Image description
অস্বাভাবিক মৃত্যু বাড়ছে, নীতির অভাবে সংকট আরও ঘনীভূত

রেমিট্যান্স-যোদ্ধারা দেশের অর্থনীতি সচল রাখলেও প্রবাসে শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিশেষজ্ঞরা এটিকে ‘অদৃশ্য মহামারি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তবে নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে সেটি অগ্রাধিকার পায়নি।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে ২০ হাজারের বেশি প্রবাসী শ্রমিকের লাশ দেশে ফিরেছে। এর মধ্যে ৩১ শতাংশই ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’। সরকারি হিসাব অনুযায়ী আত্মহত্যার সংখ্যা প্রায় ৭০০ হলেও গবেষকদের দাবি, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কারণ বিদেশে রিপোর্ট হওয়া মৃত্যুর সত্যতা যাচাইয়ে দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত দেশে করা হয় না। অভিবাসন গবেষকদের মতে, কর্মঘণ্টা, কাজের ঝুঁকি, বাসস্থান ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে বাস্তব তথ্য চুক্তিতে উল্লেখ না থাকায় অনেক শ্রমিক শুরু থেকেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়েন। অভিবাসনের রেজিস্ট্রেশন, ভিসা, এজেন্ট ফি, টিকিট সব মিলিয়ে শ্রমিকদের ওপর পড়ে উচ্চ ব্যয়ের চাপ, যার বড় অংশই আসে ঋণ থেকে। প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক জানায়, গত পাঁচ বছরে গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত প্রায় ১৫০ প্রবাসী শ্রমিককে বিদেশ থেকে ফিরিয়ে এনে চিকিৎসা দিয়েছে তারা। এ ছাড়া দেশের ৩০টি মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সেন্টারের মাধ্যমে ১৫ হাজারের বেশি শ্রমিককে মানসিক সহায়তা দিয়েছে। সংস্থাটি মনে করে, হৃদরোগ বা স্ট্রোক হিসেবে দেখানো অনেক মৃত্যুর পেছনে উপেক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাই মূল কারণ। বিদেশে শোষণ, বিচ্ছিন্নতা এবং ব্যর্থতার চাপ এই মানসিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে তোলে। দেশে ফিরে অনেক শ্রমিক পুনরায় বেকারত্ব, আর্থিক সংকট এবং সামাজিক চাপের মুখে পড়ে আরও ভেঙে পড়েন। সৌদি আরব, কাতার, মালয়েশিয়া, ওমান, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে কর্মরত বেশির ভাগ শ্রমিক দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, কম মজুরি এবং গাদাগাদি বাসস্থানে থাকেন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, এসব শর্ত শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ক্ষতিও সৃষ্টি করে। একাকিত্ব, ভাষাগত বাধা ও সহায়তার অভাব শ্রমিকদের মানসিক ভাঙনের দিকে ঠেলে দেয়। বেশির ভাগ দেশে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য নেই কোনো মানসিক সহায়তা কেন্দ্র। দূতাবাসগুলোরও কাউন্সেলিং সেবা দেওয়ার উপযুক্ত কাঠামো নেই। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের পরিচালক ড. এ টি এম মাহবুব-উল করিম বলেন, কর্মরত দেশে পদ্ধতিগত সহায়তা না থাকলে ঝুঁকি কমানো সম্ভব নয়। নারী অভিবাসীদের মানসিক সংকট বহুমাত্রিক ও জটিল। নির্যাতন, শোষণ, নিয়োগদাতার স্বেচ্ছাচার, যোগাযোগ নিষেধ সব মিলিয়ে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। রামরুর নির্বাহী পরিচালক তাসনিম সিদ্দিকীর মতে, অনেক নারীর ‘আত্মহত্যা’ বাস্তবে নির্যাতন-সম্পর্কিত সন্দেহজনক মৃত্যু। তদন্তের অভাবে বেশির ভাগ ঘটনা চাপা পড়ে যায়। রুমা আক্তার সালমার মৃত্যুর ঘটনায় পাঁচ মাস পর পরিবার তার লাশ পেলেও কোনো স্বাধীন তদন্ত হয়নি যা এই অবহেলারই প্রতিচ্ছবি।

যারা বিদেশে শোষণ, নির্যাতন বা বেতন না পাওয়ার কারণে হঠাৎ দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন তাদের বেশির ভাগই বেকারত্ব, ঋণচাপ ও সামাজিক অবস্থান হারানোর সংকটে দিশাহারা হয়ে পড়েন। এ ধাক্কা অনেকের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রবাসী শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্য সংকট একটি স্পষ্ট নীতি-ব্যর্থতা। এর সমাধানে প্রয়োজন প্রি-ডিপার্চার ওরিয়েন্টেশনে বাধ্যতামূলক মানসিক স্বাস্থ্য মডিউল; কর্মরত দেশে দূতাবাসভিত্তিক কাউন্সেলিং সেন্টার; দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে শ্রমিকদের মানসিক সুরক্ষা ধারা অন্তর্ভুক্তি; নারী শ্রমিকদের জন্য নির্যাতন প্রতিরোধ ও জরুরি মনিটরিং সেল; দেশে ফিরতি শ্রমিকদের জন্য পুনর্বাসন ও দীর্ঘমেয়াদি কাউন্সেলিং সেবা। অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, গত ২১ বছরে বিশ্বের ১৬০ দেশে ১ কোটি ৪০ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক গেছেন। তাদের রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান শক্তি। কিন্তু এ অর্জনের বিনিময়ে অসংখ্য পরিবার মানসিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। এখনই নীতিগত পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরও সংকটময় হবে বলে সতর্ক করেন তিনি।