দীর্ঘ ১৬ বছরের অপেক্ষার পর অবশেষে স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এলো পিলখানার রক্তাক্ত ঘটনার নেপথ্যের চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। এমন নিষ্ঠুর ঘটনায় স্তম্ভিত পুরো জাতি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০০৯ সালের বিডিআর হত্যাযজ্ঞ কোনো আকস্মিক বিদ্রোহ ছিল না। ছিল সুপরিকল্পিত, সংগঠিত ও বহুস্তরীয় ষড়যন্ত্র। শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, এ ঘটনায় ছিল শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা এবং ভারতের সম্পৃক্ততা। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘ সময় পরে হলেও তদন্ত প্রতিবেদনে পিলখানা হত্যাযজ্ঞের আসল ঘটনা উঠে এসেছে। তারা বলছেন, এই হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে দেওয়া ছিল ভারতের প্রধান টার্গেট। এছাড়া শেখ হাসিনার লক্ষ্য ছিল, যে কোনো মূল্যে ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করা।
এদিকে শহীদ সেনা পরিবারের সদস্যরা কমিশনের প্রতিবেদনে সন্তোষ প্রকাশ করে এটি জনসম্মুখে প্রকাশ করার দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে জড়িতদের নাম প্রকাশেরও দাবি জানান। তারা বলছেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বার্তা দেওয়া হয়েছিল যে, সেনাবাহিনীতে কেউ ভারতবিরোধী হলে ভবিষ্যতে এমন পরিণতি হতে পারে।
রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া) চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুল হক যুগান্তরকে বলেন, আগের সরকার (হাসিনা সরকার) তাদের নিজেদের মতো তদন্ত কমিটি করেছিল। যাতে সব তদন্ত তাদের পক্ষে যায়। এ কারণে প্রকৃত অপরাধীদের বিচার হয়নি। বরং নিরীহ-নিরপরাধ বিডিআরের সদস্যদের গ্রেফতার করে ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যমে তাদের জেল ও ফাঁসির রায় দেয়। হাজার হাজার পরিবারকে তারা ধ্বংস করে দেয়। প্রকৃত সত্যকে ধামাচাপা দিতে হাসিনা সরকার এটা করেছিল। ৫ আগস্ট-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে পিলখানা হত্যার আসল ঘটনা বের করতে কমিশন গঠন করে। কিছুটা সময় লাগলেও বিস্তারিত তদন্ত হয়েছে। এই প্রতিবেদন জনগণের কাছে উন্মুক্ত রাখার সুযোগ আছে।
তিনি আরও বলেন, ভারত আওয়ামী লীগকে লালন-পালন করে। তাদের স্বার্থরক্ষায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে ধ্বংস ও দুর্বল করতে তারা (ভারত) হাসিনা ও রেহানাকে দিয়ে সেই চেষ্টা করেছে। তারা কোনোভাবেই চায় না বাংলাদেশে একটা শক্তিশালী সেনাবাহিনী থাকুক। তারা সব সময় সর্বশক্তি দিয়ে দুটি জিনিসের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে। একটা হলো আর্মিকে ড্যামেজ করা। অন্যটি হলো ইসলামি শক্তি যেন বাংলাদেশে আবির্ভূত না হতে পারে। আওয়ামী লীগকে দিয়ে এই দুটি এজেন্ডা তারা বাস্তবায়ন করাচ্ছিল। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে ক্ষমতায় রাখার জন্য সেনাবাহিনীকে প্রথমেই দুর্বল করে দেওয়া হয়-মন্তব্য করেন তিনি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রোকন উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, এ ঘটনায় বিদেশি ষড়যন্ত্র ছিল। বিদেশি মানে আমি খোলাখুলি বলি, ভারতের ষড়যন্ত্র ছিল। তাদের লোকজন জড়িত ছিল। এছাড়া আওয়ামী লীগের নেতারা জড়িত ছিল। জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, ফজলে নূর তাপস থেকে শুরু করে আরও অনেকেই ছিল। এটা অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’। কারণ এগুলো কিন্তু আলটিমেটলি আগেই বের হয়ে এসেছিল। এখন আমি খুশি। কারণ এই তদন্তে এটা পরিষ্কারভাবে বের হয়ে আসছে এবং এটা জনগণের কাছে উন্মোচন করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। তিনি আরও বলেন, ভারত, আওয়ামী লীগ ও তৎকালীন সরকারের জড়িত থাকার যে তথ্য সামনে আসছে, তা সত্য। এগুলোকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য, এগুলো যাতে বের হয়ে না আসে সেজন্য তড়িঘড়ি করে কিছু লোককে ‘এস্কেপ্টগট’ (বলির পাঁঠা) বানিয়ে একটা বিচার করা হয়েছিল। কিছু লোককে জেল দিয়েছে, কিছু লোককে চাকরিচ্যুত করেছে। এভাবে করে ফাইলটাকে ওরা ক্লোজ করেছিল। এখন সরকারের উচিত জরুরিভাবে যারা দোষী তাদের বিচারের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা।
ভারত ও আওয়ামী লীগ কেন এই ঘটনা ঘটিয়েছিল সে প্রসঙ্গে রোকন উদ্দিন বলেন, এর অনেকগুলো কারণ আছে। এক নম্বর কারণ হলো-জাতিসংঘ মিশন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্বব্যাপী আমাদের সেনাবাহিনীর অনেক সুনাম রয়েছে। ভারত এখানে পিছিয়ে থাকায় ঈর্ষা থেকে আমাদের সুনাম নষ্ট করতে চেয়ছিল। দ্বিতীয়ত, তারা পাদুয়া-রৌমারির ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এটা করেছে। তিন নম্বর কারণ হচ্ছে-আমাদের দেশের সেনাবাহিনীর প্রফেশনালিজম নষ্ট করা। এর জন্য একসঙ্গে ৫৭ জন দক্ষ অফিসারকে হত্যা করা হয়। বিশ্বযুদ্ধেও একসঙ্গে এত অফিসার মারা যায়নি। এছাড়া শেখ হাসিনা তার ক্ষমতাকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করার জন্য এটা করেছিল। এদিকে ‘বিডিআর তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশে শহীদ পরিবারের মতপ্রকাশ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন সোমবার দুপুরে মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিডিআর হত্যাকাণ্ডে শহীদদের পরিবারের সদস্যরা বক্তব্য রাখেন। তাদেরও অভিযোগ, ভারতের স্বার্থরক্ষা ও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার নিজ ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার উদ্দেশ্যেই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
সাবেক বিডিআর মহাপরিচালক (ডিজি) শহীদ মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে যাদের নাম এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বার্তাটা ছিল এমন, সেনাবাহিনীতে কেউ ভারতবিরোধী হলে তার পরিণতি হবে পিলখানার মতো।
শহীদ কর্নেল কুদরুতী ইলাহীর ছেলে অ্যাডভোকেট সাকিব রহমান বলেন, কমিশন বলেছে, কিছু নাম আপাতত প্রকাশ করতে চায় না। আমরা মনে করি, এই অজুহাত দেখিয়ে নামগুলো আর প্রকাশ করা হবে না। শহীদ পরিবার হিসাবে আমরা তা মেনে নেব না। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে সামরিক ও বেসামরিক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেফতার দাবি করেন। শহীদ কর্নেল মুজিবুল হকের ছেলে মুবিন হক বলেন, আমরা ন্যায়বিচারের জন্য রাস্তায় নেমেছি। আওয়ামী লীগ ও তাদের কিছু অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা আমাদের মানহানি করেছে, সম্মিলিতভাবে অপপ্রচার চালিয়েছে। শহীদ পরিবারকে হুমকিও দেওয়া হয়েছে। তিনি সরকারকে শহীদ পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
শহীদ সুবেদার মেজর নূরুল ইসলামের সন্তান আশরাফুল আলম হান্নান বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার একটি মিথ্যা ইস্যু সামনে এনে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এর মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার সূচনা করে। দেশের মানুষ জানে এই হত্যাকাণ্ড কারা করেছে, আওয়ামী লীগ করেছে, শেখ হাসিনা করেছে এবং ভারতের সংশ্লিষ্টতা ছিল। তিনি তদন্ত প্রতিবেদনটি দ্রুত প্রধান উপদেষ্টার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার দাবি জানান।
শহীদ মেজর মোসাদ্দেকের মেয়ে লাইকা অভিযোগ করেন, শহীদ অফিসারদের নাম এখনো গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়নি। লেফটেন্যান্ট কর্নেল লুৎফর রহমানের মেয়ে ডা. ফাবলিহা বুশরা বলেন, ১৬ বছর পর যখন ন্যায্য বিচার চাইতে গেলাম, তখন নোংরা ভাষায় আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়, মিথ্যাচার এবং চরিত্রহরণের চেষ্টা করা হয়। ফ্যাসিস্ট চলে যাওয়ার পরও আমাদের হুমকি দেওয়া হয়।
এর আগে রোববার ৩০ নভেম্বর কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের ৪০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেয়। পরে সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিআরআইসিএম নতুন ভবনের সপ্তমতলায় এদিন সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করেন কমিশনের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান। এ সময় তিনি বলেন, তদন্তে বিডিআরকে দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা এবং বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, ভারত চেয়েছিল বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে, আর তৎকালীন সরকার ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ কয়েকজন রাজনৈতিক ও সামরিক নেতার নাম উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, শেখ সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, সাহারা খাতুন, জেনারেল তারেক সিদ্দিকী, তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ, তৎকালীন ডিজিএফআইর প্রধান মেজর জেনারেল আকবরের নাম উঠে এসেছে এই প্রতিবেদনে। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সরকার তার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছিল এবং ভারত চেয়েছিল বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে।
ঘটনার সময়কার পরিস্থিতিতে ভারতীয়দের সম্পৃক্ততার প্রসঙ্গ তুলে কমিশনপ্রধান তখন আরও বলেন, ঘটনার সময় ৯২১ জনের মতো ভারতীয় বাংলাদেশে এসেছিল। তার মধ্যে ৬৭ জন ভারতীয়ের হিসাব মিলছে না। তারা কোন দিক দিয়ে বের হয়ে গেছে, তারও প্রমাণ মিলছে না। ওই ব্যক্তিরা কেন এলো, কোথায় গেল, এ ব্যাপারে ভারতের কাছে জানতে চাওয়ার জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ করেছে কমিশন।
বিডিআর কল্যাণ পরিষদের সংবাদ সম্মেলন : এদিকে সংবাদ সম্মেলন করে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না করা হলে বৃহত্তর আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিডিআর কল্যাণ পরিষদ। সোমবার বিকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্র্যাব) হলরুমে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের সভাপতি মো. ফয়জুল আলম বলেন, পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় গঠিত স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার জন্য উন্মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখনো প্রতিবেদন সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি। তিনি নিরপরাধ বিডিআর সদস্যদের সম্মানে চাকরির সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দাবি জানান। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বিডিআর কল্যাণ পরিষদের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা হাবিলদার মনিরুজ্জামান। এ সময় তিনি চার দফা দাবি উপস্থাপন করেন। দফাগুলো হলো-তদন্ত কমিশনের দাখিলকৃত প্রতিবেদন আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গভাবে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। যারা প্রকৃতভাবে দায়ী-তাদের বিরুদ্ধে নতুন করে নিরপেক্ষ বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। সাজানো তদন্ত ও মিথ্যা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে অন্যায়ভাবে ঢালাও অভিযোগে দণ্ডিত নির্দোষ এবং অভিযুক্ত বিডিআর সদস্যদের মুক্তি এবং চাকরিতে পুনর্বহাল ও ক্ষতিপূরণ দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পুনঃতদন্তের দাবি ওঠায় গত ২৪ ডিসেম্বর সরকার জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে। সাক্ষ্যদাতাদের মধ্যে নিহতদের পরিবার, রাজনৈতিক নেতা, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, পুলিশ সদস্য, সাবেক ও বর্তমান বিডিআর-বিজিবি সদস্য, কারাবন্দি ব্যক্তি ও তিনজন সাংবাদিকও ছিলেন।