বলেন, এখন প্রধান উপদেষ্টা যেহেতু এটা বুঝতে পেরেছেন, সুতরাং ওনার বক্তব্যে ওই শঙ্কাটা এসেছে। এখন ওনার কাছে আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে, উনি যাতে এ সময় সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য, প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সার্বিকভাবে দেশের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।
বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ-সদস্য নাজমুল হক প্রধান যুগান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচন ঠেকাতে পরাজিত শক্তির কঠিনতর পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আছে’-এ কথা বলে প্রধান উপদেষ্টা অযথা বাতাসে ঢিল ছুড়ছেন। তার উচিত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার শতভাগ চেষ্টা করা। প্রার্থী এবং ভোটার-উভয়েরই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। প্রার্থীর নিরাপত্তার উদ্যোগ নেওয়া হলো, কিন্তু ভোটার নিরাপত্তাহীন থাকল-তাহলে কোনো কাজ হবে না। এছাড়া একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে যেসব বাধা বা চ্যালেঞ্জ রয়েছে-তা দূর করতে হবে। এসব না করে নিজেদের ব্যর্থতা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে কোনো লাভ হবে না।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহিল কাফি রতন বলেন, নির্বাচন ভন্ডুল করতে চায় এ রকম একটা শক্তি থাকবেই, এটাই বাস্তবতা। যারা মুখে মুখে বা প্রকাশ্যে নির্বাচনের কথা বলছেন, তারাও নেপথ্যে নির্বাচন ভন্ডুল করতে চাইতে পারে। আবার যারা নির্বাচন চান না, তারাও নির্বাচন বানচাল করতে চাইবে। এখানে প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রশ্ন হচ্ছে, তার হাতে ক্ষমতা আছে। সেনাবাহিনী আছে। পুলিশ বাহিনী আছে। প্রশাসন আছে। তার দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। তিনি বরাবরই উৎসবমুখর নির্বাচনের কথা বলে আসছেন। তাই তাকেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য এবং উৎসবমুখর নির্বাচন উপহার দিতে হবে। এক্ষেত্রে অন্যের কাঁধে দায় চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
এদিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দেশের ইতিহাসের ‘গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ’ হিসাবে ভাষণে অভিহিত করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। একই সঙ্গে শরিফ ওসমান হাদির প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এই সম্মুখযোদ্ধার যে হামলার ঘটনা ঘটেছে, তা শুধু একজন ব্যক্তির ওপর আঘাত নয়-এটি বাংলাদেশের অস্তিত্বের ওপর আঘাত, গণতান্ত্রিক পথচলার ওপর আঘাত। জড়িতদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। এ প্রসঙ্গে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেন, প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্য ছিল সবচেয়ে ভালো দিক। যে বক্তব্য পুরো জাতি ইতিবাচকভাবে দেখেছে।