বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী চাঁদাবাজি দন্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু শুধু চাঁদাবাজির অপরাধে এখন পর্যন্ত কেউ চূড়ান্ত সাজা পায়নি। চাঁদাবাজরা গ্রেপ্তার হয় বটে কিন্তু সাক্ষীর অভাবে, তদন্তের দুর্বলতায় এবং নানান বাস্তবতায় আসামিরা খালাস পায়। বেরিয়ে এসে আবার চাঁদাবাজি শুরু করে।
বাংলাদেশে চাঁদাবাজি প্রতিরোধে যেসব আইন আছে তার মধ্যে রয়েছে- চাঁদাবাজির মামলার ক্ষেত্রে প্রধানত দন্ডবিধি ১৮৬০-এর ৩৮৫ ধারা প্রযোজ্য হয়। এই ধারায় কাউকে জখম করার বা ক্ষতি করার ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ছাড়া চাঁদাবাজির ধরন এবং পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে অন্যান্য ধারাও ব্যবহার করা হতে পারে, যেমন ৩৪২ ধারা (অন্যায়ভাবে আটক), ৫০৬ ধারা (ভয়ভীতি প্রদর্শন) এবং ৩৪ ধারা (সাধারণ উদ্দেশ্য)।
দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩৮৫ ধারা : কাউকে জখম বা ক্ষতি করার ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করার অপরাধের জন্য এই ধারাটি প্রধান। এর শাস্তি হিসেবে ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড, জরিমানা অথবা উভয়ই হতে পারে।
দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ৫০৬ ধারা : যদি চাঁদাবাজির জন্য ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়, তবে এই ধারাটি ব্যবহার করা হয়।
দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩৪ ধারা : যখন একাধিক ব্যক্তি একটি সাধারণ উদ্দেশ্য নিয়ে চাঁদাবাজির অপরাধে লিপ্ত হয়, তখন এই ধারাটি প্রয়োগ করা হয়।
বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ এর ধারা ৩(২) : জননিরাপত্তা বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার মতো গুরুতর চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে সরকার এই আইন প্রয়োগ করতে পারে।
সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ : এই আইনের ৩৮ ধারায় চাঁদাবাজি নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এর বিধান লঙ্ঘনের জন্য শাস্তি রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (চৎবাবহঃরড়হ) আইন, ১৯৯২ : এই আইনে চাঁদাবাজিকে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং এর জন্য জরিমানাসহ ২ থেকে ৭ বছরের কারাদন্ড হতে পারে।
কিন্তু কাগজেকলমে থাকা এসব আইনের বাস্তব প্রয়োগ একেবারেই নেই। পুলিশের নথিপত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত এক বছরে ঢাকা মহানগরীতে মোট ২৭৩টি চাঁদাবাজি মামলা রেকর্ড হয়েছে। এসব মামলায় ৪৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু এসব একটি মামলারও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি আদালতে। তবে অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, যে মামলা রেকর্ড হয়েছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। বাস্তবে চাঁদাবাজির সঙ্গে এই পরিসংখ্যানের কোনো মিল নেই।
অপরাধ প্রবণতা নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান ক্রাইম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা শহরে প্রতিদিন ১২৮টি চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চাঁদাবাজির ঘটনা ভুক্তভোগীরা প্রকাশ করতে চান না। নিরাপত্তাহীনতার কারণে তারা বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাইরে সমাধান করার চেষ্টা করেন। সংগঠনটির গবেষণায় দেখা যায়, কেবলমাত্র চাঁদাবাজির সঙ্গে সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দৃশ্যপটে আসে। নীরব চাঁদাবাজির ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়।
বাংলাদেশে চাঁদাবাজি অপরাধ হলেও কিছু চাঁদাবাজিকে স্বাভাবিক মনে করা হয়, যেমন ফুটপাতে চাঁদাবাজি, সড়কে, বাজার হাটে চাঁদাবাজিকে এখন অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। তাই অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন আইন করে চাঁদাবাজি বন্ধ করা সম্ভব নয়। তাদের মতে, চাঁদাবাজরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পায়। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজরা বেড়ে ওঠে, নিরাপদে থাকে। অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, চাঁদাবাজ এবং রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক গিভ অ্যান্ড টেকের। রাজনৈতিক দলগুলোর মাসলম্যান হিসেবে কাজ করে চাঁদাবাজরা। বিনিময়ে তাদের আশ্রয় দেয় রাজনৈতিক দলগুলো। তাই চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হলে প্রথমে এর উৎসমুখ বন্ধ করতে হবে। শুধু কথায় নয়, রাজনৈতিক দলগুলোকে আন্তরিকভাবে চাঁদাবাজদের না বলতে হবে। তবেই আইনের সঠিক প্রয়োগ করা সম্ভব হবে।