Image description
কারা হেফাজতে প্রতিবছর গড়ে মারা যাচ্ছেন ৭৮ জন ১৫ মাসে ৭ আ. লীগ নেতার মৃত্যু সেপ্টেম্বরে মৃত্যু ৮ জনের অক্টোবরে মৃত্যু ১৪ জনের নভেম্বরে মৃত্যু ১২ জনের

বিভিন্ন রোগ ও বার্ধক্যজনিত কারণে কারা হেফাজতে নিয়মিত বন্দির মৃত্যু হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, গড়ে প্রতিবছর অন্তত ৭৮ জন বন্দি মারা যান। তবে তাঁদের প্রত্যেকে কারাগারের বাইরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে বা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে এভাবে ৩৯২ জন বন্দির মৃত্যু হয়েছে।

 
সেই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ৭৮ জন বন্দি মারা গেছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, ২০২৪ সালে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৬৫ জন, যাঁদের মধ্যে দণ্ডিত ২৩ জন এবং বিচারাধীন ৪২ জন। ২০২৩ সালে মারা গেছেন ১০৬ জন। এর মধ্যে দণ্ডিত ৪২ জন এবং বিচারাধীন ৬৪ জন।
 
২০২২ সালে মারা গেছেন ৬৫ জন, এর মধ্যে দণ্ডিত ২৮ এবং বিচারাধীন ৩৭ জন। ২০২১ সালে মারা যান ৮১ জন, দণ্ডিত ৫২ জন এবং বিচারাধীন ২৯ জন। ২০২০ সালে মারা যান ৭৫ জন। এর মধ্যে দণ্ডিত ৩০ জন এবং বিচারাধীন ৪৫ জন।

আসকের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, গত বছর ৮ আগস্ট থেকে চলতি বছর নভেম্বর পর্যন্ত ১৫ মাসে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ১১২ জন। এর মধ্যে গত বছর আগস্টে চারজন, সেপ্টেম্বরে চারজন, অক্টোবরে তিনজন, নভেম্বরে তিনজন এবং ডিসেম্বরে তিনজন মারা গেছেন।

চলতি বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মারা গেছেন ৯৫ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ছয়জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৩ জন, মার্চে পাঁচজন, এপ্রিলে ছয়জন, মে মাসে সাতজন, জুনে পাঁচজন, জুলাইতে ১০ জন, আগস্টে ৯ জন, সেপ্টেম্বরে আটজন, অক্টোবর ১৪ জন এবং নভেম্বরে ১২ জন মারা গেছেন। এই সময় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত পাঁচজন নেতাও মারা গেছেন।

এ ছাড়া গত নভেম্বরে মারা গেছেন দুই আওয়ামী লীগ নেতা।

কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, যাঁরা মারা গেছেন, তাঁরা বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। অসুস্থ হওয়ার পর তাঁদের হাসপাতালে পাঠানোর সময় কেউ পথে মারা যান, কেউ বা চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে। জানতে চাইলে আইজি প্রিজনস ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোতাহের হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কারাবন্দি কেউ যদি অসুস্থ হয়ে মারা যান, তাহলে আমাদের মন অনেক খারাপ হয়। একজন বন্দি অসুস্থ হলে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি তাঁকে হাসপাতালে পাঠিয়ে সুস্থ করে তোলার জন্য।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে সবাই বন্দি। কাউকে আমরা দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি না। অসুস্থ হলে সবাইকে আমরা সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করি।’

এক কারা কর্মকর্তা জানান, কারাগারগুলোয় রাতের বেলায় ডাক্তার পাওয়া যায় না। এ ছাড়া দেশের ৬৮টি কারাগারের জন্য অ্যাম্বুল্যান্স রয়েছে মাত্র ২৩টি। কোনো কোনো কারাগারে অ্যাম্বুল্যান্স না থাকায় গুরুতর রোগীকে দ্রুত বাইরের হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হয় না। অনেক সময় লেগে যায়। ফলে পথেই কোনো কোনো রোগী মারা যান।

গত ২৭ নভেম্বর টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগ নেতা সুলতান মিয়া (৫৫) কারাগারে বুকে ব্যথা অনুভব করলে তাঁকে টাঙ্গাইল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। সুলতান মিয়া মির্জাপুর উপজেলার গোড়াই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

জানা যায়, গত বছর ৪ আগস্ট ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কসংলগ্ন গোড়াই হাইওয়ে থানার সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে পুলিশের ছররা গুলিতে গোড়াই ইউনিয়নের লালবাড়ি গ্রামের হিমেলের দুই চোখ অন্ধ হয়ে যায়। এ ঘটনায় হিমেলের মা নাছিমা বেগম টাঙ্গাইল সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মির্জাপুর আমলি আদালতে পুলিশ, সাংবাদিক, আওয়ামী লীগ নেতাসহ ১০০ জনের নাম উল্লেখ এবং ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে মামলা করেন। ওই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হিসেবে গত ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ নেতা সুলতান মিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর প্রায় এক মাস ধরে তিনি টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে আটক ছিলেন। সুলতান মিয়ার মৃত্যুর পর কারা হেফাজতে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যুর বিষয়টি আলোচনায় আসে।

গত ১৮ নভেম্বর বিকেলে মিরপুর ১২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার ও আওয়ামী লীগ নেতা মো. মুরাদ হোসেনকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

এর আগে গত বছর ৯ ডিসেম্বর কারাগারে বন্দি অবস্থায় মারা যান বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল মতিন ওরফে মিঠু (৬৫)। গত বছর ২৬ নভেম্বর বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বগুড়া পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শাহাদত আলম ঝুনু কারা হেফাজতে মারা যান।

একটি হত্যা মামলা, ভাঙচুর ও বিস্ফোরক মামলায় গত বছর ২৪ আগস্ট ঝুনু গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। বগুড়ার জেলা কারাগারের জেল সুপার ফারুক আহমেদ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘কারা হাসপাতালে ঝুনুর হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। পরে তাঁকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তাঁর শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঢাকায় নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে সিরাজগঞ্জ পৌঁছানোর পর পথে তাঁর মৃত্যু হয়।’

গত বছর ২৫ নভেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আবদুল লতিফ কারাবন্দি হিসেবে মারা যান। গত বছর ২৩ নভেম্বর তিনি অসুস্থ বোধ করলে জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৫ নভেম্বর সকালে তিনি মারা যান বলে কারা সূত্র জানায়।

বগুড়া কারাগারে বন্দি অবস্থায় গত বছর ১১ নভেম্বর মারা যান আওয়ামী লীগ নেতা শহীদুল ইসলাম। তিনি বগুড়া শহর আওয়ামী লীগের একটি ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

চলতি বছর ২১ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কাঞ্চিপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কাঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু বকর ছিদ্দিক রাত সাড়ে ১১টার দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাঁকে কারাগার থেকে গাইবান্ধা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ওই সময় আবু বক্কর ছিদ্দিকের ভাতিজা সিফাত অভিযোগ করেন, ‘অসুস্থ হলেও এ খবর আমরা জানতে পারি পরদিন। এই দীর্ঘ সময়ও কারা কর্তৃপক্ষ থেকে তাঁর অসুস্থতা এবং মৃত্যুর বিষয়টি আমাদের জানানো হয়নি।’

এর আগে চলতি বছর ১১ মার্চ বগুড়া জেলা কারাগারে বন্দি আওয়ামী লীগ নেতা এমদাদুল হক ওরফে ভট্টু (৫২) বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। তিনি গাবতলী উপজেলার দক্ষিণপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। গত বছর ৯ ডিসেম্বর কারাগারে বন্দি অবস্থায় মারা যান বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল মতিন ওরফে মিঠু (৬৫)।

মানবাধিকার সংস্থা মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রধান নির্বাহী সাইদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কারা হেফাজতে মৃত্যু দিন দিন বাড়ছে। এ ধরনের মৃত্যু মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আমরা বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করছি। রাষ্ট্র এটাকে কোনোভাবেই অবহেলা করতে পারে না।’

মানবাধিকারকর্মী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, ‘কারাগারে মৃত্যুর ঘটনাগুলো আমাদের কারা ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতাকে সামনে নিয়ে আসে। অনেক সময় কারাবন্দিদের পরিবারগুলো অভিযোগ করছে, প্রয়োজন  অনুযায়ী  চিকিৎসা পাচ্ছে না। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। একই সঙ্গে নিয়মিত শোনা যায়, ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি বন্দিকে কারাগারে রাখা হচ্ছে, যা নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা ও মানবিক আচরণ সবকিছুকেই ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, কারাগার কেবল শাস্তি কার্যকরের স্থান নয়; এটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের একটি সংবেদনশীল স্থান। সুতরাং কারা হেফাজতে থাকা প্রতিটি নাগরিকের জীবন, স্বাস্থ্য ও মর্যাদা রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যাবশ্যক। কারাগারের ভেতর চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়ন, জনবল বৃদ্ধি এবং প্রতিটি মৃত্যুর ক্ষেত্রে স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করা মানবাধিকার সুরক্ষার ন্যূনতম শর্ত।’