Image description
অবসর বোর্ডে অভিনব জালিয়াতি

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডে অভিনব আর্থিক অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। অবসরে যাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের নামে ভুয়া ইনডেক্স ও জাল আবেদন দিয়ে উত্তোলন করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। নিয়ম অনুযায়ী সরকারি ব্যাংকে তাদের (শিক্ষক-কর্মচারী) অর্থ জমা না রেখে নিজেদের খুশিমতো বেসরকারি ব্যাংকে বোর্ডের বিপুল অর্থ জমা রাখা হয়। এরপর পরস্পর যোগসাজশে বাগিয়ে নেওয়া হয় জমাকৃত অর্থের মুনাফা। পছন্দের ব্যাংক কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ভুয়া অ্যাকাউন্টে বোর্ডের অর্থ স্থানান্তর করা হয়। মোটা অঙ্কের ঘুসের বিনিময়ে নিয়মবহির্ভূত অনেক আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে। ব্যাংকের চেক ব্যবহার না থাকা সত্ত্বেও ব্যয় দেখিয়ে টাকা উত্তোলন করা হয়।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের সাবেক সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ, বোর্ডের প্রোগ্রামার জামাল হোসেন এবং বোর্ডের ব্যবহারকৃত সফটওয়্যার কোম্পানির মালিক গোলাম সারোয়ার ও মোফাজ্জল মওদুদ এলাহীর যোগসাজশে এই দুর্নীতি করা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন বোর্ডের অন্য কর্মকর্তারাও। সম্প্রতি শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের উদ্যোগে পরিচালিত নিরীক্ষা কার্যক্রমে এসব তথ্য উঠে আসে। ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৫ সালের জুন-এ দুই অর্থবছরের অডিট পরিচালনা করে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর বোর্ডের সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ পালিয়ে যান। তিনি দীর্ঘ সাড়ে ৮ বছর বোর্ডের সচিব হিসাবে দায়িত্বে ছিলেন। এ সময় তিনি ও তার ভাতিজা মোফাজ্জল মওদুদ এলাহীর সফটওয়্যার কোম্পানি ‘গ্রিন বি’কে অবসর বোর্ডের কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেন। তারা পরস্পর যোগসাজশে অবসরে যাওয়া বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের শত শত কোটি টাকা তছরুপ করেন।

এদিকে অবসর বোর্ডের দুর্নীতি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমশিন অনুসন্ধান শুরু করেছে বলে জানা গেছে। বোর্ডের অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরিও করা হয়েছে। প্রোগ্রামার জামাল হোসেনকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে বোর্ডের প্রোগ্রামার জামাল হোসেনের নিয়মবহির্ভূত আবেদন, ভুয়া ইনডেক্স ও জাল আবেদনকারীদের দ্রুত টাকা পরিশোধ করার অনুরোধ জানানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি ব্যাংকে প্রভাব খাটিয়ে টাকা দিতে বাধ্য করেন। এদিকে বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীদের অবসরপ্রাপ্য সুবিধা পেতে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। অবসরে যাওয়ার পর এই অর্থ পেতে শিক্ষক ও কর্মচারীদের তিন থেকে চার বছর লেগে যায়। এর মধ্যে কেউ কেউ টাকা না পেয়ে মারাও গেছেন। এর মধ্যে এ ধরনের অনিয়ম মেনে নিতে পারছেন না অনেকে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষকরা অবসরে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে প্রাপ্য সুবিধা পান না। উলটো তিন-চার বছর হয়রানির শিকার হন। অবসর সুবিধা বোর্ডের এ ধরনের অনিয়ম ও অর্থ লুটপাট অমার্জনীয়। এসব অনিয়মে জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

অডিট পরিচালনায় যুক্ত শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের উপপরিচালক এসএম সাউদুজ্জামান সোহাগ যুগান্তরকে বলেন, আমরা অডিট পরিচালনা করে রিপোর্ট জমা দিয়েছি। এ প্রতিবেদন কয়েকদিনের মধ্যে আবার অবসর সুবিধা বোর্ডে পাঠানো হবে। সেখানে কোনো আপত্তি থাকলে বা তথ্যগত সমস্যা থাকলে সেটি সমাধান করা হবে।

শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা আইন, ২০০২-এর ধারা ৯(৪) এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা প্রবিধানমালা, ২০০৫-এর প্রবিধি ৬ লঙ্ঘন করে বোর্ড তহবিলের অর্থ সরকারি ব্যাংকে জমা রাখা হয়নি। বেসরকারি ব্যাংকে আমানতকৃত অর্থ আর ফেরত প্রদান করা হয়নি। আমানতের অর্থ ফেরত না পাওয়ায় বোর্ডের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৬৩৯ কোটি ৬০ লাখ ৬১ হাজার ৭২৫ টাকা। সম্প্রতি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সিটিজেনস ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক বরাবর মুনাফাসহ বোর্ডের অনুকূলে জমাকৃত সমুদয় অর্থ দ্রুত ফেরত প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হলেও তারা টাকা ফেরত দেয়নি। নীতিমালা ছাড়া এনডাউমেন্ট ফান্ড যথেচ্ছ বিনিয়োগ এবং যথাযথ নিয়মে হিসাবভুক্ত না করায় বোর্ডের স্থায়ী তহবিলের ঘাটতি হয়েছে ২৯ কোটি ২০ লাখ ৬৯ হাজার ১৫৭ টাকা।

অবসর সুবিধা বোর্ড পরিচালক অধ্যাপক মো. জাফর আহম্মদ যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের তদন্ত কার্যক্রমে কর্মকর্তারা বিভিন্ন তথ্য চেয়েছে, আমি তাদের সহযোগিতা করেছি। তবে অনিয়মের অনেক ডকুমেন্টস গায়েব করা হয়েছে, যেগুলো খুঁজে পাওয়া যায়নি। দ্রুত তদন্ত না হলে বোর্ড আরও শতকোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হতো বলে জানান তিনি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিদপ্তরগুলোর তালিকায় ইনডেক্স না থাকা সত্ত্বেও ভুয়া ইনডেক্স ব্যবহার করে শিক্ষক অবসর দেখিয়ে বোর্ড তহবিল থেকে ১ কোটি ৪২ লাখ ৭৮ হাজার ৫৬৭ টাকা উত্তোলন করা হয়। অবসর সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য কোনো আবেদন এবং পরিশোধের জন্য বোর্ডের কোনো অ্যাডভাইস না থাকা সত্ত্বেও প্রাপ্যতাবহির্ভূতভাবে অর্থ পরিশোধ করায় বোর্ডের আর্থিক ক্ষতি ১ কোটি ৩৭ লাখ ৯৬ হাজার ৪৯৭ টাকা। প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও একই ইনডেক্সের বিপরীতে একাধিকবার অবসর সুবিধা পরিশোধ করায় বোর্ডের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৭৯ লাখ ৬৭ হাজার ৩৩৬ টাকা।

শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডে ২০২৩-২০২৪ ও ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জাল আবেদনপত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। এতে বোর্ডের ৫৮ লাখ ৭৬ হাজার ৩৮ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

এছাড়া জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া ইনডেক্স নম্বর ব্যবহার করে মূল আবেদনকারীর নমিনি হিসাবে দেখিয়ে বোর্ড তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এতে ভুয়া ইনডেক্স নম্বর ব্যবহার করে সফটওয়্যার ভেন্ডর কর্তৃক বোর্ড তহবিল থেকে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে ৩১ লাখ ৯০ হাজার ৭৭৫ টাকা।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক বিএম আব্দুল হান্নান যুগান্তরকে বলেন, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর বোর্ডে বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষকদের অবসরের টাকা যেখানে জমা রাখার কথা, সেখানে না রেখে আত্মসাৎ করা হয়েছে।