Image description

কইতো মা, আমরা গরীব দেইখা সবাই টেসে। আমি ইতালি জামু মা। কিন্তু আমি যাইতে দিছি নাই। ওই ডাহাইতরা আমার কামাইসুদ নিয়া গেছে। এহন আমারে কেডা কামাই কইরা খাওয়াইবো বাবা।

এভাবেই বুকফাটা আর্তনাদে কথাগুলো বলছিলেন লিবিয়ার ভূমধ্যসাগরে মাফিয়াদের গুলিতে নিহত মাদারীপুরের যুবক মুন্না তালুকদারের (২২) মা রাবেয়া বেগম। মুন্নার বাবার নাম ইমারত হোসেন তালুকদার। তিন ভাই-বোনের মধ্যে মুন্না ছিলেন সবার বড়। বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করে সংসারের হাল ধরেছিলেন তিনি। গত ১ নভেম্বর থেকে ১৮ দিন নিখোঁজ থাকার পর মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) মুন্নার মৃত্যুসংবাদ পায় পরিবার। এরপরই পালিয়েছে দালাল চক্রের সদস্য ও তাদের পরিবার।

বুধবার (১৯ নভেম্বর) নিহত মুন্নার গ্রামের বাড়ি জেলার রাজৈর উপজেলার বদরপাশা ইউনিয়নের পূর্ব দুর্গাবদ্দি গেলে দেখা যায় হৃদয় বিদারক পরিস্থিতি। একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে মায়ের বুকফাটা কান্নায় বারবার মুর্ছা যাওয়া, বাবারও অশ্রু সংবরণ করতে না পারা সব মিলিয়ে শোকে স্তব্ধ স্বজনরা।

এসময় স্বজন ও স্থানীয়রা ঢাকা পোস্টকে জানান, আশপাশের অনেকেই ইতালিতে গিয়ে অল্প সময়ে ভালো অবস্থায় পৌঁছেছেন। তাদের দেখে পরিবারে স্বচ্ছলতা আনতে একই স্বপ্ন দেখেন মুন্না। বেছে নেন অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার পথ। প্রতিবেশী দালাল নান্নু শেখের মাধ্যমে মাদারীপুর সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের আদিত্যপুর গ্রামের মানবপাচারচক্রের সদস্য শিপন খানের সঙ্গে ২২ লাখ টাকায় চুক্তি হয়। পরে আরও ৩৫ হাজার টাকা নেয় তারা। এরপর গত ৮ অক্টোবর ইতালির উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়েন মুন্না।

গত ১ নভেম্বর লিবিয়া থেকে ২৬ জন বাংলাদেশিকে নিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ইতালির পথে রওনা হয় তারা। পথিমধ্যে সাগরে মাফিয়াদের গুলিতে মারা যান মুন্নাসহ মাদারীপুরের আরও দুই যুবক। এ সময় দালাল পরিবারকে জানায়, তারা হাসপাতালে ভর্তি আছে। পরে মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) দালালকে চাপ দিলে ১৮ দিন পর জানা যায় মুন্না ও মাদারীপুর সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের আদিত্যপুর গ্রামের হাজী মো. তৈয়ব আলী খানের ছেলে ইমরান খান মারা গেছেন।

এদিকে গত ১১ নভেম্বর ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবির ঘটনায় রাজৈর পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড ঘোষলাকান্দি গ্রামের কুদ্দুস শেখের ছেলে বায়েজিত শেখ (১৮) নিহত হন। তার মৃত্যুসংবাদও পরিবার মঙ্গলবার জানতে পারে। বায়েজিতকে নেওয়ার জন্য বদরপাশার স্থানীয় মানবপাচারকারী এনামুলের সঙ্গে ২০ লাখ টাকায় চুক্তি হয়েছিল।

নিহত মুন্নার বাবা ইমারত হোসেন তালুকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, জমি বিক্রি কইরা আর সুদে টাকা আনি ছেলেকে পাঠাইছিলাম। ২২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা নিছে দালাল। গেম দেওয়ার পর ১৮ দিন কোনো খবর পাই নাই। জিজ্ঞেস করলে বলে হাসপাতালে আছে। পরে জানতে পারি পাশের বাড়ির একজন মারা গেছে। দালালের ভাইরে দিয়া চাপ দিলে জানায় মুন্না আর নাই। আমার বাড়িটা ছাড়া আর কিছু নাই। ছেলেটা কৃষিকাজ করে সংসার চালাইতো। ও ছাড়া সংসার চলবে কেমনে? দালালের কঠোর বিচার চাই। সরকারের কাছে দাবি ছেলের লাশ যেন দেশে আনা হয়।

মুন্নার বড় মামা আজিজুল হাকিম শেখ বলেন, অতি দরিদ্র পরিবার হওয়ায় ভাইগ্না লিবিয়া হয়ে সাগর পথে ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু লিবিয়ায় নেওয়ার পর বিভিন্নভাবে নির্যাতন করেছে দালালরা, ঠিকমতো খেতেও দেয় নাই। ১৮ দিন আমাদের কিছু জানায় নাই। পরে নান্নু শেখের ভাই পান্নু শেখকে দিয়ে চাপ দিলে সত্য জানতে পারি। আমরা দালালদের শাস্তি চাই। ভাইগ্নার লাশ যেন দেশে এনে দাফন করতে পারি এ ব্যবস্থা সরকারের কাছে চাই।

 

নিহত ইমরান খানের পরিবার জানায়, ইমরানকে ইতালি পাঠাতে দালাল শিপন খানের সঙ্গে ২২ লাখ টাকার চুক্তি হয়েছিল। লিবিয়ায় নিয়ে তাকে নির্যাতন করে পরিবারের কাছ থেকে আরও ১৮ লাখ টাকা নেয়। কিন্তু ১৮ দিন আগে মাফিয়াদের গুলিতে মারা গেলেও কিছুই জানায়নি দালালরা। মঙ্গলবার অন্যদের মাধ্যমে পরিবার বিষয়টি জানতে পারে। মুন্না ও ইমরান একই সময় মারা গেছে। তবে শিপনের স্বজনদের দাবি সে জোর করে কারও পাসপোর্ট নেয়নি, ঘটনায় তার কোনো সম্পৃক্ততাও নেই।

অভিযোগ রয়েছে বছরের পর বছর লিবিয়ায় থেকে আত্মীয়-স্বজনকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় যুবকদের সহজে ইতালি পাঠানোর লোভ দেখায় শিপন। এর আগেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও সে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিল।

মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) জাহাঙ্গীর আলম জানান, লিবিয়ায় তিন যুবকের মৃত্যুসংবাদ তারা পেয়েছেন। এ ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দালালদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না।