দীর্ঘ ৯ মাস পর দরজা খুলেছে প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের। পর্যটকদের পদচারণে মুখর হয়ে উঠেছে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি। গতকাল সোমবার দুপুরে একে একে তিনটি জাহাজ থেকে এক হাজার ১৭৪ জন পর্যটক দ্বীপে পা রাখেন। তাঁদের সবার চোখে-মুখে ছিল খুশির ঝিলিক।
দ্বীপের বাসিন্দারা ফুল দিয়ে বরণ করেছেন পর্যটকদের। ভ্রমণবিলাসীরা দ্বীপটিতে বেড়াতে পেরে ভীষণ খুশি, তার চেয়েও বেশি খুশি ছিলেন দ্বীপবাসী। বলা চলে, বহুদিন পর শত শত পর্যটক পেয়ে সেন্ট মার্টিনবাসী অপার খুশিতে মেতেছিলেন।
এর আগে গতকাল সকাল ৭টা থেকে কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর নুনিয়াছড়া বিআইডব্লিউটি ঘাট থেকে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে ছেড়ে যায় তিনটি পর্যটকবাহী জাহাজ।
আগের দিন ভ্রমণবিলাসীরা কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে অবস্থান নেন। জাহাজে ওঠার জন্য গতকাল ভোর থেকেই শহরের নুনিয়াছড়া নৌঘাটে লাইন ধরেন তাঁরা। একেকজনের ট্রাভেল পাস যাচাই করেন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল শুরু করতে সকালে ঘাটে এসে পর্যটকদের স্বাগত জানান কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহিদুল আলম, কক্সবাজার সদরের ইউএনও নীলুফা ইয়াসমিন চৌধুরী এবং ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ।
তাঁরা সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়ন তদারকি করেন। ওই সময় জেলা প্রশাসক এম এ মান্নান বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তর ও ট্যুরিস্ট পুলিশের কঠোর তদারকিতে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ন্ত্রণ ও প্লাস্টিক ব্যবহারে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। সচেতনতার অংশ হিসেবে প্রথম দিন যাত্রীদের হাতে অ্যালুমিনিয়ামের পানির বোতল তুলে দেওয়া হয়েছে।’
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, ‘প্রথম দিন থেকে প্রতিটি টিকিট চেক করা হচ্ছে। বিশেষ করে কোনো পর্যটকের হাতে যাতে প্লাস্টিক বোতল না থাকে সে ব্যবস্থা আমরা করছি। একটা শৃঙ্খলায় পর্যটকরা যাতে সেন্ট মার্টিন যেতে পারেন সেটা নিশ্চিত করবে ট্যুরিস্ট পুলিশ।’
পর্যটকদের নিয়ে সকাল ৭টায় কক্সবাজারের নুনিয়ারছড়া জেটি থেকে ছেড়ে যায় এমভি বারো আউলিয়া, এমভি কর্ণফুলী ও কেয়ারি সিন্দবাদ জাহাজ। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নীলুফা ইয়াসমিন চৌধুরী গণমাধ্যকর্মীদের জানান, তিনজন পর্যটককে এক হাজার ৮০০ টাকা করে অবৈধভাবে ট্রাভেল পাস ছাড়া (কিউআর কোডবিহীন) সরাসরি টিকিট বিক্রি করার অপরাধে কেয়ারি সিন্দবাদ জাহাজকে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে সতর্ক করা হয়েছে জাহাজ কর্তৃপক্ষকে।
পর্যটকবাহী তিনটি জাহাজে গতকাল কক্সবাজার থেকে সেন্ট মার্টিন যান এক হাজার ১৭৪ জন পর্যটক। কক্সবাজার থেকে এক সঙ্গে তিনটি জাহাজ যাওয়ার খবর পেয়ে সকাল থেকেই দ্বীপের লোকজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফয়েজুল ইসলাম জানিয়েছেন, পর্যটকদের বরণ করতে দ্বীপে অবস্থানরত সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা থেকে শুরু করে দ্বীপের জনপ্রতিনিধিসহ দ্বীপের বিপুল লোকজন জেটিঘাটে ছিলেন। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মৌলানা নুরুল আলম জানিয়েছেন, তিনি ফুল দিয়ে জাহাজ থেকে জেটিতে নামা পর্যটকদের অভ্যর্থনা জানিয়েছেন।
দ্বীপ ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার (ইউপি সদস্য) হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘আমরা জেটিঘাটে পর্যটকদের বরণ করেছি। দীর্ঘ ৯ মাস পর পর্যটকদের আগমনে আমাদের দ্বীপের বাসিন্দাদের কাছে যেন ঈদের খুশির মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে।’ তিনি জানান, দ্বীপের ৮০ শতাংশ লোকজন পর্যটননির্ভরশীল হয়ে গেছেন। আগে বছরের ছয় মাস পর্যটকদের আনাগোনা থাকত। তখন স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ীদের রমরমা অবস্থা ছিল। কিন্তু গেল বছর থেকে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞায় স্থানীয়রা অর্থনৈতিক কষ্টে পড়েছেন। এ কারণে দীর্ঘদিন পর দ্বীপে পর্যটকদের আগমনে দ্বীপবাসী আনন্দিত।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিদিন সেন্ট মার্টিন যাবেন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক, দ্বীপের পরিবেশের জন্য সহনীয় এই সীমা ঠিক করে দিয়েছে প্রশাসন। পর্যটকরা ডিসেম্বর ও জানুয়ারি এই দুই মাস রাত্রিযাপন করতে পারবেন দ্বীপে। সরকার গত ১ নভেম্বর থেকে তিন মাসের জন্য দ্বীপ ভ্রমণের অনুমতি দিলেও নভেম্বর মাসে রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ থাকায় কোনো পর্যটক দ্বীপ ভ্রমণে যাননি। পর্যটকের অভাবে নভেম্বরে দ্বীপে জাহাজ চলাচলও বন্ধ ছিল। ‘সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (স্কোয়াব)-এর সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর বলেন, ‘মৌসুমের প্রথম যাত্রার সব প্রস্তুতি আগে থেকেই সম্পন্ন ছিল। প্রশাসনের সহযোগিতায় পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ পরিবেশে যাত্রা শুরু করা গেছে।’ আগামী মৌসুমে কমপক্ষে চার মাস রাত্রিযাপনের সুযোগ মিললে জাহাজ মালিকরা ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
রাজবাড়ী থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে আসা পর্যটক আরিফ আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি একজন চাকরিজীবী। জীবনে প্রথম সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে এলাম। সঙ্গে আছে আমার স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান। দ্বীপে নেমেই যেন আমি প্রকৃতির আরেক জগতে পা রাখলাম।’ রাজশাহী থেকে আসা পর্যটক দম্পতি সোমা ও সাইদুল মনে করেন, ‘সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষা করতে হবে। এ জন্য যাঁরা সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ করবেন তাঁদের অবশ্য সচেতন হতে হবে। কারণ, সেন্ট মার্টিন আমাদের সম্পদ।’
জাহাজ মালিকদের ‘সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের’ সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর বলেন, ছয়টি জাহাজকে প্রশাসন অনুমতি দিয়েছে, যাত্রীর আনুপাতিক হার বিবেচনায় আজ (গতকাল) তিনটি জাহাজ যায়। জোয়ার-ভাটা ও নদীর নাব্যতা বিবেচনায় প্রতিদিনের যাত্রার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে, বিকেলে সেন্ট মার্টিন থেকে ছেড়ে যাওয়া জাহাজগুলো আবার কক্সবাজারের উদ্দেশে ফিরবে।