জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার প্রধান আইন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)’ সর্বশেষ সংশোধন হয় গত ৩ নভেম্বর। এই আইনের অধীনে নির্বাচনে তফসিল ঘোষণা থেকে ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত সব কার্যক্রম পরিচালিত হবে। আর ‘রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা’র সংশোধিত গেজেট প্রকাশ হয় গত ১০ নভেম্বর। তফসিল ঘোষণার পরই এ আচরণ বিধিমালার প্রয়োগ শুরু হবে। অথচ সংশোধিত আরপিও এবং আচরণ বিধিমালায় রয়েছে প্রায় এক ডজন গুরুতর ভুল ও ত্রুটি। কোথাও কোথাও রয়েছে অস্পষ্টতা। ওইসব ভুল-ত্রুটি সংশোধনে সম্প্রতি আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে ইসি। আগামী ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনের সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ওই সভায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল চূড়ান্ত হতে পারে। ইসির নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আরও জানা গেছে, আরপিও সংশোধনীতে পোস্টাল ব্যালটে ভোটগ্রহণ ও গণনা-সংক্রান্ত তিনটি অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করেছে ইসি। এতে আদালতের রায়ে কোনো আসনে প্রার্থী পরিবর্তন হলে ওই আসনের পোস্টাল ব্যালট গণনার বাইরে রাখার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া আচরণ বিধিমালায় ত্রুটি সংশোধনের পাশাপাশি নির্বাচনি প্রচারে ব্যাপকভাবে বিলবোর্ড ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ সোমবার যুগান্তরকে বলেন, আরপিও এবং আচরণ বিধিমালা সংশোধনী প্রস্তাব পাঠিয়েছি। সেখানে কিছু ত্রুটি ছিল। সেগুলোতে সংশোধন চেয়েছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামী ৭ ডিসেম্বর কমিশন সভা হতে পারে। তখন জাতীয় নির্বাচনের তফসিলের বিষয়ে জানা যেতে পারে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হবে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। তফসিল ঘোষণার আগেই সংশোধিত আইন ও বিধিমালার প্রয়োজন হবে ইসির। সংশ্লিষ্টরা জানান, আরপিও ও আচরণ বিধিমালার সংশোধনী প্রস্তাব ইতোমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আরপিও সংশোধনী অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন প্রয়োজন হবে। আচরণ বিধিমালা আইন মন্ত্রণালয় ভেটিং করলেই জারি হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, যে ধরনের ভুল ও ত্রুটি রয়েছে, তার বেশির ভাগই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অদক্ষতার ছাপ। কিছু কিছু ভুল-ত্রুটির জন্য নির্বাচন কমিশনেরও দায় রয়েছে। ওই বিষয়গুলো নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্তের বিষয়। আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের সময় এসব ভুল-ত্রুটি চিহ্নিত না হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেন তারা।
ইসি সূত্র জানায়, ভুল আরপিও এবং আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (ইটিআই)। নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সরকারের বিভিন্ন বিভাগের দুই হাজার কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে ইটিআই। ওই কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেবেন। নতুন করে সংশোধনী এলে তাদের তা আবার অবহিত করার প্রয়োজন হতে পারে।
আচরণ বিধিমালা : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালার বিধি ৪-এর উপ-বিধি (৩), বিধি ৬ এর উপ-বিধি (ক), (খ), (গ), (ঘ), বিধি ৯-এর উপ-বিধি (গ) এবং বিধি ২৬-এর উপ-বিধি (৩) এ করণিক ভুল রয়েছে। যেমন, ‘করিতে পারবেন না’ শব্দগুলোর স্থলে ‘করা যাইবে না’; ‘পারিবেন’-এর স্থলে ‘পারিবন’ শব্দ এবং ‘করিবে’ শব্দের স্থলে ‘করিতে পারে’ শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব ভুল সংশোধনে আচরণ বিধিমালার প্রায়োগিক কোনো পরিবর্তন আসবে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আচরণ বিধিমালার ৭, ১৪ ও ১৭ বিধিতে যেসব সংশোধনী আনা হয়েছে, তাতে নির্বাচনি প্রচারের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আসবে। বিধি ১৪(খ) সংশোধনীতে ইসির প্রস্তাব হচ্ছে- ‘সংসদীয় আসনের প্রতি ইউনিয়ন বা পৌরসভা বা মেট্রোপলিটন এলাকার ক্ষেত্রে ওয়ার্ডপ্রতি একটি অথবা নির্বাচনি এলাকায় ২০টি (যা বেশি হয়) এর অধিক বিলবোর্ড ব্যবহার করা যাবে না’। এ সংশোধনীর ফলে প্রতিটি ইউনিয়ন, পৌরসভা ও মেট্রোপলিটন এলাকার ক্ষেত্রে ওয়ার্ডপ্রতি একটি করে বিলবোর্ডে নির্বাচনি প্রচারের সুযোগ পাচ্ছেন প্রার্থীরা। ফলে গ্রামীণ এলাকাগুলোতে বিপুল সংখ্যক বিলবোর্ড স্থাপন হবে। নির্বাচনে অনেক সংখ্যক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে এবং এই হারে বিলবোর্ড স্থাপন করলে গ্রামীণ সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এতে প্রার্থীর খরচও অনেক বেড়ে যাবে।
যদিও নির্বাচন কমিশন বলছে, এ নির্বাচনে পোস্টার ব্যবহারের সুযোগ নেই। তাই প্রার্থীর প্রচারের স্বার্থে বিলবোর্ডের সংখ্যা বাড়ছে। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে কয়েকটি রাজনৈতিক দল প্রচারের সুযোগ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে।
এছাড়া এবার সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর প্রচারে পোস্টার ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে ইসি। কিন্তু আচরণ বিধিমালার বিধি ৭-এর (গ) ও (ঘ) উপবিধিতে পোস্টার নিয়ে বিধি-নিষেধ উল্লেখ রয়েছে। আচরণবিধির এই বিধান নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোও ইসির সংলাপে প্রশ্ন তুলেছিল। ইসি ওই বিধিতে সংশোধনী এনে পোস্টার শব্দ বাদ দিয়েছে। একই সঙ্গে ‘লিফলেট, ব্যানার বা হ্যান্ডবিল’ টাঙ্গানোর যে অনুমোদন আচরণবিধিতে রয়েছে, সেই অংশ বাদ দিতে যাচ্ছে।
আচরণ বিধিমালার বিধি ১৭-এর উপবিধি (১) সংশোধন করে নির্বাচনি প্রচারে মাইক ব্যবহারের সংখ্যা বাড়ানোর সুযোগ দিচ্ছে ইসি। প্রস্তাবিত সংশোধনী হচ্ছে-‘কোনো প্রার্থী বা তার পক্ষে কোনো ব্যক্তি কোনো নির্বাচনি এলাকায় কোনো জনসভায় একইসঙ্গে তিনটির বেশি মাইক্রোফোন বা লাউড স্পিকার ব্যবহার করতে পারবেন না। তবে সাধারণ প্রচারণার জন্য ব্যবহৃত মাইক্রোফোন বা লাউড স্পিকার নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে’। ইসির কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যমান আচরণবিধিতে সর্বোচ্চ তিনটি মাইক ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীর ফলে আরও বেশি সংখ্যক মাইক ব্যবহার করতে পারবেন প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ : জানা গেছে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ২৭, ৩৭ ও ৩৯ অনুচ্ছেদে ভুল সংশোধন ও নতুন প্রস্তাবনা যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে নির্বাচন কমিশন। সংশ্লিষ্টরা জানান, অনুচ্ছেদ ২৭-এ কিছু সংশোধনীর পাশাপাশি নতুন বিধান যুক্তের প্রস্তাব করেছে ইসি। ওই প্রস্তাব হচ্ছে-পোস্টাল ব্যালটে কোনো প্রতীকের বিপরীতে ক্রস বা টিক চিহ্ন না দিলে ওই ব্যালট গণনার বাইরে থাকবে। কোনো আসনে আদালতের রায়ে প্রার্থী তালিকায় পরিবর্তন এলে ওই আসনের জমা হওয়া পোস্টাল ব্যালটও গণনা করা হবে না। পোস্টাল ব্যালটের সঙ্গে যে ঘোষণাপত্র যাবে, সেখানে ভোটার সই না করলে ওই ভোটও গ্রহণযোগ্য হবে না।
আরও জানা গেছে, নির্বাচনে দুজন প্রার্থী সমান ভোট পেলে লটারির মাধ্যমে জয়ী ঘোষণার বিধান সর্বশেষ আরপিওর সংশোধনীতে বাতিল করা হয়েছে। একইসঙ্গে আরপিও’র ৩৮ অনুচ্ছেদে ওই আসনে নতুন করে ভোটগ্রহণ করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু ৩৭ ও ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদে লটারির মাধ্যমে ফলাফল ঘোষণার বিধানটি এখনও আরপিওতে রয়েছে। ইসি ওই বিধান বাতিলের প্রস্তাব করেছে। একইসঙ্গে ৩৭(এ) অনুচ্ছেদে কিছু সংশোধনী যুক্ত করেছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, পোস্টাল ব্যালটের ভোট গণনার জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তা (সাধারণতঃ ডিসি) তার কার্যালয়ে প্রিজাইডিং ও সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেবেন। তারা ওই ভোট গণনা করে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে ফলাফল দেবেন। রিটার্নিং কর্মকর্তা ওই আসনের প্রার্থীদের পোস্টাল ব্যালটের ভোট যুক্ত করে পরিপূর্ণ ফলাফল ঘোষণা করবেন।