Image description
৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্তে হিমশিম বিএনপি ও জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট

১২ ফেব্রুয়ারির ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে শেষ মুহূর্তের হিসাব নিকাশে দলগুলো। নির্বাচন সহজ হবে না এমন সমীকরণে ৩০০ আসনের প্রার্থী চূড়ান্ত করতে হিমশিম খাচ্ছে বিএনপি, জামায়াতসহ অধিকাংশ দল। বিশেষ করে বিএনপির ২৭২ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করলেও দীর্ঘদিনের আন্দোলনের শরিক দলগুলোর জন্য আসন ছাড় দিতে গিয়ে নানা হিসাবনিকাশ করতে হচ্ছে। এনিয়ে একাধিক বৈঠক হলেও এখনো এ নিয়ে সমাধান না হওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে শরিকদের মাঝে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ৩০০ আসনে একক প্রার্থী ঘোষণা করলেও আটটি দল নিয়ে আগামী রাজনীতিতে ‘বিকল্প শক্তি’ হিসেবে উঠতে চাচ্ছে দলটি। তারা ঘোষণা করেছে ‘ওয়ান বক্স পলিসি’, যার মানে প্রতি আসনে একজন প্রার্থী। কিন্তু এখানেও জট রয়েছে। একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও সমঝোতা হয়নি। আগামী

নির্বাচনে জোটভুক্ত হলেও নিবন্ধিত দলগুলোকে নিজস্ব প্রতীকে ভোট করতে হবে। এ জন্য প্রার্থী চূড়ান্ত করতে শেষ মুহূর্তে হিসাবনিকাশে দলগুলো। সংশ্লিষ্টরা বলছে, নিরাপত্তাসহ নানা শঙ্কা থাকলেও দেশজুড়ে বইছে নির্বাচনি হাওয়া। দলগুলো আনুষ্ঠানিক মনোনয়ন ফরম বিক্রিসহ সংশ্লিষ্ট কাজ শুরু করেছে। চূড়ান্ত মনোনয়ন না পেলেও প্রার্থীরা বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যস্ত। বলা যায়, পুরো দেশ এখন নির্বাচনমুখী। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে ছোট-বড় অর্ধ শতাধিক রাজনৈতিক দল মাঠে তৎপর। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে আগ্রহীরাও নিজ নিজ সংসদীয় এলাকায় গণসংযোগ শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের বাইরে থাকায় দলগুলো এখন বড় কোনো জোটে জায়গা পেতে মরিয়া। কিন্তু আসন চাহিদা, ক্ষমতার সমীকরণ ও নেতৃত্ব নিয়ে একের পর এক জোটে তৈরি হচ্ছে উত্তাপ, ক্ষোভ আর অভিমান, যা পুরো বিরোধী অঙ্গনকে জটিল করে তুলেছে।

নির্বাচন ঘিরে অন্তত পাঁচটি বড় জোট সক্রিয়। যেসব দল এখনো জোটে নেই, তারা যে কোনোভাবে কোনো বড় জোটের ছায়ায় ভোটযুদ্ধে নামতে চাইছে। তবে সবচেয়ে বড় বাধা আসন বণ্টন। ছোট দলগুলো চায় নিজেদের তুলনায় বেশি আসন পেতে। বিপরীতে বড় দলগুলো বেশি আসন ছাড়তে নারাজ। এমন অবস্থায় প্রকাশ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়, কারও কারও জোট ছেড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।

ভোটের আগে জোটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি। আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলনে একসঙ্গে থাকা সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আসন নিয়ে মতবিরোধ তীব্র হয়েছে। ২৭২টি আসনে নিজস্ব প্রার্থী ঘোষণা করলেও বাকি ২৮টি আসনের অর্ধেকও ঠিক করতে পারছে না বিএনপি। এমন পরিস্থিতি জোটে উত্তাপ দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি গুলশানে অনুষ্ঠিত বিএনপি ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির বৈঠক অস্বস্তিকর পরিবেশে শেষ হয়। আলোচনা মনঃপূত না হওয়ায় দলের শীর্ষ নেতা সাইফুল হক ক্ষুব্ধ হয়ে বৈঠকস্থল ছেড়ে চলে যান। নিজের আগ্রহের আসনে বিএনপি প্রার্থী দেওয়ায় লেবার পার্টি বিএনপির সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। বিদায় বেলায় বিএনপি বেইমানি করেছে বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান।

আসন নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারায় গণঅধিকার পরিষদ বিএনপির পাশাপাশি বিরোধী জোটের সঙ্গেও যোগাযোগ করছে বলে জানা গেছে। চাহিদামাফিক আসন পাওয়ার নিশ্চয়তা না পেয়ে বিএনপিকে নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন দলীয় প্রধান নুরুল হক নুরও।

আসন পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় থাকা বিএনপির মিত্র দলগুলো গত সপ্তাহে বৈঠক করে। যেখানে ২৯টি দলের প্রতিনিধিরা আসন নিয়ে সমাধান না হলে বিএনপি থেকে পথ আলাদা করে নতুন নির্বাচনি জোট গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। সমস্যা সমাধানে সেখান থেকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটামও দেওয়া হয়। মিত্রদের এমন সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিয়ে শনিবার দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নেতারা। যেখানে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আসন্ন নির্বাচন, যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়া দলগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক, আসন সমঝোতা এবং নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হয়।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে- প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা করা হবে এবং ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটানো হবে। এক্ষেত্রে অতীতে শরিক এবং মিত্রদের বিএনপি ২৫টি আসনে ছাড় দিয়েছিল, এবারো যেন তেমন মূল্যায়ন করা হয় সেই আশা করছেন দলগুলোর নেতারা। দলগুলোর শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি একলা চলো নীতিতে এগোচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বিএনপি বন্ধু ছেঁটে ফেলার কৌশল নিয়েছে, যা দলটির জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এ ছাড়া বিএনপি ঘোষিত ২৭২ আসনের অন্তত ৫০টি ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে প্রতিনিয়ত বিক্ষোভ করছেন স্থানীয় নেতা-কর্মীরা।

জোট-অস্থিরতা নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘যাদের সঙ্গে আমরা আন্দোলন করেছি, তাদের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত আছে। আমরা আশা করি-সমাধান বের হবে।’ নতুন নতুন জোট ইতিবাচক বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অবাধ নির্বাচনের জন্য সবাই প্রস্তুত। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীলতা জরুরি।’

অন্যদিকে রাজনীতিতে ‘বিকল্প শক্তি’ হিসেবে উঠতে চাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী-ইসলামী আন্দোলনসহ আট দলের জোট। তারা ঘোষণা করেছে ‘ওয়ান বক্স পলিসি’- প্রতি আসনে একজন প্রার্থী। কিন্তু এখানেও জট রয়েছে। জামায়াতকে বেশি আসন দিতে চাইলে ক্ষুব্ধ ছোট দলগুলো। সমঝোতা করতে দুই দফা বৈঠক করলেও সমাধান হয়নি। শরিক দলের এক নেতা বলেন, সবাই যদি ছাড় দিতে রাজি হতো, এই জট অনেক আগেই কাটত। তবে এখন পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে আসন সমঝোতা হয়নি।

জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী তরুণ নেতৃত্বও পিছিয়ে নেই। এনসিপি, এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’। এনসিপি ইতোমধ্যে প্রথম দফায় ১২৫ আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। আরও নতুন দল এতে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। তাদেরও আসন সমঝোতা সম্পন্ন হয়নি।

জাতীয় পার্টির একাংশ আত্মপ্রকাশ করেছে ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ)’-১৮ দলের জোট। বাম দলগুলোও পিছিয়ে নেই। নয়টি দল নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট’। আন্দোলন ও নির্বাচনে একসঙ্গে কাজের ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত তারা স্বতন্ত্র থাকবে নাকি কোনো বড় জোটে যুক্ত হবে-সিদ্ধান্ত এখনো স্পষ্ট নয়। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে আগামী ২৯ ডিসেম্বর সোমবার পর্যন্ত। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ২০ জানুয়ারি মঙ্গলবার। প্রার্থী তালিকা প্রকাশ ও প্রতীক বরাদ্দ করবেন ২১ জানুয়ারি।