দেশের টেক্সটাইল শিল্পে দীর্ঘদিনের বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের সঙ্গে যোগ হয়েছে ডলারের বাড়তি দামের চাপ, যার ফলে তৈরি হয়েছে তীব্র মূলধন ঘাটতি। এর প্রভাবে কারখানাগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ৩০ শতাংশ বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার দক্ষ শ্রমিক। উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, সংকট থেকে দ্রুত উত্তরণ না হলে ২০২৬ সালের মধ্যে দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ টেক্সটাইল কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। দেশের বড় শিল্প খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিযোগ এখন নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহের সংকট। এই সমস্যা থেকে এখনো কার্যকরভাবে বের হতে পারেনি সরকার। ফলে কমছে সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা, বাড়ছে বেকারত্ব এবং পূরণ হচ্ছে না ব্যবসায়িক লক্ষ্য। বিশেষ করে টেক্সটাইল খাতে ব্যবসা সংকুচিত হওয়ায় জ্বালানির চাহিদাও কমেছে। এই ধারাবাহিকতায় গেল এক বছরে জ্বালানি সরবরাহ পরিস্থিতিতে খাতটিতে কিছুটা স্বস্তি এলেও সার্বিক সংকট এখনো কাটেনি। রাজধানীর আশপাশের কয়েকটি শিল্পাঞ্চলে জ্বালানি সংকটের কারণে সক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশ মেশিন বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন টেক্সটাইল উদ্যোক্তারা।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি বিদ্যুৎ খাতকে বিগত সরকারের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েও বিপিডিবিকে লোকসান থেকে বের করা যায়নি। বরং বিগত অর্থবছরে সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নেয়ার পরও প্রায় ৯ হাজার ৮০০ কোটি (প্রাক্কলন) টাকার মতো লোকসান করেছে সংস্থাটি। যার নীরিক্ষা এখন চলছে। এ লোকসানের কারণে বিপিডিবি একদিকে যেমন বিদেশী অর্থ পরিশোধ নিয়ে টানাপড়নে রয়েছে, তেমনি স্থানীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে বিপুল পরিমাণ দেনায় জর্জরিত হয়েছে। অর্থাৎ এ খাতে পুরনো বন্দোবস্তের ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। গত দেড় বছরের বেশি সময়ে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিপিডিবির লোকসান কমেনি। সিস্টেম লস আরো কিছুটা বেড়েছে।এদিকে ধাপে ধাপে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির বোঝা শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে করছে ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস (আইইইএফএ)। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের থ্রি জিরো তত্ত্বের প্রতিশ্রুতি শূন্য কার্বন নিঃসরণে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। সবুজ বিদ্যুৎতায়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়নি। বছরের পর বছর অব্যাহতভাবে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হচ্ছে এখাত। কাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে সংস্থাটির ওপর থেকে চাপ কমিয়ে এটিকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করা প্রয়োজন। আগামী নির্বাচিত সরকারের সামনে জ্বালানি সরবরাহ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাই এখন থেকেই এ খাতের নতুন বিনিয়োগ করা না হলে ২০৩১ সালে সরবরাহ সংকট দেখা দেবে। এ খাতের ধারাবাহিক নীতি কাঠামোর দাবি জানান ব্যবসায়ীরা।
এদিকে ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে উদ্যোক্তাদের মূলধন কমে গেছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, জ্বালানি ও অর্থ সংকট কাটিয়ে ওঠা না গেলে ২০২৬ সালের মধ্যে টেক্সটাইল খাতে অর্ধেক মেশিন বন্ধ হয়ে যাবে। এতে উৎপাদন ক্ষমতা নেমে আসবে অর্ধেকে এবং চাকরি হারাবে লাখো কর্মী। বর্তমানে কাঁচামাল আমদানিতে আগের তুলনায় ৩৫ শতাংশ কম ডলার ব্যবহার করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ২০২৬ সালের শেষ নাগাদ প্রায় ৫০ শতাংশ টেক্সটাইল কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিনিয়োগ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে ব্যাংকাররা বলছেন, আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবসায় বিনিয়োগে উদ্যোক্তা ও ব্যাংকের অংশীদারিত্ব সাধারণত ৫০-৫০ হলেও বাংলাদেশে তা ভিন্ন। অগ্রণী ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেত বলেন, দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিনিয়োগের ৮০ শতাংশ বা তারও বেশি আসে ব্যাংক থেকে, আর উদ্যোক্তার নিজস্ব বিনিয়োগ থাকে মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ। আন্তর্জাতিকভাবে এমন চিত্র দেখা যায় না। উদ্যোক্তাদের নিজস্ব ইকুইটি শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এজন্য পার্টনার আনা, বন্ড মার্কেট কিংবা ক্যাপিটাল মার্কেটে যাওয়ার বিকল্প নেই। কিন্তু বাস্তবে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী ব্যাংক ঋণের ওপরই নির্ভরশীল। প্রকল্প শুরুর সময় উচ্চ সুদের হার মেনে নিলেও কিছুদিন পরই তা বহন করা কঠিন হয়ে পড়ে। তখনই সংকট শুরু হয়।
সময় সংক্ষেপে অন্তর্বর্তী সরকার। সমাধানের পথ ক্ষীণ হওয়ায় আপাতত চাহিদা মেটাতে উচ্চ সুদের ঋণই বড় সহায়ক। অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, উদ্যোক্তাদের মূলধন ঘাটতি পূরণ করতে হবে এমন ব্যয়ে, যাতে রিটার্ন ও খরচের মধ্যে ভারসাম্য থাকে। তবে এটি সবার ক্ষেত্রে সম্ভব হবে না। আধুনিক ও কমপ্লায়েন্ট বড় কারখানাগুলো হয়তো উচ্চ সুদের হার টিকে যাবে, কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি টেক্সটাইল কারখানা এবং আউটসোর্সিং নির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলো ঝুঁকিতে পড়বে। এর ফলে খাতে বড় কারখানার আধিপত্য বা এক ধরনের মনোপলি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন । ব্যবসায়ীদের দাবি, টেক্সটাইল শিল্প ঠিক রাখতে জ্বালানি সরবরাহে দাম একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নির্ধারণ করে দেয়া ও দেশের বাজার পরিস্থিতি ঠিক রাখতে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে সরকারকে। এনজেড টেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সালেউদ জামান খান সেমিনারে বলেন, অনেক কারখানা এখন মাত্র ৫০ শতাংশ সক্ষমতায় চলছে। ফলে গ্যাসের চাহিদাও কমে গেছে। এ কারণেই হয়তো বর্তমানে কিছু ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে। তবে কিছু কারখানায় এখনও গ্যাস সংকট রয়েছে, যেগুলো কার্যত আন্ডার-ডাউন অবস্থায় আছে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব এক প্রতিবেদনে লেখেছেন, সোলার হোম পলিসি সংস্কার করে ব্যক্তি খাতে বিদ্যুৎ বিক্রির বৈধতা। স্রেডা ও ইউএনডিপির তত্ত্বাবধানে তৈরি ‘ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপ ২০২১-৪১। জমির স্বল্পতা সত্ত্বেও সৌর বিদ্যুতায়নের মধ্যমানের কৌশলে ২০৪১ সালের মধ্যে দেশে ২০ হাজার মেগাওয়াট সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। নদী অববাহিকা উন্নয়নের ৫ শতাংশ ভূমি, শিল্পাঞ্চলের রুফটপ ১৫ শতাংশ ভূমি প্রভৃতি নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের সৌর স্থাপনা মডেলে এই সক্ষমতা ৩০ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছানো সম্ভব।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সেমিনারে বলেলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিগত সরকার যেসব পরিকল্পনা নিয়েছিল তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। আমরা দায়িত্ব নিয়েছিলাম তখন এ খাতে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের বকেয়া দায় ছিল। যা এখন ৫০০-৬০০ মিলিয়নে নেমে এসেছে। এখন এ খাত সংস্কারের জন্য আমরা সমন্বিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মহাপরিকল্পনা করছি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত অক্টোবর পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতে অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা ৬১ শতাংশ। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিদ্যুৎ খাতের চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসে ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ, বিপরীতে ব্যয় বেড়েছে ১১ গুণ। অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতার জন্যই পিডিবির ভর্তুকির বোঝা ক্রমেই বাড়ছে। একই সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে অনেকগুলো অস্বচ্ছ চুক্তিও হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গত এক বছরে বড় আকারের আর্থিক সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা এবং ব্যয় সাশ্রয়ের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছে সরকার।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভর্তুকি ছিল ৬২ হাজার কোটি টাকা, তা কমিয়ে চলতি অর্থবছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকায় নামানো হয়েছে। বিপিডিবির ১০ শতাংশ ব্যয় হ্রাসের পরিকল্পনা নিয়ে নানামুখী সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে, যা এরই মধ্যে বাস্তবায়নে দেড় হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। তরল জ্বালানি আমদানির সার্ভিস চার্জ ৯ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ৪৭০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে চলতি অর্থবছরে। এছাড়া মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ কম নির্ধারণ এবং ১০টি মেয়াদোত্তীর্ণ ও পুরনো আইপিপি বা রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে। এতে যথাক্রমে সাশ্রয় হয়েছে আড়াই হাজার কোটি ও ৫২৫ কোটি টাকা। সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি গুলোর বিদ্যুতের ট্যারিফ কমানোর মাধ্যমে সাশ্রয় করা হয়েছে ২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। বিশেষ আইনের অধীনে করা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে কিনা তা নিয়ে তদন্ত করছে বিশেষজ্ঞ কমিটি। এ কমিটি আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝিতে প্রতিবেদন জমা দেবে মন্ত্রণালয়ে। গত ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দেশে রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যাত্রা শুরু। পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশেষ আইন প্রণয়ন করে কুইক রেন্টাল ও ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারের (আইপিপি) মাধ্যমে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় দেশে চাহিদার বিপরীতে সামঞ্জস্যহীন ভাবে বাড়ানো হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা।
বিপিডিবির তথ্য অনুয়ায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি ও আমদানি মিলে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে এক লাখ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টার বেশি। যার মধ্যে বেসরকারি খাত উৎপাদন করে বিক্রি করেছে ৩৫ হাজার ৫০১ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় কমে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে হয়েছে ৩৪ হাজার ৭২৮ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টায়। যৌথ মালিকানাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বাড়িয়েছে বিপিডিবি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিডিবির যৌথ মালিকানাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ছিল ১০ হাজার ৬৮০ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৬৭৫ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টায়। টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের অফগ্রিড-অনগ্রিড মিলিয়ে সক্ষমতা ১ হাজার ৬৮৯ মেগাওয়াট। যার মধ্যে ১ হাজার ৫৯ মেগাওয়াট সরাসরি গ্রিডভিত্তিক বিদ্যুৎ। যেখানে গ্রিডের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৮ হাজার ৩৫৯ মেগাওয়াট।